দক্ষিণ পর্বতের পাশে একটা নগর ছিল। লোকে বলত সেই পর্বতের চূড়ায় ঘন্টাকর্ণ নামে এক রাক্ষস বাস করত একদিন এক চোর এক গৃহস্থের বাড়ি থেকে একটা ঘণ্টা চুরি কর
পঞ্চতন্ত্র
বুদ্ধির জয়
দক্ষিণ পর্বতের পাশে একটা নগর ছিল। লোকে বলত সেই পর্বতের চূড়ায় ঘন্টাকর্ণ নামে এক রাক্ষস বাস করত একদিন এক চোর এক গৃহস্থের বাড়ি থেকে একটা ঘণ্টা চুরি করে। চোর ঘণ্টাটা নিয়ে একটা গোপন পথ দিয়ে পর্বতের চূড়ার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। পথে একটা বাঘ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে চোরটাকে খেয়ে ফেলল।
এই খবর কেউই জানল না। ওই পর্বতের কতগুলো বানর সেই ঘণ্টাটা কুড়িয়ে পেয়ে নিয়ে গেল। ওরা তো মনের সুখে ঘন্টা বাজায় রোজই টিংটিং করে। ঘন্টা বাজায় আর নাচে মহা আনন্দে।
এমনিতেই জায়গাটা পাহাড়ী এলাকা। খুবই নির্জন। ওই ঘণ্টার শব্দ শহরের লোকেরা শুনতে পেত। কাঠুরিয়ার পর্বতে কাঠ কাটতে যেত। ওরাও একদিন বাঘে খাওয়া এক পথিকের হাড়গোড় দেখতে পেল। হাড়গোড় দেখে ওরা ভাবল এটা নিশ্চয়ই রাক্ষসের কাজ। ৱাক্ষসই ওকে খেয়েছে। তারপর ঘণ্টার শব্দ শুনে ভাবল, এটাও রাক্ষসই বাজাচ্ছে। তারপর থেকে ওরা যখনই ঘন্টার শব্দ শুনত তখনই ভাবত রাক্ষসই মানুষ খাচ্ছে আর ঘণ্টা বাজাচ্ছে। রাক্ষসের ভয়ে শহরের সব লোক রাজ্য ছেড়ে পালাতে লাগল। সবার মনে ভয় এই বুঝি রাক্ষস তাদের খেয়ে ফেলবে।
প্রজাদের রাজ্য ছেড়ে পালানো দেখে রাজা মহাবিপদে পড়লেন। ভাবলেন, প্রজার যদি রাজ্যই ছেড়ে চলে যায়—তা হলে তিনি কাকে নিয়ে রাজত্ব করবেন!”
রাজার কয়ালা নামে এক বিশ্বাসী চাকর ছিল। সে ভাবল, রাক্ষস যদি মানুষই খাবে, তবে ঘণ্টা বাজাবে কেন? তা হলে মানুষতো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে। তা ছাড়া এই পর্বতে যে রাক্ষস আছে তার কি প্রমাণ আছে? এই ভেবে কয়ালা কারণ খুঁজতে লাগল এবং সত্যি জানতে পারল যে এই ঘণ্টা বাজানোর কাজ হচ্ছে বানরদের !
মহারাজ, যদি আদেশ করেন তাহলে আমি ঘণ্টাকর্ণকে বশীভূত করতে পারি। তবে আপনাকে এর জন্য একটু খরচ করতে হবে।
তাই খুব সাহস নিয়ে কয়ালা একদিন রাজার কাছে হাজির হয়ে বলল, মহারাজ, যদি আদেশ করেন তাহলে আমি ঘন্টাকর্ণকে বশীভূত করতে পারি। তবে আপনাকে এর জন্য একটু খরচা করতে হবে।
কয়ালার কথা শুনে রাজা খুব খুশি হলেন তক্ষুনি তাঁকে অনেক টাকা-পয়সা বকশিষ দিয়ে বললেন, তুমি যদি রাক্ষসকে বশীভূত করতে পার তাহলে তোমাকে আরো অনেক ধনদৌলত দেব। কিন্তু যদি না পর তবে তোমার গর্দান যাবে।
—বেশ, তাই হবে মহারাজ! তারপর কয়ালা অনেকগুলো কলা কিনে পর্বতের এক জায়গায় সেগুলোকে ছড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বানরগুলো অত কিছু বোঝে না, ওরা কলা পেয়ে ঘণ্টাটা মাটিতে রেখে মনের সুখে কলা খেতে লাগল। বানরগুলো যখন কলা খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে কয়ালা মাটি থেকে ঘণ্টাটা তুলে নিল। ঘণ্টা নিয়ে সোজা রাজবাড়ির দিকে রওনা দিল। রাজার হাতে ঘণ্টাটা তুলে দিল।
—এই নিন মহারাজ রাক্ষসের ঘণ্টা। রাজা ঘণ্টা পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। কয়ালাকে অনেক ধনদৌলত দিলেন। আর প্রজারাও এই খবর শুনে মনে মনে ভাবল, যাক, বাঁচা গেল---আর রাক্ষসের ভয় নেই।
এই ঘটনায় কয়ালা যা সম্মান পেল তা ভাবাই যায় না। এই গল্প বলে দমন বলল, তাই তো বলছি, শব্দের কারণ না জেনেই সবাই ভয় পেয়েছিল, শব্দের কারণ জানলে কি সবাই ভয় পেত?
তারপর দমন ও করট বলদটাকে নিয়ে হাজির করল সিংহের কাছে। প্রথমে সিংহ খুব ভয় পেয়েছিল। পরে বলদকে দেখে যখন বুঝল এটা একটা গরু ছাড় আর কিছুই নয়, তখন সিংহের ভয় এক নিমিষে উড়ে গেল। সিংহ ইচ্ছা করলে গরুটাকে তখনই খেয়ে ফেলতে পারত, কিন্তু ও তা করল না। ভাবল এতবড় প্রাণীটাকে না খেয়ে যদি ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায় তা হলে ভবিষ্যতে অনেক উপকার হতে পারে। তাই সিংহ ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে একসাথে বাস করতে লাগল।
ওদের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। তবে একদিন সিংহের ভাই এল তার সাথে দেখা করতে। সিংহ তাকে দেখে খুব খুশি হল। খুব খাতির যত্ন করে খেতে দিল। খাওয়াদাওয়া সেরে ওরা বসে কথা বলছে, এমন সময় বলদ এসে বলল-আজ এত বেশি প্রাণীহত্যা করা হয়েছে—তার মাংস সব কোথায় গেল?
সিংহরাজ হেসে বলল, তার উত্তর দমন ও করটই জানে।
বলদ বলল, তা, ওরা দুজনই এত মাংস খেয়েছে?
পশুরাজ একটু হেসে বলল, না না, ওরা কি এত মাংস খেতে পারে? কিছু খেয়েছে, কিছু ফেলেছে, রোজই তো ওরা এমন করে। এ আর এমন কি ঘটনা!
বলদ অবাক হয়ে বলল, সেকি আপনার অনুমতি ছাড়াই ওরা এই কম করে? না না, এ তো ভাল কথা নয়। কথায় বলে—বিপদ নিবারণ ছাড়া রাজার কাছে না বলে কোনো কাজ নিজের ইচ্ছামতো করা উচিত নয়। যে বিবেচক এক কপর্দকও বৃদ্ধি করতে সক্ষম সেই শ্রেষ্ঠ। ধনশালীর ধনই প্রাণ, অন্য কিছু নয়। আর যে অন্যের কথা বিবেচনা না করে যা খুশি তা করে সে কুবেরের মতো ধনশালী হলেও খুব তাড়াতাড়িই ভিক্ষুকের মতো গরিব হয়ে পড়ে।
সঞ্জীবের এই উপদেশ শুনে সিংহের ভাই বলল, হ্যাঁ, বলদ ভাই ঠিকই বলেছে। দমন ও করট নামে শেয়াল দুটো তো যুদ্ধের কাজেই নিযুক্ত। তাদের কেন মাংস আনার কাজে নিয়োগ করেছ? কাকে কোন কাজে নিয়োগ করতে হয় তা তুমি জান না? শাস্ত্রে আছেঃ—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও আত্মীয়স্বজনকে ধনদৌলতের দায়িত্বে নিয়োগ করা উচিত নয়, ব্যয় করবার জন্য রাজার অনুমতিপ্রাপ্ত অর্থও ব্রাহ্মণ অতিকষ্টে দান করেন না। ধন রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ক্ষত্রিয় নিশ্চয় খড়গ প্রদর্শন করে। মানে ঘুষ দিয়ে লোককে বশীভূত করে রাজ্যলাভে অস্ত্ৰধারণ করে। আত্মীয়স্বজনেরা সুযোগ পেয়ে অর্থ গ্রাস করে ; এই বলে সিংহের ভাই বলল, এবার তুমি বুঝে দেখ। কি করা উচিৎ আর না করা উচিৎ।
সিংহ সব শুনে বলল, কি বলব ভাই, পাজি শেয়াল দুটো আমার কোনো কথাই শোনে না। .
ভাই বলল, না না, এ তো ঠিক নয়, কথায় তো আছে—নিশ্চেষ্ট ব্যক্তির যশ নষ্ট হয়, খলের নষ্ট হয় মিত্র, চরিত্রহীনের কুল, অর্থলোভীয় যশ, জুয়াখেলায় আসক্ত ব্যক্তির নষ্ট হয় শাস্ত্রজ্ঞান, কৃপণের সুখ আর খারাপ মন্ত্রীর জন্য নষ্ট হয় রাজ্য। চোর কর্মচারী, রাজার প্রিয়জন ও নিজের লোভ থেকে রাজা প্রজাকে প্রতিপালন করবেন। এখন ভাই তুমি বলদকে খাদ্যরক্ষার কাজে নিয়োগ কর।
ভাইয়ের কথামত সিংহ সমস্ত ভার বলদের উপর দিয়ে দুজনে বন্ধুর মতো দিন কাটাতে লাগল।
এদিকে করট আর দমন দুজনে মহাবিপদে পড়ল। হাঁদারাম বলদটার দৌলতে খাবারদাবার জোটে না। একদিন দমন করটকে ডেকে বলল, বন্ধু, মহা মুশকিলে পড়া গেল দেখছি! কি করা যায় বল তো? এইরকম দুর্ভাগ্যের জন্য আমরাই দায়ী। বলদটাকে আমরা ডেকে আমলাম, এখন কিনা আমাদেরই পেটে লাথি। তাই তো দেখ না, কেতু নামে এক অভিযাত্রী রেখা নামে কোনো এক পরীর ছবি স্পর্শ করে; এক মহিলা নিজেকে দড়িতে বেঁধে এবং এক সাধু মণি নিতে গিয়ে নিজের দোযেই কষ্ট ভোগ করেছিলেন। এখন হয়েছে আমাদের সেই দশা।
করট শুনে বলল, তা কি রকম ঘটনা বলো-না শুনি । দমন তখন বলতে শুরু করল ---
বিড়াল ও ইঁদুর
উত্তরদিকের পর্বতে প্রকাণ্ড এক সিংহ বাস করত। এই সিংহটি নামেও যেমন দুর্দান্ত কাজেও তেমনি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী হলে কি হবে, সিংহের গুহায় একবার ভয়ানক ইঁদুরের উৎপাত শুরু হল। রাতে সিংহ কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। হয় ইঁদুর ওর কেশর কেটে নিয়ে যাচ্ছে, নয়তো সরু লেজের ডগা দিয়ে নাকে কানে সুরসুরি দিচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও সিংহ কিছুতেই ইঁদুরকে শায়েস্তা করতে পারছে না ! অত পিচ্চি পিচ্চি ইদুরগুলোকে ধরবে কি করে? ধরতে গেলেই ওরা পটাপট গর্তে গিয়ে ঢুকে পড়ে। খুব জ্বালাতনে পড়েছে সিংহ। মনের মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা—কি করে ওই ইঁদুরগুলোকে শায়েস্তা করা যায়। হঠাৎ ওর মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধি এল।
আর সেই পুরনো কথাটাও মনে পড়ল-—ক্ষুদ্র শক্রকে শক্তি দ্বারা নাশ করা যায় না। তাকে বিনাশ করতে হলে তার মতোই ক্ষুদ্র সৈনিক নিয়োগ করতে হয়।
এই না ভেবে সিংহ পরের দিন পাশের গ্রাম থেকে দধি নামে একটা বিড়াল এনে ওর হাতে রেখে দিল। বিড়ালটা রোজ রোজ দই চুরি করে খেত বলে ওর নাম হয়েছে দধি। সিংহ দধিকে খুব আদর যত্ন করে খাওয়াল। বিড়াল তো মহাসুখে খায়দায় আর গুহা পাহারা দেয়।
এদিকে ইঁদুরগুলোর হয়েছে খুব বিপদ। কি করে এখন তারা সিংহের কেশর কাটে? খাবারের জন্য ওরা গর্তের বাইরেই আসতে পাৱে না ওই দধি বিড়ালের জন্যে। এবার না খেয়ে দেয়ে গর্তে লুকিয়ে থাক। এভাবে বেশ ভালই দিনগুলো কাটছিল সিংহের ।
ইঁদুরগুলো না খেতে পেয়ে আর গর্তের ভিতর থাকতে পারে না। পেটের জ্বলায় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে, ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে দধি বাঁপিয়ে পড়ে ওদের উপর আর পটাপট ধরে খেতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই ইঁদুরের খেল পতম। ইঁদুরের আর সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দু দিনের মধ্যেই সিংহ তা টের পায়। ইঁদুরের আর ঋটাপটি শুনতে পায় না। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। ইঁদুরের উৎপাতের হাত থেকে রেহাই পেয়ে সিংহ আর আগের মতো বিড়ালকে খাতির যত্ন করে না। আদর করে খাবার দেয় না। ওই সবের জন্যে বিড়ালের মনে খুবই কষ্ট। ও দিন-দিন শুকিয়ে যেতে লাগল।
এই পর্যন্ত বলে দমন করটের দিকে তাকিয়ে বলল, এর জন্যই বলছিলাম মনিবের কাছে ভৃত্যের কখনোই প্রয়োজনবোধশূন্য হতে নেই। তা হলে ওই দধি বিড়ালের মধ্যে দুৰ্গতি হয়। যাক, এবার চল ষাঁড়টার কাছে যাই।
এই বলে দমন করটকে একটা গাছের তলায় বসিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হল ষাঁড়ের কাছে।
ষাঁড় তো মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে। দমনকে সামনে দেখেই মুখ তুলে তাকাল।
দমন বলল, কি হে, তুমি কোথা থেকে এখানে এসেছ? তুমি রাজার অনুমতি ছাড়া কেন এই বনে এসেছ? যদি ভাল চাও তো এখনই আমাদের সেনাপতির কাছে যাও। তানাহলে এই বন থেকে এখনই দূর হয়ে যাও। নইলে তোমার কপালে বিপদ আছে।
দমনের কথায় ষাঁড় তো হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শিয়ালের দিকে। দমন শিয়াল বলল, তুমি তো চেননা আমাদের মনিবকে। যদি খুব ক্ষেপে যায় তাহলে যে কি অঘটন ঘটবে তা কে জানে? ভালোয় ভালোয় এখনও সময় আছে জলদি কেটে পড়।
কচি ঘাস খাওয়া সঞ্জীবের মাথায় উঠল। সব ফেলে দিয়ে ছুটে গেল করটের কাছে। করটকে বলল, বলুন আমি এখন কি করব?
করট একটা লম্বা হাই তুলে মুখে হুঁম-ম-ম শব্দ করে বলল, এক কাজ কর । যাও এখনই গিয়ে আমাদের রাজ্যকে প্রণাম করে এসে।
সঞ্জীব ফের বলল, সেনাপতি যদি আমাকে অভয় দেন তো।
করট বলল, না না, তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। তুমি কি জান না ঝড়ে হওয়া কোমল, ক্ষুদ্র ও সর্বপ্রকারের নিচু তৃণকে উৎপাটিত করে না। উন্নত বৃক্ষকেই ভাঙে বা উপড়ে ফেলে। সবল দুর্বলের প্রতিই শৌর্য প্রদর্শন করে। যাকগে, এবার চল এই বলে করট ও দমন সঞ্জীবকে নিয়ে চলল রাজার কাছে। সিংহরাজের গুহার কাছেই সঞ্জীবকে একটা ঝোপের আড়ালে রেখে ওরা দুজনে গুহার ভেতরে ঢুকল।.
রাজা ওদের দেখে খুশি হয়ে বলল, প্রাণীটার খোঁজখবর কিছু পেলে?
দমন বলল, হ্যাঁ, মহারাজ ; আপনি ঠিকই বলেছেন। ওই প্রাণীটার গর্জন যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি দেখতেও। ওকে নিয়ে এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে। চলুন মহারাজ, দেখবেন চলুন।
সিংহ তো এই কথা শুনে হাত—পা এলিয়ে বসে পড়ল, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। সেই কথায় আছে, জলের বেগে আপনিই বাঁধ ভেঙ্গে যায়, গোপন না রাখলে গোপন মন্ত্রও প্রকাশ হয়ে যায়। এখানে সিংহেরও তাই হল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, তা, তা হলে তুমি বলছ সে এখানেই আছে?
দমন সাহস দিয়ে বলল, আপনি ভয় পাবেন না। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আপনি তো জানেন—শব্দের কারণ না জেনে শুধু শব্দ শুনেই ভয় পাওয়া উচিত নয়। শব্দের কারণ জেনেই তো এক দূতী কাজে সম্মান লাভ করেছিল।
সিংহরাজ এই কথা শুনে বলল-সে কি রকম শুনি? দমন বলতে শুরু করল—
গাধা ও কুকুর
অনেকদিন আগে কর্পূর নামে এক ধোপা ছিল। ওর ছিল একটা গাধা আর একটা কুকুর ; কুকুরটা বাড়ি পাহারা দিত, আর গাধা ধোপার কাপড়ের মোট বইত। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব ছিল।
একদিন ধোপার বাড়িতে চোর এল; ধোপা তো ঘুমে অচেতন উঠানের এক কোণে খুঁটিতে বাধা গাধাটা তখনও ঘুমায়নি। কুকুরও বসে আছে ওর পাশে। চোর দেখে গাধা স্থির থাকতে পারল না। লাফিয়ে উঠল। কিন্তু কুকুর টু শব্দ পর্যন্ত করল না। গাধা কুকুরের এ রকম আচরণ দেখে খুবই অবাক হয়ে গেল। মনে মনে ভীষণ রেগে গেল। সে মোটা গলায় কুকুরের দিকে তাকিয়ে বলল, মনিবের বাড়িতে চোর এসেছে। তোমার উচিত চিৎকার করে মনিবকে জাগিয়ে দেওয়া। তা না করে চুপ করে আছ কেন?
কুকুর গাধার উপদেশ শুনে বলল, তোমার কাজ তুমি করগে? আমার কাজের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। নিজের চড়কায় তেল দাও।
গাধা রেগেমেগে লাল ! বলল, কি, তোমার ব্যাপারে মাথা গলাব না? মনিব তোমায় রেখেছে বাড়িতে যাতে চোর না আসে তার জন্য, আর তুমি মনিবের খেয়েপরে তারই সাথে বেইমানি করছ? তুমি চোর দেখেও চিৎকার করবে না? আর আমাকেও চুপ করে থাকতে বলবে?
কুকুর চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ, তুমি চুপ করেই থাকবে। তুমি কি জান না যে দিনরাত আমি মনিবের বাড়ি পাহাড়া দিই। তাতে আমার কি কোন লাভ হয়েছে? বরং মনিব পায়ের উপর পা তুলে নিশ্চিন্তে আছেন। একবার ফিরেও দেখেন না আমার দিকে। বরং ভাবেন কুকুরটা পাহারা দেবেই। এটা তার দায়িত্ব। তাই আদরও করেন না। বিপদের সম্ভাবনা থাকলে ঠিক খাতিরযত্ন করত। ভালমন্দ খেতে দিত। এগুলো কি আমি মিথ্যে বলছি?
কুকুরের কথা শুনে গাধা রেগে বলল, বোকা তুমি। যে চাকর মনিবের বিপদের সময় অর্থ চায়, সে কি রকম চাকর?
গাধার কথা শুনে কুকুর আরো চটে গেল। একচেট ঘেউঘেউ করে বলল, কি সব বলছ তুমি? আর যে মনিব কাজের সময় চাকরকে আদরযত্ন করেন না, তিনিই-বা কেমন মনিব শুনি?
গাধা কুকুরের কথায় খুব ছিছি করে বলল, মনিবের বিপদের সময় কাজে অবহেলা করা অন্যায়। যাক, তুমি যখন নিজের কাজ করছই না, তখন আমাকেই মনিবকে জাগাতে হবে। এই বলে গাধা হাম্বা হাম্বা করে চিৎকার দিতে শুরু করল।
গাধার এই বিকট চিৎকার শুনে চোর তো দে ছুট। আর ধোপারও ঘুম ভেঙে গেল। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল কি হয়েছে দেখতে।
গাধা মনিবকে দেখে তো আনন্দে 'হাম্বা হাম্বা’ করে আরও জোরে চেঁচাতে লাগল। অসময়ে গাধার এই চিৎকার শুনে ধোপা তো খুব রেগে গেল। বেশ ঘুমচ্ছিল, ওর চিৎকারের জন্যই উঠে পড়তে হল। ভাবল, গাধাটা পাগল হয়ে গেছে। ধোপার মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। ব্যস, ধোপা একটা মোটা লাঠি এনে গাধাকে খুব জোরে জোরে পেটতে লাগল আর বলতে লাগল—পাজি কোথাকার রাত-দুপুরে তোমার কি আনন্দ হয়েছে যে চিৎকার করে আমার ঘুমের বারটা বাজিয়ে দিলে! দাঁড়াও, তোমায় মজা দেখাচ্ছি।
বেচারা গাধা মনিবের ভাল করতে গিয়ে এমন ঠ্যাঙানি খেল যে কি বলব?
করট বলল, তাই বলছি—কি দরকার পরাধিকার চর্চার? আমাদের খাবার তো আছেই, তাই অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানোই ভাল।
করটের কথায় দমন ছি ছি করে উঠে বলল, তুমি কি শুধু খাবারের জন্য মনিবের সেবা কর? এ তো অন্যায় কথা!
মানুষের জীবনে উন্নতি অবনতি নিজের উপরই নির্ভর করে। যেমন মানুষ তার নিজের কর্ম অনুযায়ী কূয়া খননকারীর মতো ক্রমশ নিচের দিকে যায়, আবার কর্ম অনুযায়ীই প্রাচীর নির্মাণকারীর মতো উপরের দিকে ওঠে।
করট বলল, তাহলে দমন তোমার কি মত শুনি? দমন বলল, বলার কি আছে? জল খেতে গিয়ে প্রভু ভয় পেয়েছেন, তাই হয়তো চুপটি করে আছেন।
করট শুনে বলল, কি করে বুঝলে? দমন বলল, না বোঝার কি আছে? বুদ্ধিমান মানুষের কাছে বোঝার কি বাকি থাকে শুনি? কথায় আছে, যেখানে বায়ু এবং সূর্যরশ্মি প্রবেশ করে না সেখানেও পণ্ডিতের বুদ্ধি প্রবেশ করতে পারে। এ তে মানুষের কথা বলছি। এমনকি পশুরাও বুঝতে পারে যে চালকের আদেশেই ঘোড়া তার ভার বহন করে।
করট সব শুনে বলল, হ্যাঁ, সবই বুঝলাম। তবে তুমি সেবাকাজে অনভিজ্ঞ।
দমন বলল, কেন? সেবাকাজে আমার অভিজ্ঞতা নেই বলছো কেন?
করট একটু হেসে বলল, অসময়ে তুমি মনিবের কাছে গেলে তিনি তোমাকে গালাগালি করবেন।
দমন রাগত গলায় বলে ওঠে, তা করুক। তবুও আমি মনিবের কাছে যাব। এটা আমার কর্তব্য। তুমি যাই বল না কেন ভাই আমি মনিবের কাছে যাবই।
করট বলল, তা গিয়ে কি বললে শুনি?
কি আর বলব? তবে প্রথমে দেখব মনিব আমার উপর বিরক্ত না অনুরক্ত।
কি করে বুঝবে? আমাকে ভাই একটু বুঝিয়ে বল না।
দমন বলল, সহজেই বোঝা যায়। দূর থেকে দেখে হেসে কুশল জিজ্ঞাসা করা, আদর প্রকাশ করা, অসাক্ষাতে গুণের প্রশংসা করা, তার সেবকদের প্রতি হৃদয়ের টান দেখানো, দান করা, সন্তোষ বর্ধন করা, দোষ করলেও গুণ গ্রহণ করা—এগুলোই হচ্ছে ভৃত্যের প্রতি অনুরক্তির লক্ষণ। আর কালক্ষেপণ করা, আশা বাড়িয়ে দেওয়া, প্রাপ্য বস্তু না দেওয়া, বুদ্ধিমান মানুষ এগুলি বিরক্তির চিহ্ন বলেই ধরে নেন।
করট এই কথাগুলো শোনার পর বলল, তবুও প্রসঙ্গ উত্থাপন না করলে তোমার কিছু বলা উচিত নয়। প্রসঙ্গ উঠলেই তোমার বলা উচিত।
দমন বলল-—না না, সে ব্যাপারে তোমার কোনো ভয় নেই। আমি কোনো অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলব না। উপযুক্ত সময়েও যদি মনিবকে কিছু বুদ্ধি না দিতে পারি তাহলে মন্ত্রিপদে থাকার কি প্রয়োজন? তা এখন আমি যাচ্ছি ভাই।
করট কি আর করবে, এত বলেও বন্ধুকে থামাতে পারল না। তাই বলল, ঠিক আছে, যাও । তবে আমার মতে না যাওয়াই তোমার ভাল ছিল।
দমন তো সিংহরাজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওকে দেখে সিংহ বেশ খুশিই হল। বলল, আরে দমন যে, কি খবর? কি মনে করে? এসো, এসো।
দমন কিন্তু কিন্তু করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্য এসেছি। যদিও আমি ভৃত্য, আমার মতো ভূত্যের আপনার প্রয়োজন নেই। তবুও ভাবছি আপনার বিপদের সময় আমার আসা উচিত। এ আমার কর্তব্য।
এই শুনে সিংহ বলল, হুম, আমিও ভাবছিলাম বহুদিন আসনি। নিশচয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা নিয়ে এসেছ। তা হলে বল তোমার কি কথা, নিৰ্ভয়ে বল।
দমন বলল, দেখলাম আপনি জল খেতে হ্রদে গিয়ে জল না খেয়েই দৌড়ে এসেছেন। তারপর থেকে লুকিয়ে আছেন, তাই ভাবলাম হয়তো আপনি কোনো বিপদে পড়েছেন।
সিংহরাজ তখনও ভয়ে কাঁপছে। দমনের কথায় ওর ধড়ে প্রাণ এল ; বলল, তা তুমি ঠিকই ধরেছ তুমি হচ্ছ মন্ত্রিপুত্র আর একজন মন্ত্রীও বটে। তবে তোমাকে বলতে বাধা নেই, সত্যিই আমি ভয় পেয়েছি।
মনিবের কথায় দমন বলে ওঠে, সেকি! সত্যিই আপনি ভয় পেয়েছেন?
দমনের কথায় সিংহ বলে উঠল, না না, তুমি বুঝতে পারছ না; জল খেতে গিয়ে শুনলাম সেই প্রচণ্ড ভয়ঙ্কর গর্জন। যার গর্জন এমন সে নিশ্চয়ই খুব ভয়ঙ্কর কোনো জানোয়ার; মনে হয় তুমিও সেই গর্জন শুনেছ। ভাবছি এখান থেকে চলে যাব।
সিংহের কথা শুনে তো দমন মনে মনে হেসেই খুন। মনের হাসি চেপে বলল, শুনেছি। তবে আমার মনে হয় এভাবে চলে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। কারণটা আগে জানা দরকার। কারণ না জেনে কখনো ভয় পাওয়া উচিত নয়। আমি আর করট তাহলে কারণ জানার চেষ্টা করি?
সিংহ করটের কথা শুনে বলে ওঠে, করট? সে আবার কে? দমন বলল, সেকি আপনি জানেন না? করট হচ্ছে আপনার আর এক মন্ত্রী। একসঙ্গেই কাজ করি আমরা। আমি এখনই ওকে গিয়ে ডেকে আনছি। এই বলে দমন ছুটে গিয়ে করটকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে হাজির করল সিংহরাজের সামনে।
সিংহ ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, তা পারবে তোমরা কারণটা বার করতে?
দমন বলল, নিশ্চয়ই পারব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আর যদি না পারি তখন না হয় আমরা চলে যাব।
সিংহরাজ দমনের কথা শুনে খুব খুশি হল। বলল, তোমরা যদি কারণটা খুঁজে বার করতে পার, তা হলে তোমাদের পুরস্কার দেব। এই বলে সিংহ ওদের দুজনকেই আগাম কিছু বকশিশ দিয়ে বিদায় করল।
করট কিন্তু দমনের এই ব্যবহার মোটেই ভাল চোখে দেখল না। বলল, দমন, তুমি কি সত্যিই পারবে? পারবে কি পারবে না এটা আগের থেকে না জেনেই পারবে বলে চলে এলে! এটা কি ভাল কাজ হল? তা ছাড়া আগের থেকে এতগুলো পুরস্কার নেওয়া তোমার উচিত হয়নি।
দমন করটের কথা শুনে চুপ করে রইল। মনে মনে একটু হাসল। বলল, বন্ধু, অত ভাবছ কেন? তুমি শুধু চুপ করে বসে দেখ আমি কি কাণ্ড করছি। আমি সব পারব। কারণ, আমরা তো জানি ওটা একটা বলদের গর্জন। বলদ তো
আমরা খাই। কি বল, খাই না? বলদের গর্জন সিংহরাজ চেনেন না বলেই অত ভয় পেয়েছেন। তাই ভাবছেন সেটা না-জালি কত ভয়ঙ্কর হবে!
করট বন্ধু দমনের কথা শুনে বলল, তা তুমি বলে দিলে না কেন? বলে দিলেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যেত।
দমন বন্ধুর কথায় একচোট হেসে বলল, সত্যিই তুমি নিৰ্ঘাৎ বোকা। বলে যদি দিতাম তাহলে কি এতগুলো পুরস্কার পেতাম? কথায় আছে—মনিবকে কখনও প্রয়োজনবোধশূন্য করবে না, তাহলে দধি নামক বিড়ালের মত বিপদে পড়তে হবে।
করট মুখে বলল, দমন, তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান। তা এবার বল দধি বিড়ালের কি ঘটনা হয়েছিল।
দমন দধি বিড়ালের গল্প বলতে শুরু করল।
বোকা বানর
করট বলতে লাগল—মগধ দেশে এক জায়গায় শুভদত্ত নামে এক লোক বাস করত। সেখানে একদিন একটা ঘর তৈরি করতে করতে এক ছুতোরের ভীষণ খিদে পেয়ে গেল। তখন ছুতোর একটা লম্বা কাঠ করাত দিয়ে অর্ধেকটা চিরে সেই চেরা জায়গায় একটা কাঠের খিল লাগিয়ে খেতে চলে গেল। ভাবল খেয়ে এসেই বাকি কাজটা শেষ করে ফেলবে।
এদিকে একদল বানর কোথা থেকে এসে হাজির হল সেখানে, ওরা চেরা কাঠটা নিয়ে মনের উল্লাসে হুটোপুটি করতে লাগল। এই রকম বাঁদরামি করতে করতে একটা বানর সেই চেরা জায়গায় বসে কাঠের খিলটা নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিল। এদিকে কাঠের খিলটা তো আলগাই ছিল। খিলটা ধরে টানাটানি করতেই ওটা খুলে গেল। ব্যাস আর যায় কোথায়! ওই বানরের লেজটা গিয়ে আটকে গেল চেরা কাঠের ফাঁকে। লেজ আটকে যাওয়ায় বানর তো ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। চিৎকার শুনে অন্য বানরগুলো ভয়ে পালিয়ে গেল ! একটা বানরও ওই বানরটার জন্য অপেক্ষা করল না। ছুতোর ফিরে এসে ওই লেজ আটকে পরা বানরকেই দেখতে পেল, বাকি বানরগুলোতো সব পালিয়ে গেছে।
ছুতোর মনের সুখে ওই বানরকে খুব পেটাল। ছুতোরের মার খেয়ে বেচারা ধরাশায়ী হয়ে পড়ে রইল।
এতখানি বলে করট দমনের দিকে মুখ তুলে বলল, এইজন্যই বলছি অন্যের কাজ কখনোই করা উচিত নয়। বানর অন্যের কাজ করতে গিয়েই তো এমন ৰিপদ ডেকে আনল।
তবু করট বলল, না না, আমাদের উচিত প্রভুর প্রতি নজর রাখা। যতই হোক, পশুরাজ তে আমাদের বন্ধু।
দমনের কথায় করট বলল, আমাদের নজর রাখার কোনো দরকার নেই।
মণিবের প্রতি সব নজর রাখবে প্রধানমন্ত্রী। ওর উপরেই সব ভার দেওয়া আছে। এখানে আমাদের করার কিছুই নেই। তা ছাড়া আমরা হচ্ছি আদার ব্যাপারী, আমাদের জাহাজের খবর রাখার দরকার কি? যে মনিবের উপকারের মতো পরের কর্তব্য করতে যায় সে হচ্ছে সেই গাধা, যে চিৎকারের জন্য পিটুনি খেয়েছিল এবং সেই গাধার মতোই তাকেও দুঃখভোগ করতে হয়।
করটের কথায় দমন বলল, সে কি রকম শুনি? গাধা কি এমন কাজ করেছিল যার জন্য তাকে মার খেতে হয়েছিল? করট তখন বলল, ঠিক আছে, তা হলে মন দিয়ে শোন--
বলদ ও সিংহ
গুরুদেব বিষ্ণুশর্ম রাজপুত্রদের একদিন নানান প্রশ্ন করলেন। রাজপুত্ররা তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিল। গুরুদেব খুশি হয়ে বললেন, আজ থেকে তোমাদের আমি প্রথম মিত্রভেদের গল্প শোনাতে শুরু করব। কি করে একটা বলদ ও সিংহের বন্ধুত্ব লোভী ও পাজি শেয়াল নষ্ট করেছিলো তার গল্প।
এই কথা শুনে রাজপুত্ররা আনন্দে বলে উঠল--কি করে অমন কাজ হয়েছিল গুরুদেব?
বিষ্ণুশৰ্মা বললেন--তা হলে তোমরা আমার গল্প মন দিয়ে শোন।
দক্ষিণদেশে সুবর্ণ নামে এক রাজ্য ছিল। সেখানে বর্ধমান নামে এক ধনী ব্যক্তি বাস করত। সেই লোকের প্রচুর টাকাপয়সা ধনরত্ন ছিল। এত ধনদৌলত থাকা সত্ত্বেও তার মনে শান্তি ছিল না। তার সবসময় মনে হতো তার থেকে ওর অন্যসব বন্ধুরা বেশি ধনী। এইজন্য নিজে সবসময় হীনম্মন্যতায় ভুগত। তার মন সবসময় অশান্তিতে ভরে থাকত। কথায় আছে, নিচের দিকে তাকাও, নিচের থেকে আরও নিচে দেখলে মনে শান্তি পাওয়া যায়। আর উপর দিকে তাকালে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। নিজেকে মনে হয় খুব তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র। লোকটি নিচের দিকে না তাকিয়ে শুধু উপরের দিকেই তাকাত। তাই ও সবসময়ই নিজেকে তুচ্ছ মনে করত, ভাবত ওর চেয়ে উপরের মানুষেরাই বেশি সুখী ! যার প্রচুর অর্থ আছে সে যদি খুনীও হয় তাহলেও সকলে তাকেই মান্য করে, আর যার ধনদৌলত নেই, সে যদি সদ্বংশেও জন্মায়, তবু তাকে শুধু অপমানিত হতে হয়। এসব ভেবে ভেবে সে মনে মনে ঠিক করল অলসের মতো বসে থেকে কাজ নেই, তার থেকে কিছু একটা করা ভাল। কারণ শাস্ত্রে আছে--আলস্য, স্ত্রীর বশীভূত হওয়া, রোগী, ঘরকুনো হওয়া, আত্মতুষ্টি এবং ভীরুতা-এই ছয়টি দোষ মানুষের উন্নতির বাধাস্বরূপ। তা ছাড়া--যা পাওয়ার অসাধ্য তাকে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা উচিত, যা পাওয়া গেছে তা রক্ষা করা উচিত। আর সেই রক্ষিত জিনিসকে বাড়াতে হবে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বস্তু দান করতে হবে। এতসব চিন্তাভাবনা করে সে একটা গরুর গাড়ি কিনল ও তাতে প্রচুর জিনিসপত্র ভর্তি করে নন্দ ও সঞ্জীৰ নামে দুটি বলদকে জুড়ে নিয়ে চলল বিদেশে বাণিজ্য করতে। তখনকার দিনে তো এখনকার মতো পথঘাট ছিল না, কোথাও যেতে হলে বনবাদাড় ভেঙেই যেতে হতো। বনজঙ্গল সব ভেঙেই সে চলল বিদেশে। একদিন সে বিশাল এক বনে এসে পড়ল। এই বনটা পার হলেই একটা বড় রাজ্য। লোকটি ঠিক করল, এই বন পেরিয়ে ওই রাজ্যেই গিয়ে বাণিজ্য করবে।
সে খুব তাড়াহুড়ো করে বনটা পার হতে চাইল। কিন্তু পারল না। হঠাৎ সঞ্জীব বলদটার পা ভেঙে গেল। লোকটি মনে মনে খুব চটে গেল! এখন কি করবে? হঠাৎ ওর মনে হল এভাবে বোকা হয়ে বসে থেকে লাভ নেই। কথায় আছে---সব কাজের বাধা হচ্ছে এই হতভম্ব হওয়া। একে সবার আগে ত্যাগ করা উচিত। তাই সে এভাবে বসে না থেকে নিজের স্বার্থের কথাই সবার আগে ভাবল। এই ভেবে সে গাড়ি থেকে নেমে অন্য একটা গ্রাম থেকে নতুন বলদ কিনে এনে গাড়িতে জুড়ে দিল। আর সঞ্জীবকে পা-ভাঙা অবস্থায় বনের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেল!
বলদ বনের মধ্যে দিশেহারা। কি করবে বেচারা। একটি পা ভাঙা। তাই তিনপায়েই কোনোমতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে লাগল। কখন যে বাঘ সিংহ বেরিয়ে খেয়ে ফেলবে কে জানে। কোনমতে রাতটা কেটে গেল। এভাবে বেশ কয়েকট দিন কেটে গেল। একদিন ও সুস্থ হয়ে উঠল। প্রাণে যে মৃত্যুভয় ছিল সেটাও দূর হয়ে গেল। কথায়ই তো বলে—সমুদ্রে ডুবে গেলে, পাহাড় থেকে পড়ে গেলে, সাপে কামড়ালে, যদি আয়ু থাকে তবেই সে জীবন রক্ষা করতে পারে। আর যার কেউ নেই, তাকে সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করে। সৃষ্টিকর্তা রক্ষা না করলে মানুষও বিনাশ হয়। বনে পরিত্যক্ত অনাথও বেঁচে থাকে। অথচ গৃহে সুরক্ষিত মানুষও জীবিত থাকে না।
এখানে বলদটাকে সৃষ্টিকর্তাই বাঁচাল। ও শুধু প্রাণেই বাঁচল না, খেয়েদেয়ে সুস্থ ও সবল হয়ে উঠল। হাম্বা হাম্বা করে চিৎকার করতে লাগল। ওর ডাক শুনলে মনে হয় যেন মেঘ গৰ্জন করছে।
সেই বনের পশুরাজ হচ্ছে এক সিংহ। বনের অন্য সব পশুরা তাকে ভীষণ ভয় পায়। সিংহ পাত্রমিত্র সভাসদ নিয়ে মনের সুখে রাজত্ব করত।
একদিন পশুরাজ এক জলাশয়ে জল খেতে গেল। সেখানেই বলদটা ছিল। কেউ কাউকে দেখতে পেল না। পশুরাজ তো জলে নেমে সবে মুখ ডুবিয়ে জল খেতে যাবে ঠিক তখনই বলদ হাম্বা হাস্কা করে গর্জন করে উঠল। এই অচেনা হাম্বা ডাক শুনে সিংহ ভয়ে জল ছেড়ে এক লাফে তীরে উঠে এল। তারপর দে ছুট। সোজা দৌড়ে নিজের গুহায় ফিরে হাঁফাতে লাগল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল—এ আবার কি জন্তু? একে তো কোনোদিন দেখিনি! কি অদ্ভুতভাবে গর্জন করছে!
সিংহ যে এত ভয় পেয়েছে এটা শুধু টের পেল দুই মন্ত্ৰী। দমন ও করট নামে দুটো শেয়াল। সিংহ রাজা যে ভয়ে লুকিয়েছে তা ওরা লক্ষ করেছে। তাই দমন করটকে বলল; বল তো সিংহ কেন লুকিয়ে আছেন?
করট বলল, এসবে আমাদের কি দরকার? আমরা তো শুধু চাকর। শুধু ওর কাছে অবজ্ঞা পাই। কথায় আছে—অর্থের জন্য ভৃত্যরা কি না করে, নিজের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। ভূত্য ছাড়া আর কে আছে যে উন্নতির জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দেয়-মনিবের জন্য সুখের চেয়ে দুঃখ বরণ করে? তা ছাড়া আরও আছে—যেমন প্রভুর সামনে ভৃত্য নীরব থাকলে সে মূর্খ। বেশি কথা বললে বাতুলতা, সহনশীল হলে ভীরু। অসহিষ্ণু হলে সদ্বংশ জাত নয়। সবসময় কাছে থাকলে ধৃষ্ট, আর দূরে গেলে অযোগ্য তা হলে দেখ সেবাদর্শ বড় জটিল। জ্ঞানীরাও বুঝতে পারেন না। অথচ ভৃত্যর সেবাপরায়ণ না হলে প্রভুর চামর দুলত না।
করট ফের বলল, তাই বলছি, কি দরকার আমাদের এই ব্যাপারে মাথা গলানোর। যে পরচর্চা করতে যায় সে কলীক উৎপাটনকারী বানরের মতোই নষ্ট হয়।
দমন করটের কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বলল, কি রকম? কি রকম শুনি?
গল্প শুরুর গল্প
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। সেই সময় ‘মহিলারোপ্য’ নামে দক্ষিণ ভারতে এক রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের রাজা অমরশক্তি ছিলেন বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। তিনি যে শুধু গুণী ছিলেন তা নয়, গুণীদের কদরও করতে জানতেন তিনি। তার রাজ্যে বিদ্বান, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী-গুণীর কোনো অভাব ছিল না।
একদিন রাজা তার রাজসভায় পাত্ৰ-মিত্র, মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বসে ছিলেন। কিন্তু রাজা বসে ছিলেন বিষন্ন মুখে।
রাজার মলিন মুখ দেখে প্রধানমন্ত্ৰী জিজ্ঞাসা করলেন, মহারাজ! আপনাকে আজ চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? আপনার কি অসুখ করেছে? তা হলে বিশ্রাম নিন।
মন্ত্রীর কথা শুনে মৃদু হেসে মহারাজ বললেন, মন্ত্রিবর! আপনার কথা সত্য। কিন্তু আমি শারীরিক সুস্থ থাকলেও মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ নই।
একথা শুনে মন্ত্রী আবার বললেন, মহারাজ! আমি কি তা হলে একবার রাজবৈদ্যকে খবর দেব?
স্নান হাসি ফুটে উঠলো রাজার মুখে। তিনি বললেন, দেখুন, রাজবৈদ্যের সাধ্য নেই আমার এ রোগ সারায় ।
মহারাজ! আপনার এমন কি রোগ হল যে, রাজবৈদ্য পর্যন্ত সে রোগ সারাতে পারবে না?
একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজা বললেন, আপনারা আমার হিতৈষী ও সুযোগ্য মন্ত্রী। আমার রাজ্যে বিদ্যান, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ব্যক্তির অভাব নেই, কিন্তু তবুও আমি দুঃখী—কারণ কি জানেন?
কি কারণ? -
আমার তিনটি মূৰ্খ ছেলেই তার জন্য দায়ী। আমার রাজকার্য প্রজাপালন, ঘর-সংসার সবই অসার মনে হয়, যখনই ভাবি আমার তিনটি ছেলেই আকাট মূর্খ।
রাজার এই আক্ষেপপূর্ণ উক্তি শুনে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। পরে শান্ত স্বরে বললেন, মহারাজ! আপনি ঠিকই বলেছেন। মূর্খ পুত্রের চেয়ে অপুত্রক হওয়া অনেক ভালো। যেমন করেই হোক রাজপুত্রদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
একথা শুনে রাজা হতাশ কণ্ঠে বললেন, মন্ত্রিবর! আমার রাজ্যের পাঁচশ বেতনভোগী পণ্ডিত যখন তাদের শিক্ষিত করে তুলতে সক্ষম হলেন না, তখন আর কি করে তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে? মন্ত্রিবর! আপনার কি তেমন কোনো নীতিশাস্ত্রবিদ পণ্ডিত ব্যক্তির সাথে পরিচয় আছে?
আছে মহারাজ।
কে তিনি?
বিষ্ণুশৰ্মা নামে এক ভারতবিখ্যাত নীতিশাস্ত্রবিদ পণ্ডিত আছেন। আপনি যদি অনুমতি করেন তবে তার কাছে দূত প্রেরণ করতে পারি।
বেশ, তাই করুন ।
মন্ত্রী তখনই নীতিশাস্ত্রবিদ বিষ্ণুশৰ্মার কাছে দূত প্রেরণ করলেন।
এই ঘটনার আরও কিছুদিন পর।
একদিন মহারাজ অমরশক্তি তাঁর রাজ্যের সভ্যসদ ও সন্ত্রীদের নিয়ে সভায় বসে আছেন। এমন সময় এক সৌম্যদেহী বৃদ্ধ এসে রাজার সামনে উপস্থিত হলেন।
মহারাজ অশীতিপর সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণকে দেখে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-মহাশয়ের পরিচয়?
আমাকে লোকে বিষ্ণুশৰ্মা বলে ডাকে।
শুনে রাজা আনন্দিত ও চমৎকৃত হলেন। বললেন, আপনিই পণ্ডিত বিষ্ণুশৰ্মা? আসুন, আসন গ্রহণ করে আমার রাজসভাকে কৃতাৰ্থ করুন।
মহারাজ অমরশক্তির এই বিনয় ও সাদর আমন্ত্রণে মুগ্ধ হলেন বিষ্ণুশৰ্মা। তারপর আসন গ্রহণ করে বললেন, মহারাজ! আপনার সুনাম অনেক শুনেছি।
এখন নিজের চোখে দেখে তার সঠিক পরিচয় পেলাম। এখন বলুন আমাকে আপনার কি প্রয়োজন।
মহারাজ বললেন, দেখুন, আপনার পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের খ্যাতি সুবিদিত। আমি আপনার কাছে একটি আবেদন পেশ করতে চাই। আমার তিনটি মহামূর্খ সন্তান আছে; আজ পর্যন্ত কেউ তাদের শিক্ষিত করে তুলতে সমর্থ হয়নি। আমার অনুরোধ, আপনি তাদের শিক্ষার ভার গ্রহণ করুন। বিনিময় পারিশ্রমিক হিসাবে আমি আপনাকে একশত গ্রাম দান করব।
একথা শুনে শান্ত স্বরে বিষ্ণুশৰ্মা বললেন, মহারাজ! আমি শিক্ষা দান করি, বিক্রি করি না। তা ছাড়া আমার বয়স এখন আশি পেরিয়েছে। বিষয়আশয় নিয়ে আমি কি করব?
বেশ তো, আপনি আপনার মত ও পথকে সামনে রেখে আমার পুত্রদের শিক্ষাদান করুন—আপনার কাছে আমার এই অনুরোধ।
মহারাজ! আপনার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ ; আমি আপনার অনুরোধ রক্ষা করলাম ; আজ থেকে আপনার তিন পুত্রের শিক্ষার ভাৱ আমি নিলাম।
মহারাজ অত্যন্ত প্রীত হয়ে বললেন, আপনি আমার পুত্রদের শিক্ষার ভার গ্রহণ করে আমায় এক চরম দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্তি দিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবার আমার ছেলেদের মূর্খ বদনাম ঘুচবে।
একথা শুনে বিষ্ণুশৰ্মা এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে বসলেন-মহারাজ ! আমি এই রাজসভায় সমস্ত সভাসদদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করছি—যদি আমি ছ মাসের মধ্যে আপনার পুত্রদের বিদ্যান করে তুলতে না পারি তাহলে নরকবাসী হব।
বিষ্ণুশৰ্মার এ প্রতিজ্ঞা শুনে সভাসদদের মধ্যে কেউ খুশি হলেন, আবার কেউ কেউ একে অসম্ভব বলে ভ্রু কোচকালেন।
বিষ্ণুশৰ্মা কিন্তু তার প্রতিজ্ঞা পালনে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি (১) মিত্রভেদ (২) মিত্রপ্রাপ্তি (৩) কাকোলুকীয় (৪) লব্ধ-প্রণাশ ও (৫) অপরিক্ষিতকারক নামে পাঁচটি উপদেশমূলক গ্রন্থ রচনা করে ছ’মাসের ভিতর অমরশক্তির তিন পুত্রকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন।
বিষ্ণুশৰ্মার নীতিশাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থগুলোর সার কথা ছিল নিম্নরূপ -
১. মিত্রভেদঃ এই অংশে পণ্ডিত বিষ্ণুশৰ্মা দেখিয়েছেন সব বন্ধু সমান নয়, কেউ ভাল আর কেউ মন্দ। কে ভাল আর কে মন্দ তা কেমন করে চেনা যাবে সেইসব উপদেশ নিয়েই এই অংশ ।
২. মিত্রপ্রাপ্তিঃ এই অংশে আছে কেমন করে প্রকৃত বন্ধুলাভ করা যাবে তার কথা ;
৩. কাকোলুকীয়ঃ এখানে আছে এক দুষ্টুস্বভাব কাকের গল্প। রূপক অর্থে বর্ণিত এই গল্পগুলোতে দেখানো হয়েছে কেমন করে দুষ্ট্র লোকেরা কুমন্ত্রণ দিয়ে দুই সরল বিশ্বাসী বন্ধুর মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে সর্বনাশ ঘটাতে পারে। এ ধরনের বন্ধু থেকে সাবধান থাকতে হবে।
৪. লব্ধপ্রণাশঃ এই অংশে বন্ধু ও বৈষয়িক ব্যাপারে লাভ ও অলাভের কাহিনী রয়েছে। কোন কাজে কি লাভ কিংবা ক্ষতি হবে তারই প্রেক্ষিতে সাজানো হয়েছে গল্পগুলো।
৫. অপরিক্ষিতকারকঃ আমরা অনেক সময় কোনোরকম অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করেই ঝোকের মাথায় কাজ করে বসি। তার পরিণাম হয় খারাপ। বিষ্ণুশর্ম এই তত্ত্বকেই অপরিক্ষিতকারক অংশে দেখিয়েছেন। রাজপুত্রদের বিষয়গুলো তিনি বুঝিয়েছেন গল্পের ছলে।
🔴 পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো একটি আর একটি গল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে প্রথম থেকে না পড়লে কিছুই বোঝা যাবে না। গল্পগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ুন ।।
COMMENTS