অগ্নিপুরুষ ২য় খন্ড (পর্ব ৭ – ৮) কাজী আনোয়ার হোসেন (মাসুদ রানা)

উঁহু, ইউনিয়ন কর্স হতেই পারে না, জোর দিয়ে বললেন বার্নাদো গুগুলি, প্যাথোলজিস্টের রিপোর্টের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন। ডেস্কের ওধারে একটা হাতলহীন চেয়ারে বসে র

অগ্নিপুরুষ ২ - কাজী আনোয়ার হোসেন

প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৮৬

অগ্নিপুরুষ ২ (মাসুদ রানা)  পর্ব ০৭.





উঁহু, ইউনিয়ন কর্স হতেই পারে না, জোর দিয়ে বললেন বার্নাদো গুগুলি, প্যাথোলজিস্টের রিপোর্টের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন। ডেস্কের ওধারে একটা হাতলহীন চেয়ারে বসে রয়েছে পাধানি।

এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে, স্যার? জানতে চাইল সে।

রিপোর্টের ওপর মধ্যমা দিয়ে টোকা দিলেন গুগলি। এ-ধরনের কল্পনাশক্তি ওদের নেই। ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। ছুরি, হ্যাঁ; শটগান, হ্যাঁ; রিভলভার, হ্যাঁ; বোমা, হ্যাঁ–কিন্তু রেকটামে নয়। এদিকে-ওদিকে মাথা নাড়লেন তিনি। এ বুদ্ধি সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের মাথা থেকে বেরিয়েছে।

ফনটেলার লাশ পাওয়ার পর দুদিন পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন ওপরমহল। থেকে চাপ আসছে তার ওপর, রহস্যের মীমাংসা কর। কাগজগুলো পুলিস আর কারাবিনিয়ারের অযোগ্যতা নিয়ে যা তা লিখছে। ফনটেলার হত্যাকাণ্ড এমন। ফলাও করে ছাপা হয়েছে, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

ফ্রেঞ্চ পুলিস অফিসার দ্য জিলাম্বুর সঙ্গে টেলিফোনে আবার আলাপ করেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে দ্য জিলাম্বু জানিয়েছেন, ইটালিতে যে হত্যাকাণ্ড ঘটছে তার সঙ্গে ইউনিয়ন কর্স জড়িত নয়, অন্তত সে-ধরনের কোন তথ্য তাঁর জানা নেই। মার্সেলেসের ইউনিয়ন কর্স গ্রুপ পুলিস এবং ডন বাকালার প্রতিনিধি বোরিগিয়ানোকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে, খুনগুলোর সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।

ইটালির মাফিয়া পরিবারগুলোর মধ্যে দাবাগ্নির মত ছড়িয়ে পড়ছে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। যাকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখা যায় না, সেই ডন বাকালা। নাকি টেবিলে ঘুসি মেরে তার উপদেষ্টাদের ঘাবড়ে দিয়েছে। দুই দশকের অটুট, নিস্তরঙ্গ শান্তিময় পরিবেশ নষ্ট করছে কেউ একজন। কে সে?

আর আশা করা হচ্ছে, ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী কর্নেল গুগলি, সবার আগে এই প্রশ্নের উত্তর যোগাতে পারবেন। দুদিন ধরে অফিস থেকে বলতে গেলে বেরই। হননি তিনি। বের হবার জরুরি কোন প্রয়োজনও অবশ্য দেখা দেয়নি–অভিনেত্রীর। সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।

সব কিছুর একটা সীমা আছে, মেয়েটা বলেছে তাঁকে। এরই মধ্যে প্রায়। প্রতিষ্ঠিত নায়িকা সে, তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই আশাবাদী, তার সৌন্দর্যের গুণগানে সবাই পঞ্চমুখ। এ-ধরনের বাধা আমার জন্যে অবমাননাকর, জানিয়ে দিয়েছে সে।

কাজেই গুগলি এখন কাজে মন বসাতে পারছেন। যারা খুন হয়েছে, আরও একবার করে তাদের প্রত্যেকের ফাইল পড়লেন তিনি। অগাস্টিন, বারুন, এলি আর ফনটেলা। মোট চারজন। যোগফল থেকে বারুনকে বাদ দিতেই যোগাযযাগটা কিসের সঙ্গে, ধরে ফেললেন তিনি। বোকামির জন্যে তিরস্কার। করলেন নিজেকে-বারুনের হত্যাকাণ্ড স্রেফ একটা দুর্ঘটনা, বা বাধা অপসারণ। মাত্র। সে এলিকে পাহারা দিচ্ছিল।

লুবনা কিডন্যাপিং!

তার সাথে এর কি সম্পর্ক? চোখে প্রশ্ন আর বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল। পাধানি।

কিসের আবার, প্রতিশোধের! গুগলির ইচ্ছে হল আবিষ্কারের আনন্দে বগল বাজান। অগাস্টিন আর এলি এই কিডন্যাপিঙের সাথে ছিল। আয়োজনটা ছিল ফনটেলার।

পরবর্তী এক ঘন্টা ভীষণ ব্যস্ত থাকল ওরা। দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন গুগলি, আভান্তি পরিবার সরাসরি এ-সব খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না, তবে ভিটো আভান্তি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে থাকতে পারে। এরপর তিনি লুবনার বডিগার্ডের দিকে মনোযোগ দিলেন। প্রথম দিকে হাসান। তেমন কোন গুরুত্ব পেল না। লোকটা ছিল প্রিমিয়াম বডিগার্ড। বয়স খুব বেশি, তার ওপর অ্যালকোহলিক। কিন্তু ফোনে হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলার পর গুগলির পালস রেট বেড়ে গেল। সিনিয়র একজন সার্জেনের সঙ্গে কথা বললেন তিনি, ভাগ্যই বলতে হবে সে ভদ্রলোক তাঁর বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গুগলি জানলেন, আহত বডিগার্ড এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে যে হাসপাতালের সবাই রীতিমত অবাক হয়ে যায়। প্রায় মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাকে। লোকটা বেঁচে ওঠে শুধু প্রচণ্ড ইচ্ছেশক্তির জোরে। প্রাণধারণের তীব্র আকুতি ছাড়া ও-ধরনের গুরুতর জখম নিয়ে কারও পক্ষে বেঁচে ওঠা সম্ভব নয়। এরপর গুগলি ফোন করলেন এজেন্সিতে, এই এজেন্সিই, আভান্তি পরিবারে বডিগার্ডের কাজটা যুগিয়ে দিয়েছিল লোকটাকে। জানা গেল, বডিগার্ড এক সময় মার্সেনারি ছিল। জরুরি টেলেক্স পাঠানো হল প্যারিসে। ইন্টারপোল থেকে উত্তরের আশায় অপেক্ষা করছেন তিনি, ইতিমধ্যে খোঁজ নিয়ে বডিগার্ডের সঙ্গে জনৈক ভিটেলা রেমারিকের সম্পর্কের ব্যাপারটাও জানতে পারলেন। এই রেমারিক বডিগার্ডের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নেপলসে তার একটা বোডিং হাউস-কাম-রেস্তোরাঁ আছে, নাম প্রেজো ফিসো।

পদ, খ্যাতি আর যোগাযোগ, তিনেট অস্ত্রই কাজে লাগালেন গুগলি। চারদিক থেকে হুড়মুড় করে তার প্রশ্নের জবাব আসতে শুরু করল। রোম ইমিগ্রেশনের ডিরেক্টরকে সরাসরি ফোন করলেন তিনি, ডিপার্টমেন্টের কমপিউটর থেকে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করে ডিরেক্টর জানালেন, বডিগার্ড অমুক তারিখে মাল্টার উদ্দেশে ইটালি ত্যাগ করে।

তারমানে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার ছয় দিন পর। কিন্তু মাল্টা ছেড়ে আবার ইটালিতে ফিরে এসেছে কিনা, সে সম্পর্কে কোন তথ্য কমপিউটরে জমা নেই।

এরপর মাল্টায়, বন্ধু মেনিনোর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন গুগলি। মেনিনোর। সঙ্গেই রোমে ট্রেনিং শেষ করেছেন তিনি, দুই পুলিস অফিসারের মধ্যে খাতির আছে। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন গুগলি, চিন্তিতভাবে বললেন; অবাক কাণ্ড!

স্যার?

বডিগার্ডের মাল্টায় পৌঁছুনর সময়টা কনফার্ম করল মেনিনো, বলল তিন হপ্তা হল জাহাজে করে মার্সেলেসে চলে গেছে।

ব্যস, আর কিছু না?

না।

কিন্তু আপনি বললেন অবাক কাণ্ড …

গুগলি হাসলেন। মাল্টিজি পুলিস দক্ষ, ব্রিটিশদের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে ওরা। তাই বলে এতটা দক্ষ নয় যে প্রত্যেক টুরিস্ট সম্পর্কে খবর রাখবে– ওদের। ডাটা কমপিউটারাইজডও নয়। অথচ তথ্যগুলো মুখস্থ করা ছিল মেনিনোর, জিজ্ঞেস করতেই গড়গড় করে বলে ফেলল। মানেটা কি? মানে, বডিগার্ডের প্রতি ব্যক্তিগত ইন্টারেস্ট ছিল তার, বা এখনও আছে। তারপর, আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, লোকটা সম্পর্কে আর কিছু তুমি জান কিনা, উত্তরে কি বলল জান? বলল, বছরে পাঁচ লক্ষ লোক বেড়াতে আসে মাল্টায়, কজনের খবর রাখবে তারা! নিশ্চয়ই কিছু গোপন করছে সে। কি হতে পারে সেটা? কেনই বা গোপন করবে?

প্যারিস থেকে টেলেক্সের জবাব এল। তিন ফিট লম্বা কাগজের রোল পড়া শেষ করে গুগলি গম্ভীর হয়ে উঠলেন। বললেন, মানুষ নয়, এই হাসান একটা কিলিং মেশিন। ঘুণাক্ষরেও তিনি টের পেলেন না, এইমাত্র যার ডোশিয়ে পড়া শেষ করেছেন তিনি, সে মারা গেছে।

উঠে দাঁড়ালেন গুগলি। চল, কোমো থেকে একবার ঘুরে আসি। ভিটো। আভান্তির সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক আরও কিছু জানা যায় কিনা।

.

স্বামী-স্ত্রী ডিনারে বসেছে। টেবিলের এক প্রান্তে লরা। আগের চেয়ে রোগা হয়েছে লরা, তবে তার রূপ টসকায়নি। ভিটো আগের মতই আছে, কিছুই বদলায়নি। তার। মেয়ে মারা যাবার পর উপলব্ধি করেছে লরা, কি হারিয়েছে সে। কিন্তু মেয়ে মারা গেলেও, ভিটোর আরেকটা অবলম্বন আছে–স্ত্রী।

দরজা খোলার শব্দে ওরা দুজনই ঘাড় ফেরাল, ডেজাট নিয়ে আথিয়ার। ঢোকার কথা। দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে লুবনার সেই বডিগার্ডহাসান।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রানা, দুজনকে দেখছে। ওরাও তাকিয়ে আছে, চোখে ভাষাহীন বোবা দৃষ্টি।

প্রথমে সামলে উঠল ভিটো। কি চান আপনি? তীক্ষ্ণ সুরে জিজ্ঞেস করল সে,, ভাবটা যেন রানা এসে ভারি অন্যায় করে ফেলেছে।

এগিয়ে এসে একটা চেয়ার ধরল রানা, ঘুরিয়ে নিয়ে বসল তাতে, হাত দুটো থাকল চেয়ারের পিঠে। ভিটোর দিকে তাকাল ও। তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলব। তুমি যদি নড়ো বা বাধা দাও, সঙ্গে সঙ্গে খুন হয়ে যাবে। জ্যাকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভারি একটা পিস্তল বের করে টেবিলের ওপর রাখল ও। এতে গুলি ভরা আছে।

পিস্তলটা দেখে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল ভিটো। লরার দিকে তাকাল রানা। ওর চেহারা থেকে কঠিন ভাব একটু যেন শিথিল হল।

কেন আপনি কেন কি চান..? কোন প্রশ্নই পুরোটা উচ্চারণ করতে পারল না লরা। তার মনে পড়ল, এই লোককে প্রথম দিন দেখেই সে ভয় পেয়েছিল।

আপনাকে একটা গল্প বলব আমি, বলল রানা। নিজের মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কাহিনী। তারপর শুরু করল।

এসব ফনটেলার কাছ থেকে জেনেছে রানা। লুবনার কিডন্যাপিং প্রথম থেকেই ছিল একটা সাজানো ব্যাপার। ইলুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে টাকা আদায় করার একটা কূটকৌশল। লণ্ডনের লয়েডস-এর কাছ থেকে দুই বিলিয়ন লিরার একটা পলিসি কেনে ভিটো। চুক্তি ছিল, বীমা কোম্পানির কাছ থেকে টাকাটা পেয়ে অর্ধেক টাকা ভিটোকে ফেরত দেবে ফনটেলা। ভিটো আর ফনটেলার মাঝখানে। দালাল হিসেবে কাজ করে আলবারগোলোরান। অর্গানাইজড ক্রাইমের সঙ্গে তার যোগাযোগ বহুদিনের। তার স্বার্থ ছিল, এই টাকা থেকে কমিশন পাবে সে। গোটা ব্যাপারটা গড়গড় করে বলে গেল রানা, মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। শোনার সময়। রানার মুখ থেকে একবারও চোখ সরল না লরার। শুধু রানার কথা শেষ হবার পর। স্বামীর দিকে তাকাল সে। তার সমগ্র অস্তিত্ব থেকে যেন উথলে পড়ছে ঘৃণা। পিঠ বাকা করে আরও কুঁকড়ে গেল ভিটো। একবার মুখ খুলল, আবার সেটা বন্ধ করল। চোরের মত লাগছে তাকে। মাথা নিচু করে নিল সে, অন্য দিকে তাকাল।

বাকি সবাই? কাজটা যারা করেছিল? আপনিই কি ওদের খুন করেছেন?

মাথা ঝাঁকাল রানা। এ থেকে যারা লাভবান হয়েছে তাদের প্রত্যেককে আমি খুন করব।

ডাইনিংরূমে আবার নেমে এল নিস্তব্ধতা। অনেকক্ষণ পর কথা বলল লরা, অনেকটা আপন মনেই, ও আমাকে সান্ত্বনা দেয়। বলে পরস্পরের জন্যে আমরা তো এখনও আছি-কেটে যাচ্ছে দিন। পরমুহূর্তে যেন বাস্তবে ফিরে এল সে, কঠিন হয়ে উঠেছে দৃষ্টি, রানার দিকে তাকাল। আপনি বললেন ওদের সবাইকে?

টেবিল থেকে পিস্তলটা তুলে নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রানা। আমি ওকে খুন করতে এসেছি।

মুখ তুলে তাকাল ভিটো, রানার দিকে নয়, স্ত্রীর দিকে। ঘামে চকচক করছে তার মুখ। চোখ দুটো যেন অনন্তের দিকে মেলে দেয়া একজোড়া গরাদহীন জানালা।

পিস্তলটা সরিয়ে রাখল রানা, উঠে দাঁড়াল। ওকে আপনার হাতেই ছেড়ে দিলাম।

হ্যা! বোধহয় স্বস্তিতেই বিকৃত দেখাল লরার চেহারা, কাঁপা গলায় বলল, আমার হাতে ছেড়ে দিন–প্লীজ!

দরজার দিকে এগোল রানা, কিন্তু লরার কণ্ঠ বাধা দিল ওকে। লোরানের ব্যাপারে কি করছেন?

মাথা নাড়ল রানা। তার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রানা, ওর পিছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

.

লেকের পাশ দিয়ে চওড়া রাস্তা, বার্নাদো গুগলির গাড়ি ছুটে চলেছে কোমের দিকে। গুগলি ড্রাইভ করছেন, পাশে বসে আছে পাধানি। নীল রঙের একটা আলফেটা পাশ দিয়ে চলে গেল উল্টো দিকে।

.

পেন্ট হাউস অ্যাপার্টমেন্টে ডিনারে বসতে যাবে আলবারগোলোরান, ফোন এল। ভিটোর। লোরান রিসিভার তুলতেই চেঁচাতে শুরু করল ভিটো, কি বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

একটু অপেক্ষা কর, লোরান বলল তাকে। আমি আসছি।

ব্যস্ত হাতে জ্যাকেট পরল লোরান। স্ত্রীর চোখে বিস্ময় দেখে বলল, হঠাৎ একটা ঝামেলা দেখা দিয়েছে, ফিরতে দেরি হতে পারে তার।

বেসমেন্ট গ্যারেজে নেমে এল লোরান। মার্সিডিজে চড়ল। ইগনিশন কী ঘোরাতেই বিস্ফোরিত হল আধ কিলো বিস্ফোরক। হাড়-মাংস ছাতু হয়ে গেল আলাবারগো লোরানের।

.

খুই প্রভাবিত হলেন বার্নাদো গুগলি। আরাম করে চেয়ারে হেলান দিলেন তিনি, পরম তৃপ্তিতে একটা ঢেকুর তুললেন, দরাজ গলায় মন্তব্য করলেন, এমন স্বাদের। ফ্রিটো মিসটো জীবনে কখনও খাইনি–আই রিপিট–জীবনেও না।

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল রেমারিক। এ আর এমন কি, আমার মায়ের হাতের রান্না খেলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন।

আপনিও কি আমাকে পাগাল হতে বাকি রাখছেন? মুচকি হেসে বললেন গুগলি। একজন প্রাক্তন ক্রিমিন্যাল, প্রাক্তন কয়েদী, প্রাক্তন মার্সেনারি, তার রান্নার হাত এত ভাল হয় কি করে? আচ্ছা, আপনি ব্যাকগ্যামন খেলেন না, না? নাকি তাও খেলেন?

বিমূঢ় দেখাল রেমারিককে। খেলি, কিন্তু ব্যাকগ্যামনের সাথে কিসের কি সম্পর্ক?

রহস্যময় হাসি দেখা গেল কর্নেলের ঠোঁটে। সম্পর্ক আমার সাথে। এখানে সময়টা আমার আনন্দেই কাটরে বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু আমি তো আপনাকে বলেছি, বোর্ডিং বন্ধ হয়ে গেছে–আপনি কোন হোটেলে উঠুন।

কথা না বলে শ্যাম্পেনের গ্লাসে ধীরেসুস্থে চুমুক দিলেন গুগলি। অনেকক্ষণ পর যখন মুখ খুললেন, তার গলা গম্ভীর, পরিস্থিতির গুরুত্ব কেউ যদি বোঝে তো সে আপনি। খুনগুলো কে করছে ডন বাকালা এখন তা জানে। খবর পাবার। সুযোগ-সুবিধে আমার চেয়ে খারাপ নয় তার। আপনি হাসানের বন্ধু, এটা জানতে খুব বেশি সময় লাগবে না ওদের। আপনই বলুন, তখন কি হবে?

রেমারিক চুপ করে থাকল।

মাফিয়ানদের সম্পর্কে আমি আর আপনাকে নতুন করে কি বলব, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গুগলি। কয়েকজন টাফ লোককে পাঠাবে ওরা। আপনাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, কিংবা এখানেই মেরে রেখে যেতে পারে–মারার আগে। হাসান সম্পর্কে সব আপনার কাছ থেকে জেনে নেবে ওরা।

কাধ ঝাঁকিয়ে রেমারিক বলল, নিজেকে কিভাবে রক্ষা করতে হয় আমি জানি। তবে কর্নেলের যুক্তিটা অস্বীকার করতে পারল না সে। মাত্র ঘন্টা খানেক আগে ফোন করেছিল রিসো। তার অফিসে সুবেশী দুজন লোক এসেছিল, জানতে চায় হাসানের সঙ্গে রিসোর কি সম্পর্ক, কেন রিসো হাসানের ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল। রিসোর সুপারিশেই এজেন্সি থেকে আভান্তি পরিবারে বডিগার্ডের চাকরির জন্যে পাঠানো হয়েছিল হাসানকে। লোক দুজন রিসোকে প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেয়। এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে, সেটা আন্দাজ করেছিল রেমারিক। তাই ভাইকে সে আগেই শিখিয়ে দিয়েছিল কি বলতে হবে। শেখানো কথাই লোক দুজনকে বলেছে রিসো, সে তার বড় ভাইর অনুরোধে সুপারিশ করেছিল।

কোন সন্দেহ নেই, ইতিমধ্যে রওনা হয়ে গেছে লোক দুজন, ঘন্টা কয়েকের মধ্যে টোকা পড়বে রেমারিকের দরজায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, কারাবিনিয়ারির একজন কর্নেল যদি থাকে এখানে, মাফিয়ানরা কেউ বোর্ডিং হাউসের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না। ঠিক আছে, এতই যখন জেদ করছেন, থেকে যান-খুলে দিচ্ছি একটা ঘর, বলল রেমারিক। কিন্তু বিছানায় ব্রেকফাস্ট পাবার আশা থাকলে ভুলে যান।

হাত নেড়ে অভয় দিলেন গুগলি। বিশ্বাস করুন, আমি কোন সমস্যাই নই। দেখবেন, আমার সাথে গল্প করে সময়টা আপনার ভালই কাটবে।

সারাদিন গাড়ি চালিয়ে মিলান থেকে আজ সন্ধের সময় এখানে পৌচেছেন। গুগলি। গাড়ি চালাতে পছন্দ করেন তিনি, কারণ চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ। মেলে। পথে পুরো হপ্তার ঘটনা এক-এক করে স্মরণ করেছেন তিনি। শুধু মুগ্ধ হননি, স্তম্ভিত হয়েছেন দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী একদল লোককে মাত্র একজন লোক কেমন আতঙ্কিত করে তুলেছে। লোকটার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসতে চেয়েছে। যদিও, মুহূর্তের জন্যেও ভোলেননি, তিনি একজন, পুলিস অফিসার, আইনের রক্ষক-অপরাধীকে ভক্তি করা তাকে মানায় না।

আভান্তি পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। সাক্ষাৎকারের ঘটনাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। স্মার্ট, সুদর্শন ভিটো আভান্তিকে চেনাই যাচ্ছিল না, কেউ যেন ছাই ঘষে দিয়েছে তার চেহারায়, আক্ষরিক অর্থেই কাপছিল লোকটা। তার স্ত্রী, লরা আভান্তি–সুন্দরী, কিন্তু বরফের মত ঠাণ্ডা।

প্রথমে ভিটো দেখা করতেই চায়নি। দেখা যা-ও বা করল, কথা বলতে চায়। তারপর একটু নরম হল, বলল, আমার আইন-উপদেষ্টা আসছেন, এলে কথা। বলব। এই সময় খবর এল ভিটোর আইন-উপদেষ্টা আলবারগো লোরান বোমা বিস্ফোরণে বেসমেন্ট গ্যারেজে মারা গেছে। আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল ভিটোর, মধ্যে। খবরটা শুনেই গুগলির গায়ে ঢলে পড়ল সে। হড়বড় করে যা বলল, তার অর্থ দাঁড়ায়, পুলিসই এখন তার মা-বাপ, তারাই তাঁকে রক্ষা করতে পারে। এরপর প্রশ্নের উত্তর পেতে কোন অসুবিধে হয়নি কর্নেলের। ভিটো নিজের বোকামি আর লোভের কথা অকপটে গড়গড় করে বলে গেল। গুগলির সবচেয়ে খারাপ লাগল, যখন দেখলেন, ভিটো তার কাছ থেকে সহানুভূতি পাবে বলে আশা করছে। যে। লোক নিজ মেয়েকে পুজি করে ব্যবসা করতে চায়, সুস্থ একজন মানুষ তাকে। সহানুভূতি জানায় কি করে!

ভিটো যা বলল, খস খস করে সব লিখে নিল পাধানি। বোবা হয়ে বসেছিল লরা, চোখ দুটো একবারও স্বামীর মুখ থেকে সরেনি। স্বামীর প্রতি মহিলার ঘৃণা। উপলব্ধি করে মনে মনে শিউরে উঠেছিলেন গুগলি।

ভিটোর সঙ্গে কথা বলে তার মস্ত একটা লাভ হয়েছে, তিনি আবিষ্কার করেছেন কিলিং মেশিন চারজনকে খুন করেই থামছে না, তার তালিকায় আতুনি। বেরলিংগার তো আছেই, আছে মোড়ল পরিবারের মাথা ডন বাকালাও। এই তথ্য, হতভম্ব করে দেয় কর্নেলকে। তার মনে হল, এ লোক কিলিং মেশিনও নয়, সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে পাঠানো মূর্তিমান অভিশাপ। তিনি ভেবেছিলেন, ফনটেলাকে খুন করার পর প্রতিশোধের আগুন নিভে যাবে। ধরে নিয়েছিলেন, ফনটেলাকে খুন করেই সীমান্তের দিকে খিচে দৌড় দিয়েছে বডিগার্ড, জান। বাঁচাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু না! এ লোক মূর্তিমান খোদার মার, আগে চিনতে পারেননি।

ভিটো আভান্তির বিরুদ্ধে আইনগত কি ব্যবস্থা নেয়া যায় সে-সম্পর্কে পাধানিকে পরামর্শ দিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়েছিলেন কর্নেল, নিরিবিলিতে বসে চিন্তা-ভাবনা করবেন বলে।

পরিস্থিতিটা তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে।

একদিকে, বডিগার্ড আঘাত হেনেছে মাফিয়ার ঠিক হার্টের ওপর–একেবারে গর্বমূলে। একটা মাত্র লোক। এভাবে যদি চালিয়ে যায় সে, মারতে পারে আতুনি বেরলিংগারকে, মাফিয়ানদের ভেতর এমন সব বিশৃংখলা দেখা দেবে যে আবার সব গুছিয়ে আনতে সময় লাগবে দশ বছর। আর যদি অকল্পনীয় ঘটনাটা ঘটে, বডিগার্ড যদি বাকালাকে খুন করতে পারে, স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়বে মাফিয়া চক্র। _ বেরলিংগার আর বাকালার সম্প্রীতি আসলে একটা প্রাচীর, মাফিয়া চক্রকে সম্ভাব্য সমস্ত বিপদ থেকে আড়াল করে রেখেছে। এই প্রাচীর ভেঙে পড়লে। দিকবিদিক ছুটোছুটি শুরু করবে মাফিয়ানরা, শুরু হয়ে যাবে মহা গোলমাল। সেই সুযোগে তিনি, গুগলি, অন্যান্য বসূদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগতে পারবেন। ফলে। দুই দশকের আগে মাফিয়ানরা কোনভাবেই আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ওদের সম্পর্কে তার কোন ভুল ধারণা নেই। এই দানবকে তিনি চিরকালের জন্যে ধ্বংস করতে পারবেন না। শুধু এর আকৃতি কেটেছেটে ছোট করতে পারবেন। সে সুযোগ একশো বছরে এক আধবার আসতে পারে, না-ও আসতে পারে। তার ভাগ্য, সেই দুর্লভ সুযোগটাই তাঁকে এনে দিয়েছে বডিগার্ড লোকটা।

আরেক দিকে, তার দায়িত্ব হল খুনীকে গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দেয়া, যে-কারণে বা যাকেই খুন করুক সে। সংকট তার বিবেককে নিয়ে খুদে একটা ইস্পাত মোড়া বাক্সে যতের সঙ্গে নিজের বিবেককে তালা দিন নাখতে পেরেছেন বলে গর্ব অনুভব করেন গুগলি।

সংকট ঔচিত্যবোধকে নিয়ে। তাঁর দর্শন হল, আইন অবশ্যই থাকতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে আইনকে বাঁকা করার সুযোগও থাকা চাই; আর শুধু আইনের রক্ষকদেরই থাকবে আইনকে বাঁকা করার অলিখিত অধিকার। কাজেই বডিগার্ড লোকটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে তার মনে। অপূর্ব একটা সুযোগ এনে দিয়েছে সে, কিন্তু সেই সঙ্গে কর্নেল গুগলির ঔচিত্যবোধের ওপর একটা আঘাত হেনেছে। প্রায়। সারারাত এই বোধের সঙ্গে মনে মনে কুস্তি লড়লেন তিনি, তারপর একটা সম্মানজনক আপসে পৌঁছুলেন। খুব সকালে তার বস, জেনারেলের কাছে ছুটে গেলেন তিনি। সব ঘটনা খুলে বললেন তাকে, নিজের সঙ্গে কিভাবে আপস করতে চান তা-ও ব্যাখ্যা করলেন। জেনারেল গুগলিকে বিশ্বাস করেন, তার ওপর আস্থার কোন অভাব নেই। দুজনে একমত হলেন, কেসটার পুরো দায়িত্বে শুধু গুগলিই থাকবেন। প্রেসকে কিছুই জানানো হবে না, যদিও, দুচারদিনের মধ্যেই গন্ধ শুকে সব কিছু জেনে যাবে তারা।

ঠিক হল, মিলানের কাজ সেরে রোমে চলে যাবে পাধানি, আতুনি বেরলিং গারের কাছাকাছি থাকবে। আর গুগলি আসবেন নেপলসে। নেপলসে রেমারিক রয়েছে, বডিগার্ডের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গুগলি আগেই সন্দেহ করেছেন, রহস্যের, অন্তত একটা চাবি এই রেমারিক, সম্ভবত প্রস্তুতির কাজে এই লোক বডিগার্ডকে সাহায্যও করেছে। নিদের্শ দেয়া হল, প্রেজো ফিসো বোর্ডিং হাউসের টেলিফোনে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করতে হবে, খুলে দেখতে হবে সমস্ত চিঠি-পত্র। গুগলি বডিগার্ড সম্পর্কে সব কিছু জানতে চান–তার যোগ্যতা, চরিত্র, আদর্শ, বাধন। শুধু রেমারিকই তার কৌতূহল মেটাতে পারে।

মিলান থেকে নেপলসে আসার জন্যে রওনা হলেন গুগলি, দুঘন্টা পর মিলান কারাবিয়ানরির রেকর্ড ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসার একটা কনফিডেনশিয়াল মেমোর কপি ফাইল বন্দি করল, কিন্তু তার আগে মেমোটা বার বার পড়ল, মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত থামল না। সন্ধের পর এক বন্ধুর সঙ্গে ডিনার খেল সে, সেই সঙ্গে টাকা ভর্তি একটা ভারি ব্যাগ হাতবদল হল। গুগলি যখন রেমারিকের রান্না করা ফ্রিটো মিসটোর স্বাদ আস্বাদন করছেন, রোমে বসে বেরলিংগার তখন ফোনে। গামবেরির কথা শুনছে, অবিশ্বাসে ছানাবড়া হয়ে উঠেছে তার চোখ। বলাই বাহুল্য, ফনটেলার অনুপস্থিতিতে গামবেরিই এখন মিলানের সর্বময় কর্তা।

গামবেরির তথ্যে কোন গলদ নেই, শুধু কর্নেল গুগলির মত সে-ও রানার আসল পরিচয় জানতে পারল না। ওকে তারা দুজনই মার্সেনারি হাসান বলে ভুল করছে। হাসানের অতীত ইতিহাস জানাবার সময় গামবেরিকে তেমন উৎকণ্ঠিত বলে মনে হল না। কারণ বডিগার্ডের মৃত্যু তালিকায় তার নাম নেই।

কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল বেরলিংগার, তারপর চিন্তা করতে বসল। খানিক পর বিশেষ একটা নাম্বারে ডায়াল করে পালার্মোর সঙ্গে যোগাযোগ করল সে, কথা বলল ডন বাকালার সঙ্গে। হত্যাকারীর পরিচয় সম্পর্কে একটা কথাও বলল না, জানে, ডন বাকালা তা ইতিমধ্যে জেনেছেন। পুলিস আর কারাবিনিয়ারি বলতে গেলে খুনীর বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশনই নিচ্ছে না। জেনারেল অ্যালার্ট পর্যন্ত ইস্যু করা হয়নি। কেসটার সমস্ত দায়িত্ব নাকি কর্নেল গুগলির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু কর্নেল মিলান ছেড়ে চলে গেছে আজ সকালে, কোথায়। গেছে কেউ জানে না। বোঝাই যাচ্ছে, এর সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। সবশেষে বেরলিংগার বলল, বেজন্মারা আমাদের দুরবস্থা দেখে খুশিতে বগল বাজাচ্ছে।

ডন বাকালার সঙ্গে কথা বলার পর বেরলিংগারকে আগের চেয়েও চিন্তিত দেখাল। কারণ, সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে, ডন বাকালা ভয় পেয়েছে। জোরাল। কোন আশ্বাস তো দিলই না, স্পষ্ট কোন নির্দেশও এল না। গডফাদারকে কেমন। যেন দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হল। উল্টো বেরলিংগারের কাছ থেকে পরামর্শ চাইল সে। বেরলিংগার অবশ্য কার্পণ্য করেনি, যথা সম্ভব অভয় দিয়েছে। পুলিসও যদি বডিগার্ডকে সাহায্য করে, মাফিয়ানদের হাত থেকে তবু তার নিস্তার নেই। পরিচয় যখন জানা গেছে, ঘন্টা কয়েকের মধ্যে খুঁজে বের করা হবে তাকে। অর্গানাইজেশনের প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এরই মধ্যে।

কিন্তু বেরলিংগার ভাবছে, ডন বাকালার প্রতিক্রিয়া এরকম হবে কেন! সন্দেহ নেই, খুনী ভয়ঙ্কর একটা হুমকি। একেবারে একা হয়েও এতগুলো লোককে খুন করে কেটে পড়া, তার অসাধারণ বুদ্ধি আর বিস্ময়কর যোগ্যতার পরিচয়ই বহন করে। কিন্তু তাই বলে ডন বাকালার মত একজন সম্রাট নিঃসঙ্গ একজন খুনীকে ভয় পাবে কেন? বেরলিংগার ধারণা করল, বাকালার এই প্রতিক্রিয়া আসলে একজন রাজনীতিকের প্রতিক্রিয়া। সে নিজে এই সম্মানজনক অবস্থায় পৌচেছে খুন-খারাবির সাহায্যে। প্রচুর মৃত্যু দেখেছে সে। কিন্তু ডন বাকালার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা, সে উঠেছে কূটনীতির সাহায্যে। খুন-খারাবির নির্দেশ দিয়েছে বটে, কিন্তু নিজের হাতে কখনও রক্ত লাগতে দেয়নি। আমি যদি একজন সৈনিক আর জেনারেল হই, ভাবল বেরলিংগার, বাকালা তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান। বাকালার ভয়। পাবার আরও একটা কারণ খুঁজে পেল সে এই প্রথম কেউ তার জন্যে হুমকি হয়ে। দেখা দিল। এর আগে সরাসরি কেউ তাকে খুন করবে বলে ভয় দেখায়নি। হয়ত এ-লাইনে অভিজ্ঞতার অভাবই ডন বাকালাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

গোটা ব্যাপারটার মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা দেখতে পেল বেরলিংগার। ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার, আর নজর রাখা দরকার এরপর কি ঘটে। সবশেষে, বিছানায় যাবার আগে, নিজের ব্যক্তগত নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দিল সে। এই দশ তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের সে-ই মালিক, পেন্টহাউসে থাকে সে। বেসমেন্ট গ্যারেজ থেকে টপ ফ্লোর পর্যন্ত সিকিউরিটির ব্যবস্থা আরও কড়া, আরও নিচ্ছিদ্র করতে হবে, গার্ডদের অগোচরে একটা পিঁপড়েও যেন ঢুকতে না পারে। একই নির্দেশ দেয়া হল তার অফিসের বেলায়, সে বিল্ডিংটাও তার নিজস্ব।

এক বিল্ডিং থেকে আর এক বিল্ডিঙে আসা-যাওয়ার ব্যাপারে কোন দুশ্চিন্তা নেই। তার একটা বিস্ময়কর ক্যাডিলাক আছে। তিন ইঞ্চি পুরু আর্মার প্লেটিং, বুলেটপ্রুফ জানালা। এই গাড়িটাকে নিয়ে বেরলিংগারের গর্বের অন্ত নেই। গত কবছরে দুবার তার গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়, একবার হেভী ক্যালিবার পিস্তল দিয়ে, আরেকবার সাবমেশিনগান দিয়ে। দুবারই গাড়িতে ছিল সে, কিন্তু তার গায়ে আঁচুড়টিও লাগেনি। তবু, নতুন একটা নির্দেশ জারি করল সে। এখন থেকে গাড়ি ভর্তি বডিগার্ড ক্যাডিলাকের পিছু নেবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও খাবে না সে। জানে, যত মাফিয়ান বস্ মারা যায় তাদের। বেশিরভাগই মরে রেস্তোরাঁয়–কিন্তু ফুড পয়জনিঙে নয়।

.

সত্যি ভয় পেয়েছে ডন বাকালা। এ তার কাছে সম্পূর্ণ এক নতুন অনুভূতি। দুর্ধর্ষ একজন খুনী তাকে খুন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই চিন্তাটাই তাকে অসুস্থ করে তুলেছে।

বেরলিংগার অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু তবু খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না বাকালা। প্যানেল লাগানো স্টাডিতে ডেস্কের পিছনে বসে আছে সে, কেমন যেন ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে তার। কাগজ-কলম টেনে নিয়ে লিখতে বসল, ভিলা কোলাসির নিরাপত্তার জন্যে জরুরি ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। ভিলাটাকে সে দুর্গম একটা দুর্গ বানাতে চায়।

নির্দেশগুলো লেখা শেষ হল না, ফোন বাজল। নেপলসের বস্ জানাল, প্রেজো। ফিলোর মালিকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। সেই বজ্জাত কর্নেল গুগলি পাহারা দিচ্ছে ভিটেলা রেমারিককে।

ডন বাকালার ভয় আরও একটু বাড়ল।

.

পশমের আচ্ছাদনের ওপর ছক্কা ফেলল রেমারিক। দুটো চার। ব্যস্ত হাতে কলম। তুলে নিয়ে দ্রুত হিসেব করল সে। বলল, পচাশি হাজার লিরা।

ক্ষীণ একটু কষ্টসাধ্য হাসি দেখা গেল কর্নেলের ঠোঁটে। আপনি ঠিক বুদ্ধিই দিয়েছিলেন, কোন হোটেলেই ওঠা উচিত ছিল না আমার।

আজ তিন দিন প্রেজো ফিসোতে আছেন তিনি। ভোজন রসিক মানুষ, কিচেনে সাহায্যও করেছেন রেমারিককে। রেগুলার কাস্টমারদের কোন ধারণাই নেই যে তাদের সালাদ আজ একজন পুরোদস্তুর কর্নেল তৈরি করেছেন। ব্যাকগ্যামনে এ-পর্যন্ত তিনশো হাজার লিরা হেরেছেন বটে, কিন্তু রেমারিকের সঙ্গে চমৎকার সময় কেটেছে। সত্যি কথা বলতে কি, রেমারিকের প্রতি শ্রদ্ধা এসে গেছে তার, ব্যাকগ্যামনে ও একটা জিনিয়াস।

কিন্তু শুধু শ্ৰদ্ধা নয়, মধুর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে। এর একটা কারণ এই হতে পারে, বিপরীত চরিত্রের প্রতি আকর্ষণ। দুজন মানুষের মধ্যে এর চেয়ে বেশি অমিল থাকতে পারে না। রেমারিক গম্ভীর, মিতভাষী, সতর্ক, তার নাক ভাঙা। গুগলি হাসিখুশি, সদালাপী, লম্বা, সুদর্শন। তবু এই নিয়াপলিটান লোকটাকে দারুণ ভাল লেগে গেল কর্নেলের। আড়ষ্ট ভাবটা দূর হবার পর রেমারিক যখন মুখ খুলল, বোঝা গেল নিজের সমাজ আর দুনিয়াদারি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখে সে। শুকনো এক ধরনের রসিকতাবোধও আছে তার মধ্যে। রেমারিকের অতীত সম্পর্কে। অনেক কিছুই জানেন তিনি, সেজন্যই বর্তমান পেশায় সে সন্তুষ্ট কিনা বারবার জানতে চান। এভাবে জীবন কাটাতে একঘেয়ে লাগে না?

মাথা নেড়ে, মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে রেমারিক, উত্তেজনা দরকার হলে অতীত রোমন্থন করে সে। তাছাড়া, মাঝে-মধ্যে দুএকটা দুর্লভ সুযোগ আসে, তখন উত্তেজনার কোন অভাব থাকে না–এই যেমন, ব্যাকগ্যামন খেলায় অতি শিক্ষিত পুলিস অফিসারকে হারিয়ে দেয়া।

প্রথম দিকে কর্নেলকে একটা ধাঁধা বলে মনে হয়েছিল রেমারিকের। তারপর ভদ্রলোকের বিদ্রূপ মেশানো মন্তব্য, দিল খোলা হাসি, খেলায় গো-হারা হেরেও প্রতিপক্ষকে প্রশংসা করার ধরন, ইত্যাদি দেখে ভেতরের সরল আর সৎ। মানুষটাকে চিনতে পারে সে। দ্বিতীয় রাতে কর্নেলের বড় ভাই ডিনার খেতে এসেছিলেন। তিনজন মিলে একটা উৎসব মত করেন। অত বড় সার্জেন, কিন্তু তার মধ্যে গর্ব বা অহমের ছিটেফোঁটাও দেখেনি রেমানিক। দুভাইয়ের দরাজ গলার হাসির সঙ্গে তাকেও হাসতে হয়েছে। তিনজন ওরা দুবোতল মদ সাবাড় করে ফেলে।

দুভাইয়ের মধ্যে গভীর ভালবাসা রয়েছে। পারিবারিক আলোচনায় তারা। রেমারিককে ভিড়িয়ে নিল। তারপর এক সময় লুবনার বডিগার্ডের প্রসঙ্গও উঠল। কর্নেলের বিশ্বাস, বডিগার্ডের সঙ্গে রেমারিকের কোন না কোন যোগাযোগ আছে। কিন্তু স্বীকার করার জন্যে রেমারিককে চাপ দিলেন না তিনি। দিনে কয়েকবার করে রোমে টেলিফোন করেন, কথা বলেন সহকারী পাধানির সঙ্গে। প্রতিবারই পাধানি তাঁকে জানায়, রেমারিকের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ কোন ফোনকল আসেনি। চিঠিগুলোর ব্যাপারেও একই কথা। আড়িপাতা যন্ত্রে শুধু আপনার-আমার কথা টেপ হয়েছে।

তবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই কর্নেলের। সাংবাদিকরা ইতিমধ্যে আসল ঘটনা প্রায় জেনে ফেলেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন কাগজে বডিগার্ডের পরিচয় ছাপা হয়নি। অসৎ শিল্পপতিকে গালাগাল করছে কাগজগুলো, যে-লোক টাকার লোভে নিজের মেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, তার মত হীন চরিত্র ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। নামকরা ল-ইয়ার আলবারগো লোরানকেও ছেড়ে কথা বলছে না তারা। এক সম্পাদকীয়তে লেখা হল, এ-ধরনের শিক্ষিত লোকগুলো আসলে সমাজের বিষফোঁড়া; কে জানে, হয়ত বিস্ফোরণের সাহায্যে এদেরকে উৎখাত করাই সবার জন্য মঙ্গল।

এ-সব ঘটনা জোড়া দিয়ে একটা গল্প দাঁড়িয়ে গেছে, আসল কাহিনীর সঙ্গে তার পার্থক্য সামান্যই। গুগলি মনে মনে ভাবেন, সব যখন ফাঁস হয়ে যাবে, দেশের সাধারণ মানুষ কিভাবে নেবে সেটাকে? মানুষ জানবে, ব্যাপারটার ইতি ঘটেনি, নিকট ভবিষ্যতে আরও রোমহর্ষক ঘটনা ঘটবে। কি ভাববে তারা, তাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে?

বডিগার্ডকে নিয়ে অনেক কথা ভাবেন গুগলি। একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করেছেন তিনি, রেমারিক কখনও ভুলেও তার নাম উচ্চারণ করে না। ও, বন্ধু, এইসব বলে। রেমারিকের কথা শুনে বডিগার্ডের একটা ছবি কল্পনা করে নিয়েছেন। তিনি। লুবনার প্রতি লোকটার ভালবাসা তিনি উপলব্ধি করেন। লুবনার রক্ষক ছিল সে, কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারেনি। লোকটার প্রতি সহানুভূতি বোধ করেনতিনি। এমনকি তার এই প্রতিশোধ স্পৃহাও মনে শ্রদ্ধার ভাব এনে দেয়।

রেমারিক বলেছে, বন্ধুকে সে শেষবার দেখেছে হাসপাতালে। গুগলি তর্ক করেননি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাই ঘটুক, তাঁর ব্যক্তিগত কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। বেরলিংগার আর বাকালা ভুগুক না দুশ্চিন্তায়।

কিন্তু আসল কথা, ব্যাকগ্যামন খেলায় তিনি হারছেন। যথেষ্ট হয়েছে, রেমারিক আরেক দফা খেলার আয়োজন করছে দেখে বললেন তিনি। আর নয়। পাবলিক সার্ভেন্ট হয়ে প্রতিদিন এক হপ্তার বেতন হারার সামর্থ্য আমার নেই।

টেরেসে বসলেন গুগলি, অন্যমনস্ক। তাঁকে শ্যাম্পেন অফার করল রেমারিক। সূর্য দিগন্তরেখা ছুঁই ছুঁই করছে। একটু পর ডিনার তৈরি করার জন্যে কিচেনে গিয়ে ঢুকবে রেমারিক।

আধঘন্টা পর মিলান থেকে একটা ফোন পেলেন গুগলি। কথা শেষ করে কিচেনে ঢুকলেন তিনি। ভিটো আভান্তি, মৃদু কণ্ঠে বললেন। আত্মহত্যা করেছে।

ঠিক জানেন, আত্মহত্যা? জিজ্ঞেস করল রেমারিক।

মাথা ঝাঁকালেন গুগলি। সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আটতলার অফিসে ছিল সে, জানালা দিয়ে কার্নিসে নেমে পড়ে। মনস্থির করার আগে ওখানেই আধ ঘন্টা বসেছিল।

মাংস কাটায় ব্যস্ত হয়ে উঠল রেমারিক। তারপর, হঠাৎ হাত থামিয়ে মুখ তুলল, ওর স্ত্রীকে আপনি চেনেন?

একবার দেখেছি, বললেন গুগলি। কোন কথা হয়নি। সাক্ষাৎকারের ঘটনাটা বর্ণনা করলেন তিনি।

রেমারিক বলল, প্রথম দিকে তার আচরণ অন্য রকম ছিল। সব দোষ আমার বন্ধুর ঘাড়ে চাপিয়েছিল সে।

রেমারিককে সাহায্য করার প্রস্তাব দিলেন গুগলি। নিস্তব্ধতা ভেঙে এক সময় বললেন, ভিটো যখন মনস্থির করার চেষ্টা করছে, পুলিস তখন কোন উপায় না দেখে তার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে। সে যেন বুঝিয়ে-শুনিয়ে স্বামীকে ক্ষান্ত। করে। জানেন, লরা-আভান্তি কি বলেছে?

কি?

মাথা নাড়লেন গুগলি। কিছুই না–কিচ্ছু বলেনি, শুধু খিলখিল করে হেসেছে ফোনে।

আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল ওরা। খানিক পর বিড়বিড় করে গুগলি বললেন, আশ্চর্য এক মহিলা–কিন্তু ভারি সুন্দরী।

ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল রেমারিক, কিছু বলতে গেল, কিন্তু তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করেই থাকল সে।

অগ্নিপুরুষ ২ (মাসুদ রানা)  পর্ব ০৮.


ইউরোপের প্রতিটি রাজধানীতে একটা করে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাস আছে, আর প্রতিটি দূতাবাসের পাশের রাস্তায় পার্ক করা অবস্থায় পাওয়া যাবে হাউজ-ট্রেইলর ও মোবাইল হোম। সাধারণত গরম কালে, দিনের বেলা দেখা যায় ওগুলোকে। সবই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড, বিক্রি করার জন্যে। কিন্তু শুধু অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের কাছে। কেন, কেউ তা জানে না।

রোমও এর ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু সময়টা শেষ গ্রীষ্ম বলে ভেহিকেল দেখা গেল মাত্র একটা-বেডফোর্ড চেসিসের ওপর একটা মোবেক্স।

সুসান আর রকি, প্রেমিক প্রেমিকা। একজন খদ্দেরের আশায় অপেক্ষা করছে ওরা।

রকির বয়স আটাশ। তার চেহারার একমাত্র বৈশিষ্ট্য কটা রঙের চুল। মাথা থেকে ফুলেফেপে নেমে এসে চুলগুলো তার ঘাড়, গলা, কাঁধ, পিঠ আর বুক ঢেকে ফেলেছে। চুলের রাজ্য থেকে পিট পিট করছে বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া খুদে আকারের চোখ। পরনে ডেনিম ওভারঅল, মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দিলে ধুলে কসের ময়লা। বের হবে তাই নিয়ে দেশ জুড়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যাবে।

সুসানের বয়স পঁচিশ। আগাগোড়া বিশাল তার আকৃতি। মোটা নয়, স্রেফ বড় বেশি বাড়। দেখতে খারাপ নয় সুসান, কিন্তু তার বিশাল কাঠামো ঠিক নারীসুলভ নয়।

ওরা অস্ট্রেলিয়ান, ওদের গল্পও প্রবাসী আর সব অস্ট্রেলিয়ানদের মত। দেশে। অধ্যাপনা করছিল রকি, একটা কলেজে প্রবাসী ইটালিয়ানদের ইংরেজি পড়াত। একই কলেজের একজিকিউটিভ সেক্রেটারি ছিল সুসান। মন দেয়া-নেয়া চলছিল আগে থেকেই, হঠাৎ দুজন ঠিক করল, এই নিরানন্দ জীবন ভাল্লাগছে না, জ্ঞান বাড়াবার জন্যে দুনিয়াকে একবার ঘুরে দেখে আসতে পারলে হয়। যেই ভাবা সেই কাজ, ব্যাংকে যা ছিল সব তুলে জাহাজে চেপে বসল ওরা। চলে এল ইটালিতে। কিন্তু দুনিয়া দেখার সাধ তাদের মিটল না, কারণ ইটালিতে একমাস কাটিয়ে তাদের পকেট খালি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে প্রচুর শিক্ষা হয়েছে ওদের, মোবেক্সটা। বিক্রি করে এখন ওরা ঘরের সন্তান ঘরে ফিরতে পারলে বাঁচে।

তিন দিন কেটে গেল এখানে, অথচ খদ্দেরের দেখা নেই। মোবেক্স বিক্রি করতে না পারলে জাহাজের টিকেট কেনা হবে না। দুজনেই খুব উদ্বিগ্ন। এই সময় একজন সম্ভাব্য খদ্দের পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল সুসান।

বয়স্ক একজন লোক, কিন্তু হাবভাবে প্রাণচঞ্চল তরুণ। দেখে মনে হয়। বিদেশী, কিন্তু বিশুদ্ধ ইটালিয়ান ভাষায় জিজ্ঞেস করল, এটা কি বিক্রির জন্যে?

রকি চিরকালই একটু বেয়াড়া টাইপের, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল সে, বলল, না, এখানে এটাকে রেখেছি লোককে দেখাবার জন্যে। এ কথা না বলে, লোকটা ঘুরেফিরে ভাল করে দেখল ভেহিকেলটা। চাপা। উত্তেজনা নিয়ে পেভমেন্ট থেকে উঠে দাঁড়াল সুসান, বিশাল পশ্চাদ্দেশ থেকে ধুলো। ঝাড়ল হাত চাপড়ে। সত্যি তোমার কেনার ইচ্ছে আছে? জানতে চাইল সে। তার কণ্ঠস্বর কিছুটা পুরুষালি।

এ লোকটা তার দিকে তাকাল, মাথা ঝাঁকাল ছোট্ট করে। অমলিন হাসি দেখা গেল সুসানের মুখে। রকিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হল।

এঞ্জিনটা দেখতে পারি?

মোবেক্সের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করছে সুসান, ওদের পিছু পিছু ঘুরছে রকি। তারপরই সুসান প্রস্তাব দিল, ভেতরে বসে ঠাণ্ডা বিয়ার খাওয়া যাক। মোবেক্স মাত্র দুবছরের পুরানো, দশ হাজার মাইল চলেছে। দর কষাকষিতে সুসানকে টলানো খুব কঠিন, বুঝতে পেরে বেশি জেদ করল না লোকটা। শেষ পর্যন্ত দশ মিলিয়ন। লিরায় রফা হল। লোকটা জানতে চাইল, ট্রান্সফার পেপার তৈরি আছে তো?

আছে, বলল সুসান। পুলিস স্টেশনে গিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে নিতে হবে। ফর্মটা পূরণ করা হল। ক্রেতা নিজের নাম লিখলঃ বদিয়ের মন্টি। জাতীয়তাঃ ফ্রেঞ্চ।

তিন দিন পর ডেলিভারি নেব আমি, ছোট ফোল্ডিং-টেবিলের ওপর কাগজটা। ঠেলে দিয়ে বলল লোকটা।

সন্দেহের চোখে তাকাল সুসান। অ্যাডভান্স করছ তো?

এরপর ওরা একটা ধাক্কা খেল। জ্যাকেটের পকেট থেকে টাকার বড় একটা তাড়া বের করল লোকটা, নোটগুলো এক লক্ষ লিরার। গুনে গুনে একশো নোট তাড়া থেকে আলাদা করে টেবিলের ওপর রাখল সে। কিন্তু কাগজগুলো তার। আগেই রেজিস্ট্রি কোরো না।

অনেকক্ষণ কথা বলল না কেউ। নিস্তব্ধতা ভাঙল রকি, তুমি দেখছি সরল ভাবে বিশ্বাস করলে আমাদের। টাকা আর মোবেক্স নিয়ে আমরা যদি পালিয়ে। যাই?

খুদে চোখ জোড়ার দিকে তাকাল লোকটা। কিছু বলল না, শুধু হাসল।

সুসান জানতে চাইল, এখান থেকে ডেলিভারি নেবে তো?

মাথা নাড়ল নোকটা। পকেট থেকে রোমের একটা রোড ম্যাপ বের করে। ভাঁজ খুলল, আঙুল রাখল একটা ক্রস চিহ্নে। জায়গাটা শহরের বাইরে, পুব অটোস্ট্র্যাডার কাছাকাছি। মন্টি অ্যান্টিনি ক্যাম্পসাইটটা…ওখানেই বিকেলের দিকে গিয়ে বুঝে নেব। কোন অসুবিধে নেই তো?

না, অসুবিধে কি, বলল সুসান। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের ব্যাগগুলো রেলওয়ে স্টেশনে রেখে আসতে পারব।

কোন দিকে যাচ্ছ তোমরা?

ব্রিন্দিসি, বলল সুসান। ওখান থেকে ফেরি ধরে গ্রীসে। চট করে একবার রকির দিকে তাকাল সে, ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল রকি। লোকটার কাছ থেকে বেশ কিছু বেশি টাকা আদায় করা গেছে, কাজেই গ্রীস হয়ে দেশে ফিরতে কোন অসুবিধে নেই এখন।

বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিল লোকটা, চারদিকে আরেকবার চোখ বুলাল। মোবেক্সের ভেতরটা ছোট, কিন্তু আরামদায়ক। কি যেন ভাবছে। সুসান, তারপর। রকির দিকে তাকাল সে। নিঃশব্দে দেখল দুজনকে। অবশেষে মুখ খুলল, আমিও দক্ষিণ দিকে যাচ্ছি। চাইলে তোমাদেরকে লিফট দিতে পারি।

প্রস্তাবটা নিয়ে আলোচনা করল ওরা। মন্দ কি, বলল সুসান। রকি খানিক। ইতস্তত করে মাথা ঝাঁকাল। লোকটা ব্যাখ্যা করে বলল, তার কোন ব্যস্ততা নেই। তিন থেকে চার দিন পথেই থাকবে সে। কথা প্রসঙ্গে বলল, তাহলে ব্রিন্দিসিতে না। পৌঁছুনো পর্যন্ত রেজিস্ট্রি করার দরকার নেই।

লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, কাজেই লোকটাকে আরও কিছুক্ষণ থেকে যেতে। বলল সুসান। টিনের খাবার রান্না করল সে, আরও বিয়ারের ক্যান খুলল রকি।

রানা চলে যাবার পর রকি মন্তব্য করল, ফেঞ্চ না ছাই, ডাহা মিথ্যে কথা বলে গেল।

কি করে জানলে?

গায়ের রঙ দেখলে না?

কেন, ফ্রান্সে তো ওর চেয়েও কালো লোক আছে।

অপ্রতিভ দেখাল রকিকে। মোট কথা, লোকটাকে আমার ফেঞ্চ বলে মনে হয়নি, তেমন সুবিধের বলেও মনে হয়নি। কেমন উদ্ভট আচরণ, লক্ষ করেছ? একটা ঠিকানা পর্যন্ত না দিয়ে স্রেফ উঠে চলে গেল।

কাঁধ ঝাঁকাল সুসান। তা যাক গে, পুরো টাকা তো দিয়ে গেছে। খানিক পর আবার বলল, চেহারা দেখে আজকাল লোক চেনা কঠিন, তা ঠিক।

এই বয়সেও কেমন শক্ত-সমর্থ লক্ষ করেছ? কিভাবে হাঁটে দেখেছ? মনে হয়। বাইশ বছরের শরীরে বাহান্ন বছরের চেহারা। বাজি রেখে বলতে পারি, তুমিও ওর সাথে পারবে না। দাঁত বের করে হাসতে লাগল রকি।, সুসানও হাসল। আমার কিন্তু লোকটাকে খারাপ লাগেনি। বেশি দরদাম করেনি। স্বভাবটা খুঁতখুঁতে নয়। এর বেশি কি দরকারই বা আমাদের?

.

নিঃশব্দে টেরেসে বেরিয়ে এল রেমারিক। হঠাৎ একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তার মধ্যে, কর্নেল গুগলির দৃষ্টি এড়ায়নি। একটা চেয়ার টেনে বসল, কর্নেলের দিকে না তাকিয়ে পট থেকে চা ঢালল কাপে। তার চেহারায় দ্বিধা আর উদ্বেগ। ফোনটা এসেছে প্রায় এক ঘন্টা আগে, দশ মিনিট কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখে রেমারিক। তারপর থেকেই গম্ভীর সে, একটা কথাও বলেনি। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন গুগলি। ফোনে কোন তাৎপর্যপূর্ণ আলাপ হয়ে থাকলে এক ঘন্টার। মধ্যে পানির কাছ থেকে জানতে পারবেন তিনি।

কফি খেতে খেতে মনস্থির করে ফেলল রেমারিক। আমার বন্ধু যদি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করে, কি ঘটবে?

কর্নেলের পালস রেট বেড়ে গেল। ফোন কলটার তাহলে সত্যিই তাৎপর্য আছে। গম্ভীর হলেন তিনি, বললেন, জেলে তাকে অবশ্যই যেতে হবে। তবে, যে ধরনের লোকদের সে খুন করেছে, আর তার যে মোটিভ, সাজাটা হবে, বড়জোর বছর পাঁচেকের। বিশেষ ব্যবস্থাও করা সম্ভব। ধরুন, সব মিলিয়ে বছর আড়াইয়ের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যাবে সে।

কিন্তু ওকে কি জেলখানার ভেতর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে?

কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি, বললেন গুগলি। ইটালির জেলখানা। মাফিয়ার দখলে, সত্যি কথা। কিন্তু দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই, আপনার বন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। রোমের বাইরে নতুন একটা জেলখানা তৈরি করেছি আমরা, শুধু কারাবিনিয়ারির লোকজন কাজ করছে ওখানে। আপনার বন্ধুর নিরাপত্তার ব্যাপারে গ্যারান্টি দেব আমি। আসলে, তার বিপদ শুরু হবে জেলখানা থেকে বেরুবার পর।

আত্মসমর্পণের কথা ভুলে যান, বলল রেমারিক। আপনাকে যদি অনুরোধ করা হয়, আমার বন্ধুকে নিরাপদে ইটালি ত্যাগ করার ব্যবস্থা করে দিন, আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে?

আগে জানতে হবে অনুরোধটা কে করছে।

ধরুন, আপনার বস, জেনারেল যদি করেন?

কাঁধ ঝাঁকালেন গুগলি। তার নির্দেশ আমি খুশি মনে শিরোধার্য বলে মেনেনেব।

সেই নির্দেশই পেতে যাচ্ছেন আপনি, বলল রেমারিক। হাতঘড়ি দেখল সে। আর বেশি দেরি নেই।

চটে উঠলেন গুগলি। মানে?

আরও কয়েকটা তথ্য দিই আপনাকে, বলল রেমারিক। তার আগে বলুন, মাসুদ রানা নামটা আগে কখনও শুনেছেন?

মাসুদ রানা…মাসুদ রানা–হ্যাঁ, শুনেছি। বাংলাদেশের একজন দুর্দান্ত পাই।

আপনি যাকে লুবনার বডিগার্ড হিসেবে জানেন, যাকে হাসান নামে চেনেন, আমার বন্ধু, সে ওই মাসুদ রানা–মার্সেনারি হাসানের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে।

ব্যাপারটা হজম করতে তিন সেকেণ্ড সময় নিলেন গুগলি। মাই গড! রেমারিকের দিকে ঝুঁকলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ সব গড়গড় করে বলে ফেলছেন, ব্যাপারটা কি?

রানার এখন খুব বিপদ, বলল রেমারিক। ডন বাকালা তার পরিচয় জেনে ফেলেছে। কিছুই গোপন নেই, ফাস হয়ে গেছে সব। রানার বর্তমান চেহারার একটা ছবিও তার হাতে পৌচেছে, ভোশিয়ে সহ।

কিভাবে? ভুরু কুঁচকে উঠল কর্নেলের। আমরা কিছুই জানতে পারলাম না, অথচ…

রানার পরিচয় ফাঁস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, বলল রেমারিক। আপনি জানেন, মার্কিন মাফিয়া আর ইটালিয়ান মাফিয়ার মধ্যে সেই আদি কাল থেকেই যোগাযোগ আর সম্পর্ক আছে। এখানে বন্ধুদের বিপদ দেখে ওখানের ডনেরা চুপ করে বসে নেই। বাংলাদেশে টেলেক্স পাঠিয়ে হাসান সম্পর্কে খোঁজ-খবর শুরু করে ওরা, আর তাতেই ফাস হয়ে যায়। হাসান মারা গেছে মাস কয়েক আগে। তদন্ত আরও জোরেশোরে শুরু হয়, বেরিয়ে পড়ে বডিগার্ডের আসল পরিচয়।

কিন্তু মাসুদ রানার মত একজন এসপিওনাজ এজেন্ট বডিগার্ডের চাকরি…?

কোন একটা কারণে সি. আই. এ.-এর চোখকে ফাঁকি দেয়ার দরকার পড়ে। ওর, তাই…

ও, আচ্ছা, বুঝেছি, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল গুগলির। এয়ারকিং হাইজ্যাক করে নিয়ে এসে সি. আই.এ.-কে চটিয়ে দেয় আপনার বন্ধু। কিন্তু বিপদটা কি ধরনের? কে ফোন করেছিল আপনাকে?

ফোন করেছিল ব্রিগেডিয়ার সোহেল নামে রানার এক বন্ধু, বলল রেমারিক, ঢাকা থেকে। আর রানার বিপদটা হল, ওর চেহারা আর পরিচয় ফাস হয়ে যাবার পর, ঢাকা ভাবছে, মাফিয়ানদের হাতে ধরা না পড়ে ওর কোন উপায় নেই। সেজন্যেই ওর বস ওকে জরুরি নির্দেশ দিয়েছেন।

কি সেই নির্দেশ?

স্টপ ইট! লিভ ইটালি ইমিডিয়েটলি!

কাঁধে একটা দায়িত্বের বোঝা নতুন করে অনুভব করলেন কর্নেল গুগলি। চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। আর কি জানেন, সব বলুন আমাকে।

বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, মাফিয়ার ওপর আঘাত হানায় সি. আই. এ. নাকি রানার ওপর থেকে মৃত্যু-পরোয়ানা তুলে নিয়েছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাইছে। ওরা। ডন বাকালার নিরাপত্তার জন্যে গেরিলা ট্রেনিং পাওয়া বারোজন মার্কিন মাফিয়ান ইটালিতে আসছিল, সি. আই. এ. খবর পেয়ে আটজনকে এয়ারপোর্টে আটক করে। কিন্তু বাকি চারজন আগের দিন রওনা হয়ে যায়। ইতিমধ্যে সম্ভবত ডন বাকালার ভিলা কোলাসিতে পৌঁছে গেছে তারা। ঢাকা থেকে আরও খবর আসে–ভিলা কোলাসি এখন একটা দুর্গম দুর্গ, কোন মানুষের সাধ্য নেই ভেতরে ঢোকে। সেজন্যেই রানার বস নির্দেশটা পাঠিয়েছেন।

এখন আমরা কি করব?

আপনার বসের টেলেক্স আসছে। না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

আপনি বলতে চাইছেন, ঢাকা থেকে আমার বুকে অনুরোধ করা, হয়েছে?

আপনি জানেন না, আপনার বস আর রানার বস, খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওঁরা।

মেজর জেনারেল রাহাত খান? হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে বসকে তাঁর কথা বলতে শুনি। বটে। চিন্তিত দেখাল কর্নেলকে। ঠিক আছে, টেলেক্স পেলাম। তারপর?

তারপর আমরা রোমে যাব, বলল রেমারিক। নির্দেশটা পৌঁছে দেব রানাকে।

রোমে পৌঁছুতে অনেক সময় লাগবে আমাদের, গুগলি বললেন। তারচেয়ে। আমার সহকারী পাধানিকে ফোন করি আমি। দশ মিনিটের মধ্যে রানাকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবে সে।

হেডকোয়ার্টারে? সতর্ক চোখে তাকাল রেমারিক।

না, মানে…নিরাপদ একটা সেফ হাউসে, তাড়াতাড়ি বললেন গুগলি। তারপর ওখান থেকে তার দেশ ত্যাগের ব্যবস্থা করা হবে।

মাথা নাড়ল রেমারিক। রানা যদি পাধানি, আর দশ বারোজন পুলিসকে খুন। করে বসে, তাকে আপনারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে দেবেন?

যুক্তিটা বুঝলেন গুগলি। রানাকে আপনি ফোন করতে পারেন না?

ওখানে কোন ফোন নেই।

তাহলে দেরি করা বোকামি হচ্ছে, চলুন বেরিয়ে পড়ি।

টেলেক্স না পেয়েই?

গাড়িতে ব্যবস্থা আছে, বললেন গুগলি। পাধানির সাথে যোগাযোগ করব আমি।

বোর্ডিং হাউস থেকে নিচে নামল ওরা। কর্নেলের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে, মটরসাইকেলে চড়ে একজন পুলিস এসে থামল সামনে। কর্নেলের হাতে একটা নয়, দুটো টেলেক্স ধরিয়ে দিল সে।

গাড়ি চালাচ্ছে রেমারিক। মেসেজ পড়ছেন গুগলি। তার বস বলেছেন, খুনী ধরা পড়লে তার শাস্তির ব্যবস্থা না করে উপায় নেই। কিন্তু সে যদি ইটালি ছেড়ে পালিয়ে যায়, কিচ্ছুটি করার নেই আমাদের। ব্যবস্থা কর। শেষ কথাটার বিশেষ তাৎপর্য বুঝতে পেরে মুচকি একটু হাসলেন গুগলি।

এরপর তিনি দ্বিতীয় মেসেজটা পড়তে শুরু করলেন। হোলি মাদার অভ গড! হঠাৎ আঁতকে উঠে বললেন তিনি।

কি হল? জানতে চাইল রেমারিক।

হাতে ধরা টেলেক্স মেসেজটা ইঙ্গিতে দেখালেন গুগলি। ব্যাখ্যা করে বললেন, তিনি আন্দাজ করেছিলেন রানা মার্সেলেসে গিয়েছিল ইকুইপমেন্ট যোগাড় করার। জন্যে। ফ্রেঞ্চ পুলিসকে দিয়ে আর্মস ডিলারের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় কয়েকটা তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গগল সব ফাঁস করে দিয়েছে? চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল রেমারিক।

কিছুই সে বলেনি, গুগলি বললেন। নির্দিষ্ট একটা সময়ের ভেতর যা যা বিক্রি করেছে, তার একটা তালিকা আদায় করেছে ফ্রেঞ্চ পুলিস। আচ্ছা, আর. পি. জি. সেভেন স্ট্রোক ডি জিনিসটা কি বলুন তো?

গম্ভীর একটু হাসি দেখা গেল রেমারিকের মুখে। অ্যান্টিট্যাঙ্ক রকেট লঞ্চার। মার্সেনারিরা ওটাকে জুয়িশ বাজুকা বলে।

ইসরায়েলি অস্ত্র?

না। রাশিয়ান। কিন্তু রকেট লোড করার পর জিনিসটা দেখতে হয় সারকামসাইজড় পেনিসের মত।

গুগলি হাসলেন না। রানা ওটা ব্যবহার করতে জানে?

কোনটা?

এবার না হেসে পারলেন না গুগলি। মাংসপেশী নয়, আমি ইস্পাতটার কথা জিজ্ঞেস করছি। রানা ওটা চালাতে জানে?

অনেকের চেয়ে ভালভাবে।

কিন্তু, বিস্মিত দেখাল কর্নেলকে, মাফিয়াদের প্রায় সব কিছুই আছে, ট্যাঙ্ক, আছে বলে তো শুনিনি!

নেই, বলল রেমারিক। শুধু ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে নয়, অন্য কাজেও ওটা ব্যবহার করা যায়। ধরুন, কেউ যদি বিল্ডিং ভাঙতে চায়, কিংবা স্টীল গেট খুলতে চায়? ওটার ক্ষমতা জানেন? বারো ইঞ্চি পুরু আর্মার প্লেট ভেদ করতে পারে। মুচকি হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে।

সন্দেহ নেই, চামড়ার অস্ত্রের চেয়ে একটু বেশিই পারে।

গলা ছেড়ে হেসে উঠল রেমারিক।

হঠাৎ গম্ভীর হলেন কর্নেল। রানাকে ওর বস থামতে বলায়, আমার ধারণা, আপনাকে হতাশ দেখাবার কথা। কিন্তু তা তো দেখাচ্ছে না। বরং …

রেমারিক হাসল না। রানা এই পর্যায়ে এসে কারও কথা শুনবে কিনা সেটাই হল প্রশ্ন।

.

ঠিক সেই মুহূর্তে রানার কাঁধে রয়েছে ইসরায়েলি বাজুকা, রোমের রাস্তা ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ও। ক্যানভাসের ব্যাগে শুধু আর. পি. জি. সেভেন স্ট্রোক ডি নয়, সঙ্গে এক জোড়া রকেটও রয়েছে। ব্যাগটা যে খুব একটা বড় তা-ও নয়, রকেট লঞ্চারটা সাধারণ একটা টিউবের মত দেখতে, সাঁইত্রিশ ইঞ্চি লম্বা, সহজে বহন করার জন্যে প্যাঁচ ঘুরিয়ে মাঝখানে খোলা যায়। জিনিসটার ওজন মাত্র পনেরো পাউণ্ড। এক একটা রকেটের ওজন পাঁচ পাউণ্ডের কিছু কম।

.

বুড়ো-বুড়ি সবেমাত্র লাঞ্চ শেষ করে সুখ-দুঃখের গল্প শুরু করেছে, দরজায় নক হল। দুজনেরই বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে, বুড়ির পায়ে বাত, কাজেই বুড়োকেই দরজা খুলতে যেতে হল। প্রথমেই একটা পিস্তল দেখল সে, ভয় পেল সাংঘাতিক। লোকটার চেহারা দেখে ভয় তার বাড়ল বৈ কমল না। কিন্তু লোকটা কথা বলল। নরম সুরে, আপনাদের কোন বিপদ হবে না। আমি ডাকাতি করতে আসিনি। ধীরে ধীরে সামনে এগোল সে, একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করল। বুড়োকে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে বুড়ো-বুড়িকে চেয়ারে বসিয়ে টেপ দিয়ে আটকে ফেলা হোল। ওদের মুখেও টেপ লাগাল লোকটা, সারাক্ষণ অভয় দিয়ে কথা বলছে সে। ওদের বাড়িটা কিছুক্ষণের জন্যে ধার নিচ্ছে। কোন ভয় নেই, তাদের কোন ক্ষতি করা হবে না।

একটু একটু করে ভয় কাটিয়ে উঠল বুড়ো-বুড়ি। দুজনেই আগ্রহের সঙ্গে লোকটার কাজকর্ম দেখতে লাগল। ব্যাগ থেকে মোটা আকৃতির দুটো টিউব বের করল সে, দুটোকে এক করে জোড়া লাগাল। কয়েক মুহূর্ত পর বুড়ো বুঝল, লোকটার হাতে ওটা একটা টেলিস্কোপ লাগানো রকেট লঞ্চার সেনাবাহিনীতে ছিল সে। তবে এ-ধরনের রকেট লঞ্চার আগে কখনও দেখেনি। জিনিসটা খুবই সফিসটিকেটেড বলে মনে হল। লঞ্চারে একটা মিসাইল ফিট করল লোকটা। এরপর দ্বিতীয় একটা মিসাইল, আর একজোড়া গগলস বের করল। শান্তভাবে বাড়ির পিছন দিকে, উঠনে চলে গেল সে। ভোলা জানালা পথে তাকে দেখতে পেল বুড়ো-বুড়ি-নিচু পাঁচিলের ওপর দিয়ে রাস্তা দেখছে। এই পাঁচিলটাই রাস্তা আর উঠনটাকে আলাদা করেছে।

.

উল্টোদিকের বিল্ডিঙের পেন্টহাউসে অতুনি বেরলিংগারও এইমাত্র তার লাঞ্চ শেষ করল।

ঠিক দুটো ত্রিশ মিনিটে বেসমেন্ট গ্যারেজে নেমে এল এলিভেটর। দরজা খুলে গেল, বেরিয়ে এল বেরলিংগার, পিছনে তার পার্সোনাল বডিগার্ড। ক্যাডিলাক অপেক্ষা করছে, এঞ্জিন সচল। ক্যাডিলাকের ঠিক পিছনেই রয়েছে কালো একটা ল্যানসিয়া, তাতে বসে আছে চারজন বডিগার্ড। ক্যাডিলাকের ব্যাক সিটে উঠে। বসল বেরলিংগার, দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল বডিগার্ড। ঢাল বেয়ে একই সঙ্গে রওনা হল গাড়ি দুটো।

ঢালের মাথায় উঠে আসতে রাস্তা দেখা গেল, কড়া রোদ লেগে ধাধিয়ে গেল সবার চোখ। সবাই চোখ কুঁচকে আছে, তবু চওড়া রাস্তার শেষ মাথায়; নিচু পাঁচিলের ওপারে লোকটাকে দেখতে পেল ওরা। ধীরে ধীরে সিধে হল লোকটা।

তার মুখ ভাল করে দেখা গেল না, গগলসে বেশিরভাগটাই ঢাকা পড়ে আছে। মোটাসোটা একটা টিউব রয়েছে ডান কাঁধে। সবই বুঝল ওরা, কিন্তু কিছু করার সময় পেল না। টিউবের পিছন থেকে উথলে উঠল বিরাট একটা অগ্নিশিখা, তার ভেতর থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এল কালো একটা জিনিস। জিনিসটা চোখের পলকে কাছে চলে এল, আর আকারে বড় হয়ে উঠল। চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। বেরলিংগার, ব্রেকের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছে ড্রাইভার। ভারি গাড়িটা সামনের দিকে ঝুঁকল, তারপর রিএনফোর্সড স্প্রিঙের ধাক্কা খেয়ে পিছনের চাকার ওপর খাড়া হতে শুরু করল। গাড়িটার উত্থান হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝাঁকির সঙ্গে আরও দ্রুত হয়ে। উঠল–মিসাইলটা র‍্যাডিয়েটরের মাঝখানে আঘাত করেছে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হল। এঞ্জিন, ভেতরের সব কিছুতে আগুন ধরে গেল। মুহূর্তের জন্যে রিয়ার ফেণ্ডারের ওপর খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকল ক্যাডিলাক, এই সময় পৌঁছুল দ্বিতীয় মিসাইল।

ফ্রন্ট অ্যাকসেলের ঠিক নিচে আঘাত করল মিসাইল। দশ টন ওজনের গাড়িটা পিছন দিকে ছিটকে পড়ল, ল্যানসিয়ার ওপর।

তাৎক্ষণিক মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে পারল মাত্র একজন। ল্যানসিয়া চিড়ে চ্যাপ্টা হতে শুরু করেছে, পিছনের দরজা বিস্ফোরিত হল, হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল একজন বডিগার্ড। বেরিয়ে এল আগুনের মাঝখানে। চামড়া আর মাংস পোড়ার গন্ধে ভারি হয়ে উঠল বাতাস।

.

গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন কর্নেল গুগলি। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে তার পেশী। বার বার টাইয়ের নট ঠিক করছেন, ভাবছেন একটা আয়না পেলে চেহারাটা একবার দেখে নেয়া যেত।

কিন্তু রেমারিক একা ফিরে এল। তার চেহারায় স্বস্তির ছাপ।

আপনার বন্ধু, মাসুদ রানা?

নেই, বলল রেমারিক। বোধহয় অপেক্ষা করাই উচিত, কি বলেন?

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার সুযোগ হল না। মাত্র তিন মিনিট পর জ্যান্ত হয়ে উঠল রেডিও। ক্যাপ্টেন পাধানি কর্নেল গুগলিকে ডাকছে– আর্জেন্ট কল।

.

গ্যারেজের বাইরে, ঢালের মাথায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন কর্নেল গুগলি আর পাধানি। দুজনের কারও মুখে কথা নেই। চোখের সামনে যা দেখছেন গুগলি, এ তার অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরে। অবশেষে রেমারিকের দিকে ফিরলেন তিনি। রেমারিক ওদের দিকে পিছন ফিরে রাস্তার দিকে মুখ করে রয়েছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে গোল আকৃতির কালো পোড়া দাগ, দেখতে পেলেন গুগলি, চুনকাম করা বাড়ির দেয়ালে।

জিজ্ঞেস করলেন, আর. পি. জি. সেভেন স্ট্রোক ডি?

ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। বলেছিলাম না, অন্য কাজেও ব্যবহার। হয় ওটা!

বিধ্বস্ত, আগুনে পোড়া গাড়ি দুটোর দিকে তাকিয়ে গুগলি বললেন, কি? না, শেষ পর্যন্ত সারকামসাইজড পেনিসের আঘাতে মারা গেল দুর্ধর্ষ বেরলিংগার! তার ঠোঁটে বিদ্রূপ মেশানো হাসির রেখা ফুটে উঠল।

COMMENTS

Name

Andrew-Kishore,1,অগ্নিপুরুষ,10,অনীশ,2,অন্য-ভুবন,3,আজ-হিমুর-বিয়ে,3,আবু-ইসহাক,1,আমি-এবং-আমরা,3,আমিই-মিসির-আলি,3,উপন্যাস,15,উপেন্দ্রকিশোর-রায়চৌধুরী,2,একজন-হিমু-কয়েকটি-ঝিঁঝিঁ-পোকা,5,এবং-হিমু,5,কবিতা,2,কহেন-কবি-কালিদাস,2,কাজী-আনোয়ার-হোসেন,18,কাজী-নজরুল-ইসলাম,2,গজল,1,গল্প,3,গানের-লিরিক,9,চলে-যায়-বসন্তের-দিন,3,চোখ,1,ছোট-গল্প,35,ছোটদের-গল্প,17,জলের-গান,1,জেমস,2,তন্দ্রাবিলাস,3,তোমাদের-এই-নগরে,4,দক্ষিণারঞ্জন-মিত্র-মজুমদার,1,দরজার-ওপাশে,4,দেবী,7,দেশাত্ববোধক-কবিতা,1,দেশাত্ববোধক-গান,2,নিশীথিনী,4,নিষাদ,3,পঞ্চতন্ত্র,1,পাগলা-দাশু,4,পারাপার,4,পুফি,3,বইয়ের-তালিকা,1,বাঘবন্দি,3,বিখ্যাত-গান,3,বিপদ,2,বৃহন্নলা,2,ভয়,5,মজার-গল্প,23,ময়ূরাক্ষী,4,ময়ূরাক্ষীর-তীরে-প্রথম-হিমু,1,মাসুদ-রানা,18,মিসির-আলি-UNSOLVED,4,মিসির-আলি-আপনি-কোথায়,3,মিসির-আলি-সমগ্র,55,মিসির-আলির-অমিমাংসিত-রহস্য,3,মিসির-আলির-চশমা,3,মুহম্মদ-জাফর-ইকবাল,1,মোশতাক-আহমেদ,1,মোহাম্মাদ-জসীম-উদ্দীন-মোল্লা,2,যখন-নামিবে-আঁধার,2,রবীন্দ্রনাথ-ঠাকুর,3,রম্যগল্প,4,রাধারানী-দেবী,1,রুপকথার-গল্প,4,শরৎচন্দ্র-চট্টোপাধ্যায়,2,শেখ-আবদুল-হাকীম,8,শ্রী-ক্ষিতীশচন্দ্র-কুশারী,1,সায়েন্স-ফিকশন,1,সুকুমার-রায়,7,সে-আসে-ধীরে,4,সেবা-প্রকাশনী,4,সৈয়দ-মুজতবা-আলী,1,স্বর্ণদ্বীপ,7,হরতন-ইশকাপন,2,হলুদ-হিমু-কালো-RAB,6,হাসির-গল্প,23,হিমু-এবং-একটি-রাশিয়ান-পরী,3,হিমু-এবং-হার্ভার্ড-PhD-বল্টু-ভাই,7,হিমু-মামা,6,হিমু-রিমান্ডে,9,হিমু-সমগ্র,80,হিমুর-দ্বিতীয়-প্রহর,3,হিমুর-বাবার-কথামালা,8,হুমায়ূন-আহমেদ,135,
ltr
item
গল্প এর বই: অগ্নিপুরুষ ২য় খন্ড (পর্ব ৭ – ৮) কাজী আনোয়ার হোসেন (মাসুদ রানা)
অগ্নিপুরুষ ২য় খন্ড (পর্ব ৭ – ৮) কাজী আনোয়ার হোসেন (মাসুদ রানা)
উঁহু, ইউনিয়ন কর্স হতেই পারে না, জোর দিয়ে বললেন বার্নাদো গুগুলি, প্যাথোলজিস্টের রিপোর্টের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন। ডেস্কের ওধারে একটা হাতলহীন চেয়ারে বসে র
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhZvIXz9G6TM3waFxcttffYsqpNZUw3NMHQpsAHC1zlBFWJG6BJL3jUP0JG-VIv2tS4qRFmDQZRJ0NQOFOyR2hSI7v1MvxJnuyT8Bvrdaj3RibMPg0MuvQbm4n2mGSCe6sUaA63obyGUzWo/s320/ogni-purush-masud-rana-kazi-anwarul-hosen-golpo-bangla-golpo.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhZvIXz9G6TM3waFxcttffYsqpNZUw3NMHQpsAHC1zlBFWJG6BJL3jUP0JG-VIv2tS4qRFmDQZRJ0NQOFOyR2hSI7v1MvxJnuyT8Bvrdaj3RibMPg0MuvQbm4n2mGSCe6sUaA63obyGUzWo/s72-c/ogni-purush-masud-rana-kazi-anwarul-hosen-golpo-bangla-golpo.jpg
গল্প এর বই
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/06/ogni-purush-2-7-8-kazi-anwar-hosen-masud-rana-series.html
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/06/ogni-purush-2-7-8-kazi-anwar-hosen-masud-rana-series.html
true
2280349116972597382
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content