ময়ূরাক্ষী (১৯৯০) হুমায়ূন আহমেদ পর্ব (০৪)

ময়ূরাক্ষী (১৯৯০) হুমায়ূন আহমেদ পর্ব (০৪) ______________ প্রবল ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে দেখি বড়ফুপু। পাশের বিছানা খালি। বাদল নেই। সকালে ঘ...

ময়ূরাক্ষী (১৯৯০) হুমায়ূন আহমেদ পর্ব (০৪)

______________




প্রবল ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে দেখি বড়ফুপু। পাশের বিছানা খালি। বাদল নেই। সকালে ঘুম ভাঙতেই প্রথম যে জিনিসটা জানতে ইচ্ছা করে–কটা বাজে?
বড়ফুপুকে এই প্রশ্ন করব না ভাবছি তখন তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, কেলেঙ্কারি হয়েছে।
কি কেলেঙ্কারি?
মানুষকে মুখ দেখাতে পারব না রে।
আমি বিছানায় বসতে বসতে বললাম, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার রাতে এসেছিল, তারপর আর রাতে ফিরে যায় নি–তাইতো?
তুই জানলি কী করে?
অনুমান করে।
আমি সকালে একতলায় নেমে দেখি ঐ ছেলে আর রিনকি। ছেলে নাকি রাতে তোর ফুপার অসুখের খবর পেয়ে এসেছিল। ঝড়বৃষ্টি দেখে আর ফিরে যায় নি। আর ঐ বদ মেয়ে সারারাতে ঐ ছেলের সঙ্গে গল্প করেছে।
বল কী?
আমার তো হাত ঘামছে। কীরকম বদ মেয়ে চিন্তা করে দেখ। মেয়ের কতবড় সাহস। ঐ ছেলে এসেছে ভালো কথা। আমাকে তো খবরটা দিবি?
আমি গম্ভিও গলায় বললাম, ঐ ছেলেরই বা কেমন আক্কেল রাত দুপুরে এল কীজন্যে?
হ্যাঁ দেখ না কান্ড। বিয়ে হয় নি কিছু না, শুধু বিয়ের কথা হয়েছে-এর মধ্যে নাকি সারারাত জেগে গল্প করতে হবে। রাত কি চলে গেছে নাকি?
খুবই সত্য কথা।
এখন ধর কোনো কারণে বিয়ে যদি ভেঙ্গে যায় তারপর আমি মুখ দেখাব কী ভাবে?
আমি এক্ষুনি নিচে যাচ্ছি ফুপু, ঐ ফাজিল ছেলের গালে ঠাশ করে একটা চড় মারব। তারপর দ্বিতীয় চড় রিনকির গালে। মেয়ে বলে তাকে ক্ষমা করার কোনো অর্থ হয় না।
তুই সবসময় অদ্ভুদ কথাবার্তা বলিস কেন? ঐ ছেলের গালে তুই চড় মারতে পারবি?
কেন পারব না?
যে ছেলে দুই দিন পর এ বাড়ির জামাই হচ্ছে তার গালে তুই চড় মারতে চাস? তোর কাছে এলাম একটা পরামর্শের জন্যে।
আজই ওদের বিয়ে লাগিয়ে দাও।
আজই বিয়ে লাগিয়ে দেব?
হুঁ। কাজি ডেকে এনে বিয়ে পড়িয়ে দাও–ঝামেলা চুকে যাক। তারপর ওরা যত ইচ্ছা রাত জেগে গল্প করুক। আসল অনুষ্ঠান পরে হবে। বিয়েটা হয়ে যাক।
ফুপু নিশ্বাস ফেললেন। মনে হচ্ছে আমার কথা তাঁর মনে ধরেছে। আমি বললাম, তুমি চাইলে আমি ছেলেকে বলতে পারি।
ওরা আবার ভাববে না তো আমরা চাপ দিচ্ছি?
চাপাচাপির কী আছে? ছেলে এমন কী রসগোল্লা? মার্বেলের মতো সাইজ। বিয়ে যে দিচ্ছি এতেই তো তার ধন্য হওয়া উচিত। তার তিন পুরুষের ভাগ্য যে আমরা…
ফুপু বিরক্তস্বরে বললেন, ছেলে এমন কী খারাপ?
খারাপ তা তো বলছি না–একটু শর্ট। তা পুরুষ মানুষের শর্টে কিছু আসে যায় না। পুরুষ হচ্ছে সোনার চামচ। সোনার চামচ বাঁকাও ভালো।
আজই বিয়ের ব্যাপারে ছেলে কি রাজি হবে?
দেখি কথা বলে। আমার ধারণা হবে।
তোর কথা তো আবার সবসময় মিলে যায়–একটু দেখ কথা বলে।
আমি আমার পাঞ্জাবি খুঁজে পেলাম না। ফুপু বললেন, বাদল ভোর বেলায় ঐ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বের হয়েছে।
আমি বাদলের একটা শার্ট গায়ে দিয়ে নিচে নামতেই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব লাজুক গলায় বললেন, হিমু ভাই আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। খুব লজ্জা লাগছে অবশ্যি।
বলে ফেল।
রিনকির খুব শখ পূর্ণিমারাতে সমুদ্র কেমন দেখায় সেটা দেখবে। দুই দিন পরেই পূর্ণিমা।
ও আচ্ছা–দুই দিন পরেই পূর্ণিমা তা তো জানতাম না।
মানে কথার কথা বলছি ধরুন আজ যদি বিয়েটা হয়ে যায়–তাহলে আজ রাতের ট্রেনে রিনকিকে নিয়ে কক্সবাজারের দিকে রওনা হতে পারি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রাখা আর কী। পরে একটা রিসিপশানের ব্যবস্থা না হয় হবে।
তোমার দিকের আত্মীয়স্বজনরা…
ওদের আমি ম্যানেজ করব। আপনি শুধ এদের বুঝিয়েসুঝিয়ে একটু রাজি করান–মানে রিনকি বেচারির দীর্ঘদিনের শখ। ওর জন্যেই খারাপ লাগছে।
না না, তা তো বটেই। দীর্ঘদিনের শখ থাকলে তা তো মেটানোই উচিত। রাতের টিকেট পাওয়া যাবে তো? পুরো ফার্স্টক্লাস বার্থ রিজার্ভ করতে হবে।
রেলওয়েতে আমার লোক আছে হিমু ভাই।
তাহলে তুমি বরং ঐটাই আগে দেখ। আমি এ দিকটা ম্যানেজ করছি।
আনন্দে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের চোখে চকচক করছে।সে গাঢ় গলায় বলল, রিনকি আমাকে বলেছিল–হিমু ভাইকে বললে উনি ম্যানেজ করে দিবেন। আপনি যে সত্যি সত্যি করবেন বুঝিনি।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কী নিয়ে গল্প করলে সারারাত?
গল্প আর কী করব বলুন। রিনকি এমন অভিমানী–কিছু বললেই তার চোখে পানি এসে যায়।সুপার সেনসেটিভ মেয়ে। কথায় কথায় একসময় বলেছিলাম যে ইউনিভাসিটিতে পড়ার সময় হেনা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে সামান্য পরিচয় হয়েছিল–এতেই রিনকি কেঁদে অস্থির। আমাকে বলেছে আর কোনোদিন যদি আমি ঐ মেয়ের নাম মূখে আনি সে নাকি সুইসাইড করবে। এ রকম মেয়ে নিয়ে বাস করা কঠিন হবে। খুব দুশ্চিন্তা লাগছে হিমু ভাই।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে কিন্তু মোটেও চিন্তিত মনে হলো না। বরং খুবই আনন্দিত মনে হলো। আমার ধারণা প্রায়ই সে হেনার কথা বলে রিনকিকে কাঁদাবে। রিনকিও কেঁদে আনন্দ পাবে। ওদের এখন আনন্দরই সময়।
আমি বললাম, কথা বলে সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই । তুমি তোমার আত্নীয়স্বজনকে বল । তার চেয়ে যা জরুরি তা হচ্ছে টিকিটের ব্যবস্থা । আমি ফুপু-ফুপাকে রাজি করাচ্ছি।
রাজি হয়েছে কি-না জেনে গেলে ভালো হতো না–হিমু ভাই?
আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি তুমি কি এটা জানো না?
জানি।
আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি তোমরা দুজন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছ। অসম্ভব জোছনা হয়েছে। সমুদ্রের পানি রুপার মতো চকচক করছে আর তোমরা…
আমরা কী?
থাক সবটা বললে রহস্য শেষ হয়ে যাবে।
আপনি এক অসাধারণ মানুষ হিমু ভাই। অসাধারণ।
আমি এবং বাদল ওদের এগারটার ট্রেনে তুলে দিতে এলাম। ফুপা-ফুপু এলেন না। ফুপার শরীর খারাপ করছে।
ট্রেন ছাড়বার আগমূহুর্তে রিনকি বলল, হিমু ভাই আমার কেমন জানি ভয় ভয় করছে।
কীসের ভয়?
এত আনন্দ লাগছে। আনন্দের পরই তো কষ্ট আসে। যদি খুব কষ্ট আসে?
কষ্ট আসবে না। তোদের জীবন হবে আনন্দময়। তোদের আমি আমার ময়ূরাক্ষী নদী ব্যবহার করতে দিয়েছি। এই নদী যারা ব্যবহার কেও তাদের জীবনে কষ্ট আসে না।
তুমি কী যে পাগলের মত কথা মাঝে মাঝে বল। কিসের নদী?
আছে একটা নদী।। আমি আমার অতিপ্রিয় মানুষদের শুধু সেই নদী ব্যবহার করতে দিই। অন্য কাউকে দিই না, তুই আমার অতি প্রিয় একজন। যদিও খানিকটা বোকা। তবু প্রিয়।
তুমি একটা পাগল। তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার।
ট্রেন নড়ে উঠল। আমি জানালার সঙ্গে সঙ্গে এগুতে লাগলাম। রিনকির আনন্দময় মুখ দেখতে এত ভালো লাগছে। রিনকির চোখে এখন জল। সে কাঁদছে। আমি মনে মনে বললাম–হে ঈশ্বর, এই কান্নাই রিনকি নামের মেয়েটির জীবনের শেষ কান্না হোক।
০৫.
প্রায় দশদিন পর আস্তানায় ফিরলাম।
আস্তানা মানে মজিদের মেস–দি নিউ বোর্ডিং হাউস।
মজিদ ঐ বোর্ডিং হাউসে দীর্ঘদিন ধরে আছে। কলেজে যখন পড়তে আসে তখন এই অন্ধ গহ্বর খুঁজে বের করে। নামমাত্র ভাড়ায় একটা ঘর। সেই ঘরে একটা চৌকি, একটা টেবিল। চেয়ারের ব্যবস্থা নেই কারণ চেয়ার পাতার জায়গা নেই।
মজিদের চৌকিতে একটা শীতল পাটি শীত-গ্রীষ্ম সবসময় পাতা থাকে। মশারিও খাটানো থাকে। প্রতিদিন মশারি তোলা এবং মশারি ফেলার সময় মজিদের নেই। তাকে সকাল থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত নানান ধান্ধায় ঘুরতে হয়, প্রতিমাসে তিনটি মানি অর্ডার করতে হয়। একটা দেশের বাড়িতে, একটা তার বিধাব বড়বোনের কাছে এবং তৃতীয়টি আবু কালাম বলে এক ভদ্রলোককে। এই ভদ্রলোক মজিদের কোনো আত্নীয় নন। তাকে প্রতিমাসে কেন টাকা পাঠাতে হয় তা মজিদ কখনো বলে নি। জিজ্ঞেস করলে হাসে। এইসব রহস্যের কারণেই মজিদকে আমার বেশ পছন্দ। আমাকে মজিদের পছন্দ কিনা জানি না। সে মানুষের সঙ্গে সম্পূর্ণ অন্যগ্রহ নিয়ে মেশে। কোনোকিছুতেই অবাক বা বিস্ময় প্রকাশ করে না। সম্ভবত শৈশবেই তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় তাকে একবার একটা ম্যাজিক শো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাচ এক জাদুকর জার্মান কালচারাল সেন্টারে জাদু দেখাচ্ছেন । বিস্ময়কর কান্ডকারখানা একের পর এক ঘটে যাচ্ছে। একসময়ে তিনি তাঁর সুন্দীর স্ত্রীকে করাত দিয়ে কেটে দুই টুকরা করে ফেললেন। ভয়াবহ ব্যাপার । মহিলা দর্শকরা ভয়ে উুঁ উুঁ জাতীয় শব্দ করছে তাকিয়ে দেখি মজিদ ঘুমিয়ে পড়েছে । ক্ষীণ নাকতাকার শব্দও আসছে । আমি চিমটি কেটে তার ঘুম ভাঙলাম।
সে বলল,কী হয়েছে? আমি বললাম , করাত দিয়ে মানুষ কাটা হচ্ছে।
মজিদ হাই তুলে বলল, ও আচ্ছা।
সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। অথচ আমি অনেক ঝামেলা করে দুইটা টিকিট জোগাড় করেছি যাতে একবার অনন্ত সে বিস্মিত হয় । আমার ধারণা তাজমহলের সামনেও যদি তাকে নিয়ে যাওয়া সে হাই চাপতে চাপতে বলবে ও এইটাই তাজমহল। ভালোই তো। মন্দ কী ।
মজিদকে আমার একবার তাজমহল দোখানোর ইচ্ছা । শুধু দেখার জন্য-সত্যি সত্যি সে কী করে । বা আসলেই সে কিছু করে কি-না।
দশদিন পর মজিদের সঙ্গে আমার দেখা-সে একবার মাত্র মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। তারপর পত্রিকা পড়তে লাগল। বছরখানেক আগের বাসি একটা ম্যাগাজিন।একবার জিজ্ঞেস ও করল না, আমার খবর কী । আমি কেমন। এতদিন কোথায় ছিলাম।
আমি বললাম , তোর খবর কিরে মজিদ ?
মজিদ এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রশ্নের উত্তর সে দেয় না ।
তোর আজ টিউশনি নেই? ঘরে বসে আছিস যে?
আজ শুক্রবার ।
তখন মনে পড়ল ছুটির দিনে যখন তার হাতে কোনো কাজ থাকে না তখনই সে ম্যাগাজিন জোগাড় করে। ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ঘুমায়, আবার জেগে উঠে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায় ,কিছুক্ষণ পর আবার ঘুমিয়ে পড়ে। জীবনের কাছে তার যেন কিছুই চাওয়ার বা পাওয়ার নেই । চার-পাঁচটা টিউশনি, মাঝেমধ্যে কিছু খুচরা কাজ এবং গ্রুফ দেখার কাজেই সে খুশি। বিএ পাস করার পর কিছুদিন সে চাকরির চেষ্টা করেছিল । তারপর-‘দুর আমার হবে না।’ এই বলে সব ছেড়েছুড়ে দিল।
আমি একবার বলেছিলাম ,সারাজীবন এই করে কাটাবি নাকি? সে বলল, অসুবিধা কী? তুই তো কিছু না-করেই কাটাচ্ছিস।
আমার অবস্থা ভিন্ন । আমার ভেবেছিলাম , একবার হয়তো জিজ্ঞেস করবে কিসের এক্রপেরিমেন্ট, তাও করল না । আসলেই তার জীবনে কোনো কৌতূহল নেই।
রূপাকে অনেক বলেকয়ে একবার রাজি করেছিলাম যাতে সে মজিদকে নিয়ে চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরে আসে।আমার দেখার ইচ্ছা একটি অসম্ভব রূপবর্তী এবং বুদ্ধিমর্তী মেয়েকে পাশে পেয়ে তার মনের ভাব কী হয় । আগের মতোই সে কী নির্লিপ্ত থাকে,না জীবন সম্পর্কে খানিকটা হলেও আগ্রহী হয়। আমার প্রস্তাবে রূপা প্রথমে খুব রাগ করল। চোখ তীক্ষ্ণ করে বলল, তুমি নিজে কখনো আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছ? চিনি না জানি না একটা ছেলেকে নিয়ে আমি যাব।তুমি আমাকে পেয়েছ কী?
সে যতই রাগ করে, আমি ততই হাসি। রূপাকে ঠান্ডা করার এই একটা পথ। সে যত রাগ করবে আমি তত হাসব।আমার হাসি দেখে সে আরো রাগবে। আমি আরো হাসব।সে হাল ছেড়ে দেবে। এবারো তাই হলো।সে মজিদকে নিয়ে যেতে রাজি হলো । আমি একটা ছুটির দিনে মজিদকে বললাম,তুই চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরে আয়। পত্রিকায় দেখলাম জিরাফ এনেছে।
মজিদ বলল, জিরাফ দেখে কী হবে?
কিছুই হবে না । তবু দেখে আয় ।
ইচ্ছে করছে না।
আমার এক দূর-সম্পর্কের ফুপাতো বোন-বেচারির চিড়িয়াখানা দেখার শখ। সঙ্গে কোনো পুরুষমানুষ না থাকায় যেতে পারছে না । আমার আবার জন্তু জানোয়ার ভালো লাগে না । তুই তাকে নিয়ে যা।
মজিদ বলল, আচ্ছা।
আমার ধারণা ছিল রূপাকে দেখেই মজিদ একটা ধাক্কা খাবে। সে রকম কিছুই হলো না । রুপা গাড়ি নিয়ে এসেছিল, মজিদ গম্ভীরমুখে ড্রাইভারের পাশে বসল।
রূপা হাসি মুখে বলল, আপনি সামনে বসছেন কেন? পেছনে আসুন। দু জন গল্প করতে করতে যাই ।মজিদ বলল, আচ্ছা।
পেছনে এসে বসল।তার মুখ ভাবলেশহীন। একবার ভালো করে দেখলও না তার পাশে যে বসে আছে সে মানবী না অপ্সরী।
ফিরে আসার পর জিজ্ঞেস করলাম,কেমন দেখলি?
ভালোই।
কথা হয়েছে রূপার সঙ্গে?
হুঁ ।
কী কথা হলো?
মনে নেই।
আচ্ছা রূপার পরনে কী রঙের শাড়ি ছিল বল তো?
লক্ষ্য করি নি তো ।
আমি মজিদের সঙ্গে অনেক সময় কাটাই। রাতে তার সঙ্গে এক চৌকিতে ঘুমাই। তার কাছ থেকে শিখতে চেষ্টা করি কী আশেপাশের জগৎ সম্পর্কে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হওয়া যায়। সাধু-সন্ন্যাসীরা অনেক সাধনায় যে স্তরে পৌছেন মজিদ সে স্তরটি কী এত সহজে অতিক্রম করল তা আমার জানতে ইচ্ছা করে।
আমার বাবা তাঁর খাতায় আমার জন্য যেসব উপদেশ লিখে রেখে গেছেন তার মধ্যে একটার শিরোনাম হচ্ছে : নির্লিপ্ততা। তিনি লিখেছেন-
নির্লিপ্ততা
পৃথিবীর সকল মহাপুরুষ এবং মহাজ্ঞানীরা এই জগৎকে মায়া বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আমি আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় দেখিয়াছি আসলেই মায়া। স্বামী ও স্ত্রীর প্রেম যেমন মায়া বই কিছুই নয়, ভ্রাতা ও ভগ্নীর স্নেহ সম্পর্কেও তাই । যে কারণে স্বার্থে আঘাত লাগিবা মাত্র–স্বামী-স্ত্রীর প্রেম বা ভ্রাতা-ভগ্নীর ভালোবাসা কর্পূবের মতো উড়িয়া যায়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীর সর্ববিষয়ে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হইতে হইবে। কোনোকিছুইর প্রতিই তুমি যেমন আগ্রহ বোধ করিবে না আবার অন্যগ্রহও বোধ করিবে না। মানুষ মায়ার দাস। সেই দাসত্ব শৃঙ্খল তোমাকে ভাঙ্গিতে হইবে। মানুষের অসাধ্য কিছুই নাই। চেষ্টা করিলে তুমি তা পারিবে। তোমার ভেতরে সে ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বিকাশের চেষ্টা আমি তোমায় শৈশবেই করিয়াছি। একই সঙ্গে তোমাকে আদর এবং অনাদর করা হয়েছে। মাতার প্রবল ভালোবাসা হইতেও তুমি বঞ্জিত হইয়াছ। এই সমস্তই একটি পরীক্ষার অংশ। এই পরীক্ষায় সফলকাম হইতে পারিলে প্রমাণ হইবে যে ইচ্ছা করিলে মহাপুরুষদের এই পৃথিবীতে তৈরী করা যায়।
যদি একটি সাধারণ কুকুরকে ও যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, সেই কুকুর শিকারি কুকুরে পরিণিত হয়। এক জন ভালোমানুষ পরিবেশের চাপে ভয়াবহ খুনিতে রূপান্তরিত হয়। যদি তাই হয় তবে কেন আমরা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী মানব-সম্প্রদায় তৈরি করিতে পারিব না?
বাবা আমার ভেতর থেকে মায়া কাটানোর চেষ্টা করেছেন। শৈশবের কথা কিছু মনে আছে। একটা খেলনা হয়তো আমার খুব পছন্দ হলো। তিনি কিনে আনলেন। গভীর আনন্দে আমি আত্মহারা । তখন হঠাৎ বাবা বললেন, আচ্ছা আয় এইবার এই খেলনা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলি। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,কেন?
এমনি।
বাবা একটা হাতুরি নিয়ে খেলনা ভাঙতে বসতেন। আমি কাঁদো-কাঁদো চোখে তাকিয়ে দেখতাম।
একবার খাঁচায় করে একটা টিয়াপাখি নিয়ে এলেন । কী সুন্দর সবুজ রঙ। লাল টুকটুকে ঠোঁট। আমি বললাম, বাবা আমার কি এটা পুষব?
তিনি হাসিমুখে বললেন হ্যাঁ। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি বললাম, টিয়াপাখি কী খায় বাবা?
শুকনো মরিচ খায়।
ঝাল লাগে না?
না। একটা শুকনোমরিচ নিয়ে এসে দাও দেখবে কীভাবে কপকপ করে খাবে।
আমি ছুটে গেলাম শুকনোমরিচ আনতে । মরিচ এনে দেখি বাবা টিয়াপাখিটা গলা টিপে মেরে ফেলেছেন । এমন সুন্দর একটি পাখি মরে আছে । ভয়ংকর একটা ধাক্কা লাগল । বাবা বলেলন, মন খারাপ করবি না । মৃত্যু হচ্ছে এ জগতের আদি সত্য।
তিনি তাঁর পুত্রের মন থেকে মায়া কাটাতে চেষ্টা করেছেন।
তাঁর চেষ্টা কতটা সফল হয়েছে? মায়া কি কেটেছে? আমার তো মনে হয় না। এই যে মজিদ চুপচাপ বসে আছে , পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছে-কেন জানি বড় মায়া লাগছে তাকে দেখে। এই মায়া আমার বাবা শত ট্রেনিঙেও কাটাতে পারেন নি। অথচ মজিদকে ছাত্র হিসেবে পেলে বাবার লাভ হত।
মজিদ।
কী?
আমার হাতে একটা চাকরি আছে করবি?
কী চাকরি?
কী চাকরি জানি না। আমার বড়ফুপা বলেছিলেন জোগাড় করে দিতে পারেন।
তিনি আমাকে চেনেন কীভাবে?
তোকে চেনন না । চাকরিটা আমার জন্য । তবে আমি তোকে পাইয়ে দেব।
দরকার নেই।
দরকার নেই কেন?
টাকা- পয়সার টানাটানি তো এখন আর আগের মতো নেই। দেশে এবার থেকে আর পাঠাতে হবে না।
কেন?
বাবা মারা গেছেন ।
সেকি !
আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম । মজিদ বলল, এত অবাক হচ্ছিস কেন?
বুড়ো হয়েছে মারা গেছে। কিছুদিন পর আর বোনকেও টাকা পাঠাতে হবে না ।
সে ও কি মারা যাচ্ছে?
না । তার ছেলে পাস করে গেছে । বি এ পাস করেছে । চাকরিবাকরি কিছু পেয়ে যাবে।
তুই চাস না তোর একটা গতি হোক?
আরে দূর দূর । ভালোই তো আছি ।
মজিদ হাই তুলল। আমি বললাম ভাত খেয়েছিস?
না , চল খেয়ে আসি ।
রাস্তায় নেমেই মজিদ বলল, বিয়েবাড়ি ু টাড়ি কিছু পাওয়া যায় কি না খুঁজে দেখবি? বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে।
আমি বললাম, বিয়েবাড়ি খুঁজতে হবে না । চল পুরনো ঢাকায় নিয়ে গিয়ে তোকে বিরিয়ানি খাওয়াব। টাকা আছে।
আবার এতদূর যাব? আজ ছুটির দিন ছিল। একটু হাঁটলেই বিয়েবাড়ি পেয়ে তোকে বিরিয়ানি খাওয়াব। টাকা আছে।
তুই কি একটা বিয়ে করবি নাকি?
আমি? আরে দূর দূর । বিয়ে করা মানে শতকে যন্ত্রণা। শতকে দায়িত্ব ভালো লাগে না ।
সিগারেট খাবি?
মজিদ হ্যাঁ-না কিছুই বলল না । দিলে খাবে । না দিলে খাবে না ।
আমি রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম । মজিদ নির্লিপ্ত ভঙিতে টানছে । আমি বললাম, তুই দিন দিন কী হয়ে যাচ্ছিস বল তো?
কী হচ্ছি?
গাছ হয়ে যাচ্ছিস ।
সত্যি সত্যি গাছ হতে পারলে ভালোই হত।
আমরা রিকশার খোঁজে বড়রাস্তা পযর্ন্ত চলে এলাম। রিকশা আছে তবে ওরা কেউ পুরনো ঢাকার দিকে যাবে না । দূরের ট্রিপে ওদের ক্ষতি । কাছের ট্রিপে পয়সা বেশি, পরিশ্রম ও কম। এতকিছু মাথায় ঢুকবে না এ রকম বোকা এক জন রিকশাঅলার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
মজিদ।
বল।
তুই দেখ রিকশা পাস কিনা । আমি চট করে একটা টেলিফোন করে আসি।
আচ্ছা ।
আমি টেলিফোন করতে ঢুকলাম তরঙ্গিণী নামের ষ্টেশনারী দোকানে।
আজকাল চমৎকার সব দোকান হয়েছে । এদের নামও যেমন সুন্দর ,সাজসজ্জাও সুন্দর। আমাকে দেখেই দোকানের সেলসম্যান-জামান এগিয়ে এল। এই ছেলের বয়স অল্প। সুন্দর চেহারা । একদিন দেখি দোকানে আর আসছে না। মাস দু এক পরে আবার এসে উপস্থিত- সমস্ত মুখভরতি বসন্তের দাগ। ব্যাপারটা বিস্ময়কর,কারণ পৃথিবী থেকে বসন্ত উঠে গেছে। এই ছেলে সেই বসন্ত পেল কী করে? সবসময় ভাবি জিজ্ঞেস করব, জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না । তার মূখে দাগ হবার পর তার ব্যবহার খুব ভালো হয়েছে। আগে খুব খারাপ ব্যবহার ছিল ।
জামান হাসি মূখে বলল, স্যার ভালো আছেন?
হুঁ ।
টেলিফোন করবেন?
যদি টেলিফোনে ডায়াল টোন থাকে এবং টেলিফোনের চাবি থাকে তাহলে করব। দুইটা টেলিফোন করব- এই যে চার টাকা।
টাকা দিয়ে সবসময় লজ্জা দেন স্যার ।
লজ্জার কিছু নেই । টেলিফোন শেষে আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। প্রায়ই জিজ্ঞেস করব ভাবি কিন্তু মনে থাকে না । আজ আপনি মনে করিয়ে দিবেন।
জি আচ্ছা ।
আমার সামনে টেলিফোন দিয়ে জামান সরে গেল।
এইটুকু ভ্রদতা আছে। অধিকাংশ দোকানেই টেলিফোন করতে দেয় না ।
টাকা দিয়েও না। যদিও দেয় – রিসিভারের আশেপাশে ঘুরঘুর করে কী কথা হচ্ছে শুনবার জন্য।
হ্যালো কে কথা বলেছেন?
তুমি কী মীরা?
হ্যাঁ হ্যাঁ আমি মীরা । আপনি কে আমি বুঝতে পারছি – আপনি টুটুল।
আসল জন না । নকল জন।
ঐ দিন খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন কেন? আমার অসম্ভব কষ্ট হয়েছিল ।
টেলিফোন নামিয়ে রাখি নি তো , হঠাৎ লাইন কেটে গেল।
আমিও তাই ভেবেছিলাম । অনেকক্ষণ টেলিফোনের সামনে বসেছিলাম। লাইন কেটে গেল তাহলে আবার করলেন না কেন?
টাকা ছিল না ।
টাকা ছিল না মানে?
আমি তো বিভিন্ন দোকান-টোকান থেকে টেলিফোন করি। দুইটা টাকা পকেটে নিয়ে যাই । আরেকবার করতে হলে আরো দুই টাকা লাগবে। বুঝতে পারছ?
পারছি। এখন আপনার সঙ্গে টাকা আছে তো?
আছে।
ঐদিন আপনার টেলিফোন পাওয়ার পর বাবাকে সব বললাম। বাবাকে তো চেনেন না। বাবা খুবই রাগী মানুষ । তিনি প্রথমে আমাদের দুই জনকে খুব বকা দিলেন- আপনাকে রাস্তা থেকে তোলার জন্য এবং পথে নামিয়ে দেবার জন্য। তারপর…আচ্ছা আপনি আমার কথা শুনছেন তো?
হ্যাঁ শুনছি ।
তারপর বাবা গাড়ি বের করে থানায় গেলেন । ফিরে এলেন মন খারাপ করে।
মন খাারাপ করে ফিরলেন কেন?
কারণ ওসি সাহেব আপনার সম্পর্কে অদ্ভুত কথা বলেছেন। আপনি নাকি পাগল ধরনের। তার উপর কবি।
আমি কবি?
হ্যাঁ। আপনি যে, কবিতার খাতাটা থানায় ফেলে এসেছিলেন বাবা সেইটিও নিয়ে এসেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ । আমি সবগুলো কবিতা পড়েছি।
কেমন লাগল?
ভালো । অসাধারণ।
সবচে ভালো লাগল কোন্টা?
বলব? আমার কিন্তু মুখস্থ। কবিতাটার নাম রাত্রি।
পরীক্ষা নিচ্ছি। দেখি সত্যি সত্যি তোমার মুখস্থ কিনা কবিতাটা বল।
মীরা সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করল :
অতন্দ্রিলা,
ঘুমাওনি জানি
তাই চুপিচুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে বলি শোন,
সৌর তারা-ছাওয়া এই বিছানায় – সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি
কত দীর্ঘ দুজনার গেল সারাদিন.
আলাদা নিশ্বাসে-
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দুজনে , দুজনা
অতন্দ্রিলা,
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছনার পরে জোছনা।
দেখি তুমি নেই।
কবিতা সে আবৃত্তি করল চমৎকার। আবৃত্তির শেষে ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল,কি বলতে পারলাম?
হ্যাঁ পারলে। তোমার স্মৃতিশক্তি ভালো , তবে কবিতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
কেন এটা কি ভালো কবিতা না?
অবশ্যই ভালো । তবে আমার লেখা না। অমিয় চক্রবর্তীর।
আপনার নোটবইয়ের সব কবিতাই কি অন্যের?
হ্যাঁ। মাঝে মাঝে কিছু কবিতা পড়ে মনে হয় এগুলো আমারই লেখার কথা ছিল, কোনো কারণে লেখা হয় নি । তখন সেটা নোটবুকে টুকে রাখি।
আপনি কি খুব কবিতা পড়েন?
না। একেবারে না । তবে আমার এক জন বান্ধবী আছে সে খুব পড়ে এবং জোর করে আমাকে কবিতা শোনায় ।
ওর নাম কী?
ওর নাম রুপা। তবে আমি তাকে মাঝে মাঝে ময়ূরাক্ষী ডাকি।
বাহ্ কি সুন্দর নাম ।
সে কিন্তু এই নাম একবারেই পছন্দ করে না ।
কেন বলুন তো?
কারণ এই নামে এলিফেন্ট রোডে একটা জুতার দোকান আছে।
মীরা খিলখিল করে হেসে উঠল।
অনেকক্ষণ পযর্ন্ত হাসল। মনে হলো মেয়েটা যে পরিবেশে বড় হচ্ছে সেই পরিবেশে কেউ রসিকতা করে না । সবাই গম্ভীর হয়ে থাকে। সামান্য রসিকতায় এই কারণেই সে এতক্ষণ ধরে হাসছে।
হ্যালো , আপনি কিন্তু টেলিফোন রাখবেন না ।
আচ্ছা রাখব না।
ঐদিন আপনার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে এমন হয়েছে টেলিফোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই। মনে হয় আপনি টেলিফোন করেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ । আরেকটা ব্যাপার বলি- মা আপনার জন্য খুব চমৎকার একটা পাঞ্জাবি কিনে রেখেছেন। ঐ পাঞ্জাবিটা নেয়ার জন্যে হলেও আপনাকে আমাদের বাসায় আসতে হবে।
আসব।
কবে আসবেন?
টুটুলকে খুঁজে পেলেই আসব।
আপনি ওকে কোথায় খুঁজে পাবেন?
আমি খুব সহজেই পাব। হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আমার খুব নাম ডাক আছে।
আচ্ছা ঐদিন আপনি কী করে বললেন যে টুটুল ভাইয়ের কপালে একটা কাটা দাগ আছে?
আমার কিছু সুপারন্যাচারাল ক্ষমতা আছে। আমি মাঝে মাঝে অনেক কিছু বলতে পারি।
বলুন তো আমি কী পরে আছি?
তোমার পরনে আকাশি রঙের শাড়ি ।
হলো না । আপনার আসলে কোনো ক্ষমতা নেই।
ঠিক ধরছে।
কিন্তু আপনি যখন বলেছিলেন যে আপনার সুপারন্যাচারাল ক্ষমতা আছে, আমি বিশ্বাস করেছিলাম।
মনে হয়েছে তোমার একটু মন খারাপ হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে।
টেলিফোন কি রেখে দেব?
না না – প্লিজ আপনার ঠিকানা বলুন।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। আর না । মজিদ বোধহয় রিকশা ঠিক করে ফেলেছে। তবে ঠিক করলেও সে আমাকে বলবে না । অপেক্ষা করবে। এর মধ্যেই অতি দ্রুত রূপার সঙ্গে একটা কথা সেরে নেয়া দরকার ।
আমি টেলিফোন করতেই রূপার বাবা ধরলেন । আমি গম্ভীর গলায় বললাম, এটা কি রেলওয়ে বুকিং?
তিনি ক্ষিপ্ত গলায় বলেলন, ফাজিল ছোকরা , হু আর ইউ? কী চাও তুমি?
রূপাকে দেবেন?
রাসকেল, ফাজলামি করার জায়গা পাও না । আমি তোমাকে এমন শিক্ষা দেব।
আপনি এত রেগে গেছেন কেন?
শাট আপ ।
আমি ভদ্রলোককে আরো খানিকক্ষণ হইচই করার সুযোগ দিলাম। আমি জানি হইচই শুনে রূপা এসে টেলিফোন ধরবে। হলোও তাই , রূপার গলা শোনা গেল- । সে করুণ গলায় বলল, তুমি চলে এস।
কখন?
এই এখন । আমি বারান্দায় দাড়িয়ে থাকব।
আচ্ছা আসছি।
অনেকবার আসছি বলেও তুমি আস নি- এইবার যদি না আস তাহলে ….
তাহলে কী?
রূপা খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল,আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব।
রূপার বাবা সম্ভবত তার হাত থেকে টেলিফোনটা কেড়ে নিলেন। খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হলো । আজ ওদের বাড়িতে ভূমিকম্প হয়ে যাবে। রূপার বাবা,মা,ভাই-বোন কেউ আমাকে সহ্য করতে পারে না । রূপার বাবা তাঁর দারোয়ানকে বলে রেখেছেন কিছুতেই যেন আমাকে ঐ বাড়িতে ঢুকতে না দেয়া হয়। আজ কী হবে কে জানে?
বাইরে এসে দেখি মজিদ রিকশা ঠিক করেছে। রিকশাঅলা রিকশার সিটে বসে ঘুমাচ্ছে। মজিদ শান্তমূখে ড্রাইভারের পাশে বসে বিশ্রাম করছে। আমার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। আজও জামানকে জিজ্ঞেস করা হলো না- তার
মুখে বসন্তের দাগ হলো কী করে। কিছু কিছু প্রশ্ন আছে যা কোনোদিনও করা হয় না । এটিও বোধহয় সেই জাতীয় কোনো প্রশ্ন।
বিরিয়ানি খেয়ে অনেক রাতে ফিরলাম ।
অসহ্য গরম।
সেই গরমে ছোট্ট একটা চৌকিতে আমি এবং মজিদ শুয়ে আছি । মজিদের হাতে হাতপাখা । সে দ্রুত তার পাখা নাড়ছে । গরম তাতে কমছে না, বরং বাড়ছে। মনে হচ্ছে ময়ূরাক্ষী নদীটাকে বের করতে হবে। নয়তো এই দুঃসহ রাত পার করা যাবে না ।
মজিদের হাতপাখার আন্দোলোন থেমে গেছে । সে গভীর ঘুমে অচেতন । ঘরে শুনশান নীরবতা । আমি ময়ূরাক্ষী নদীর কথা ভাবতে শুরু করলাম। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্য পাল্টে গেল। এই নদী একেক সময় একেক ভাবে আসে । আজ এসেছে দুপুরের নদী হয়ে। প্রখর দুপুর । নদীর জলে আকাশের ঘন নীল ছায়া । ঝিম ধরে আছে চারদিক। হঠাৎ নদী মিলিয়ে গেল। মজিদ ঘুমের মধ্যেই বিশ্রী শব্দ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।
এই মজিদ এই।
মজিদ চোখ মেলল।
কী হয়েছে রে?
কিছু না ।
স্বপ্ন দেখেছিস?
হুঁ ।
দুঃস্বপ্ন?
না।
কী স্বপ্ন দেখেছিস বলত?
মজিদ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ক্ষীণস্বরে বলল, স্বপ্নে দেখলাম বাবা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
মজিদ শুয়ে পড়ল। আমি জানি না মজিদের বাবা কীভাবে তার গায়ে হাত বুলাতেন। আমার ইচ্ছা করছে ঠিক সেই ভঙ্গিতে মজিদের গায়ে হাত বুলাতে।
হিমু।
কী?
আমার বাবা আমাকে খুব আদর করত। সব বাবারাই করে। আমার বাবা খুব বেশি করত । একদিন কী হয়েছে জানিস–
বল শুনছি।
না থাক।
থাকবে কেন শুনি। এই গরমে ঘুম আসছে না। তোর গল্প শুনলে ভালো লাগবে।
আমি তখন খুব ছোট…
তারপর?
না থাক।
মজিদ আর শব্দ করল না । ঘরের ভেতর অসহ্য গরম। আমি অনেক চেষ্টা করেও নদীটা আনতে পারছি না । আজ আর পারব না । আজ বরং বাবার কথাই ভাবি। আমার বাবা কি আমাকে ভালোবাসতেন? নাকি আমি ছিলাম তাঁর খেলার কোনো পুতুল? যে পুতুল তিনি নানাভাবে ভেঙে নতুন করে তৈরি করতে চেষ্টা করেছিলেন।
কত রকম উপদেশ তিনি তাঁর খাতা ভরতি করে রেখেছেন। মৃত্যুর আগের মূহুর্তে হয়তো ভেবেছেন- এইসব উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব। আমি কি সেইসব উপদেশ মানি? নাকি মানার ভান করি। তাঁর খাতায় লেখা:
উপদেশ নম্বর এগার
সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান
সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান করিবে। ইহাতে আত্মার উন্নতি হইবে। সৃষ্টিকর্তাকে জানা এবং আত্মাকে জানা একই ব্যাপার। স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিও–
বহুরূপে সম্মুখে তোমার ,
ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
মজিদ আবার কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তবে কাঁদছে ঘুমের মধ্যে। সে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। সে কি প্রতিরাতেই কাঁদে?
০৬.
বড়ফুপু অবাক হয়ে বললেন, তুই কোথেকে?
আমি বললাম, আসলাম আর কি। তোমাদের খবর কী?
পনের দিন পর উদয় হয়ে বললি–তোমাদের খবর কী? তোর কত খোঁজ করছি । গিয়েছিলি কোথায়?
মজিদের গ্রামের বাড়িতে । মজিদকে নিয়ে ওর বাবার কবর জিয়ারত করে এলাম।
মজিদ আবার কে?
তুমি চিনবে না । আমার ফ্রেন্ড। আমাকে এত খোঁজাখুঁজি করছিলে কেন?
বড়ফুপূ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তোকে খুঁজছি বাদলের জন্যে। ওকে তুই বাঁচা।
অসুখ?
তুই নিজে গিয়ে দেখ। ও তার পড়ার বইপত্র সব পুড়িয়ে ফেলছে। এক সপ্তাহ পরে পরীক্ষা ।
বল কী !
বাদলের ঘরে গিয়ে দেখি সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পড়াশুনা করছে। পরিবর্তনের মধ্যে তার মাথার চুল আরো বড় হয়েছে। দাড়িগোঁফ আরো বেড়েছে। গায়ে চকচকে সিল্কের পাঞ্জাবি । বাদল হাসিমুখে আমার দিকে তাকাল।
আমি বললাম,খবর কিরে?
বাদল বলল,খবর তো ভালোই ।
তুই নাকি বই পুড়াচ্ছিস।
সব বই তো পুড়াচ্ছি না। যে গুলো পড়া হচ্ছে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলছি।
ও আচ্ছা ।
বাদল হাসতে হাসতে বলল, মা-বাবা দুই জনেরই ধারণা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
তোর কী ধারণা মাথা ঠিকই আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে–তবে মাথায় উঁকুন হয়েছে।
বলিস কী?
মাথা ঝাঁকি দিলে টুপটাপ করে উঁকুন পড়ে
বলিস কী?
হ্যাঁ সত্যি। দেখবে?
থাক থাক দেখাতে হবে না ।
হিমু ভাই, তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে, বাবাকে বুঝিয়ে যাও। বাবার ধারণা আমার সব শেষ।
ফুপা কি বাসায়?
হ্যাঁ বাসায় । কিছুক্ষণ আগে আমার ঘরে ছিলেন। নানান কথা বুঝাচ্ছেন।
আমি ফুপার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম । তাঁর স্বাস্থ্য এই কদিনে মনে হয় আরো ভেঙ্গেছে। চোখের চাউনিতে দিশেহারা ভাব। তিনি আমার দিকে বিষণ্নচোখে তাকালেন। যে দৃষ্টি বলে দিচ্ছে তুমিই আমার ছেলের এই অবস্থার জন্যে দায়ী। তোমার জন্যে আমার এ অবস্থা ।
কেমন আছেন ফুপা?
ভালো ।
রিনকি কোথায়? শ্বশুরবাড়িতে?
হ্যাঁ ।
সন্ধ্যাবেলায় ঘরে বসে আছেন যে? প্রাকটিসে যাবেন না?
আর প্রাকটিস । সব মাথায় উঠেছে।
আমি ফুপার চেয়ারে বসলাম। মনে হচ্ছে আজও তিনি খানিকটা মদ্য পান করেছেন । আমি সহজ গলায় বললাম, ফুপা ঐ চাকরিটা কি আছে?
কোন চাকরি?
ঐ যে আমাকে বলেছিলেন বাদলকে আগের অবস্থায় নিয়ে গেলে ব্যবস্থা করে দেবেন।
তুমি চাকরি করবে? নতুন কথা শুনছি ।
আমি করব না, আমার এক বন্ধুর জন্যে।
ফুপা চুপ করে রইলেন। আমি বললাম,বাদলের ব্যাপারটা আমি দেখছি-আপনি ওর চাকরিটা দেখুন।
বাদলের কিছু তুমি করতে পারবে না। ও এখন সমস্ত চিকিৎসার অতীত।
বইপত্র পুড়িয়ে ফেলছে। ছাদে আগুন জ্বালিয়েছে। সেই আগুনের সামনে মাথা। ঝাঁকাচ্ছে আর মাথা থেকে উকুন পড়েছে আগুনে। পট পট শব্দ হচ্ছে । ছিঃ ছিঃ কী কান্ড। আমি হতভস্ব হয়ে দেখলাম। একবার ভাবলাম একটা চড় লাগাই , তারপর মনে হলো–কী লাভ !
ফুপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
আমি হাসলাম।
ফুপা বললেন,তুমি হাসছ? তোমার কাছে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হতে পারে , আমার কাছে না ।
আমি বাদলের ব্যাপারটা দেখছি, আজই দেখছি। আপনি আমার বন্ধুর চাকরির ব্যাপারটা দেখবেন।
তোমার বন্ধু কি তোমার মতোই?
না। ও চমৎকার ছেলে। সাত চড়ে রা নেই টাইপ।
আমি বাদলকে নিয়ে বের হলাম।
বাদল মহাখুশি ।
রাস্তায় নেমেই বলল, তোমার পরিকল্পনা কী হিমু ভাই? সারারাত রাস্তায় হাঁটব? দুই বছর আগের কথা কি তোমার মনে আছে? সারারাত আমরা হাঁটলাম। জোছনা রাত। মনে হচ্ছিল আমরা দস্তয়োভস্কির উপন্যাসের কোনো চরিত্র । মনে আছে?
আছে?
আজও কি সেই রকম কিছু?
না । আজ যাচ্ছি সেলুনে দাড়িগোঁফ কামাব।
বাদল হতভস্ব হয়ে গেল। যেন এমন অদ্ভুত কথা সে জীবনে শুনেছি।
ক্ষীণস্বরে বলল–দাড়িগোঁফ, লম্বা চুলে তোমাকে যে কী অদ্ভুত সুন্দর লাগে তা তো তুমি জানো না। তোমাকে অবিকল রাসপুটিনের মতো লাগে।
রাসপুটিনের মতো লাগলেও ফেলে দিতে হবে। এক জিনিস বেশিদিন ধরে রাখতে নেই। ভোল পাল্টাতে হয়। অনেকটা সাপের খোলস ছাড়ার মতো। কিছুদিন অন্য সাজে থাকব, তারপর আবার…
তাহলে কি আমিও ফেলে দেব?
দেখ চিন্তা করে।
অবশ্য উকুনের জন্য কষ্ট হচ্ছে । ভয়ংকর চুলকায় । রাতে ঘুম ভালো হয় না ।
তাহলে বরং ফেলেই দে।
তুমি ফেললে তো ফেলবই।
বাদল হাসতে লাগল। মনে হচ্ছে গভীর কোনো আনন্দে তার হৃদয় পূর্ণ হয়ে আছে ।
দুইজনে চুল কেটে দাড়িগোঁফ ফেলে দিলাম।
বাদল কয়েকবারই বলল, ভীষণ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে বাতাসে উড়ে যাব।
আমি বললাম , আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখ। নিজেকে অন্য মানুষ বলে মনে হচ্ছে না?
হ্যাঁ হচ্ছে ।
মাঝে মাঝে নিজেকে অচেনা করাও দরকার । যখন যে সাজ ধরবি, সেই রকম ব্যবহার করবি। একে বলে ব্যক্তিত্ব রূপান্তর। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
ফুপা এবং ফুপু তাদের ছেলেকে দেখে দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। সবার আগে নিজেকে সামলে নিলেন ফুপা। আমার দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বললেন, তোমার বন্ধুকে নিয়ে কাল আমার †P¤^v‡i এসো । এগারটা থেকে বারোটার মধ্যে । মনে থাকবে?
হ্যাঁ থাকবে।
হিমু মেনি থ্যাংকস।
আমি হাসলাম।
ফুপা বললেন, আমার ঘরে এসো। গল্প করি। তোমার সঙ্গে গল্পই করা হয় না ।
আমি বললাম , আপনি যান আমি আসছি। একটা টেলিফোন করে আসি।
ফুপা বললেন, তোমার এই টেলিফোন ব্যধিরও একটা চিকিৎসা হওয়া দরকার। কার সঙ্গে এত কথা বল? ঘন্টার পর ঘন্টা কথা । আমার তো দুটো কথা বললেই বিরক্ত লাগে।
ও পাশ থেকে হ্যালো শুনোই আমি বললাম , কে মীরা?
আপনি আমাদের এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন?
কষ্ট দিচ্ছি?
হ্যাঁ দিচ্ছেন। না হয় একটা ভুল করেছিলাম । সব মানুষই তো ভুল করে। সামান্য ভুলের জন্যে যদি এত কষ্ট দেন।
আমি টেলিফোন করলে কষ্ট পাও?
হ্যাঁ পাই। কারণ আপনি হঠাৎ রেখে দেন। আপনি কি মানুষটাই এমন, না ইচ্ছা করে এসব করেন?
বেশির ভাগ সময় ইচ্ছা করেই করি।
আপনি একবার আসবেন আমাদের বাসায়?
এখনো বুঝতে পারছি না। হয়তো আসব।
কবিতার খাতাটা নিতে আসবেন না?
ওটা আমি তোমাকে উপহার দিলাম মীরা ।
তার মানে আপনি আসবেন না?
না। মানুষের মুখোমুখি হতে আমার ভালো লাগে না। এতে অতি দ্রুত মায়া পড়ে যায়। টেলিফোনে কথা বললে মায়া জন্মানোর সম্ভাবনা কম, সেইজন্যেই টেলিফোন আমার এত প্রিয় । টেলিফোনে কথা বললে মায়া জন্ম্ায় না। মায়া জন্মানোর অনেক কষ্ট। তা ছাড়া –
তাছাড়া কী?
থাক আরেক দিন বলব।
আপনার বান্ধবী রূপার সঙ্গে কি আপনার প্রায়ই দেখা হয়?
মাঝে মাঝে হয়। যখন সে যেতে বলে তখন যাই না। যখন যেতে বলে না তখন হঠাৎ উপস্থিত হই।
উনি কি খুবই সুন্দর?
তোমাকে তো একবার বলেছি- ও খুবই সন্দর।
আপনি টেলিফোন রেখে দেবার আগে দয়া করে শুধু একটি সত্যিকথা বলুন।
আমি তো সবই সত্যি বলছি। কী জানতে চাচ্ছ বল তো?
ঐদিন কি পুলিশ আপনাকে মেরেছিল?
না ।
এইতো মিথ্যা বললেন।
আজ সত্যি বলছি । ঐদিই মিথ্যা বলেছিলাম।
আপনার কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা কে জানে?
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনাকে একটা খবর দেই। টুটুল ভাইকে পাওয়া গেছে। কাউকে কিছু না বলে একমাসের জন্যে কোলকাতা গিয়েছিল। মজার ব্যাপার কী জানেন ! এখন আর আমার টুটুল ভাইকে ভালো লাগছে না । ঐদিন টেলিফোন করেছিল আমি কথাও বলি নি । আমার এ রকম হলো কেন বলুন তো?
আমি টেলিফোন রেখে ফুপার খোঁজে গেলাম।
তিনি ছাদে । হুইস্কির বোতল খোলা হয়েছে। বরফের পাত্র , ঠান্ডা পানি, প্লেটে ভিনিগার মেশানো চিনাবাদাম। আমাকে দেখেই তিনি খুশি-খুশি গলায় বললেন, বাদলের পরিবর্তনটা সেলিব্রেট করছি।
ফুপু রাগ করবেন না?
না , তাকে বলেছি । আজ সে কোনোকিছুতেই রাগ করবে না। বমি করে যদি সারা ঘর ভাসিয়ে দেই তবু রাগ করবে না । তুমি বস হিমু। আরাম করে বস। সম্পর্কে মিশ খাচ্ছে না। মিশ খেলে তোমাকেও খানিকটা দিতাম।
আপনি ক পেপ খেয়েছেন?
আরে না । মাত্র তো শুরু । আমি নটা পর্যন্ত পারি। আমার কিছুই হয় না ।
ঐদিন বলেছিলেন ছটা ।
বলেছিলাম? বলে থাকলে
ভূল বলেছি । নটা হচ্ছে আমার লিমিট। নাইন। এন আই এন ই । নাইন।
আর খাবেন না ফুপা ।
ফুপা গ্লাসে নতুন করে ঢালতে ঢালতে বললেন, খেতে খেতে তোমার কথাই ভাবছিলাম । তুমি মানুষটা খারাপ না। পগলা আছ তবে ভালো । তোমার বাবা পাগলা ছিল তবে ভালো ছিল না ।
ভালো ছিল না বলছেন কেন?
দেখেছি তো । ও বাড়ি ছেড়ে পালাল আমার বিয়ের অনেক পরে। উন্মাদ ছিল।
ফুপা আপনি কিন্তু বড় দ্রুত খাচ্ছেন। শুনেছি দ্রুত খাওয়া খারাপ।
ফুপা গম্ভীর গলায় বললেন, নাইন হচ্ছে আমার লিমিট। নাইনের আগে স্টপ করে দেব। হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম- আমার ধারণা তোমার বাবা ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণীর উন্মাদ। এটা হচ্ছে আমার ধারণা । তুমি আবার রাগ করছ না তো?
না।
ছেলেকে মহাপুরুষ বানানোর অদ্ভুত খেয়াল উন্মাদের মাথাতেই শুধু আসে বুঝলে? আরে বাবা , মানুষ কী হবে না হবে সব আগে থেকে ঠিক করা থাকে।
কে ঠিক করে রাখেন, ঈশ্বর?
প্রকৃতিও বলতে পার । ফোর্টি সিকা্র ত্রুমোজমে মানুষের ভবিষ্যৎ লেখা থাকে। সে কেমন হবে কী সব কিন্তু প্রিভিটারমিন্ড। জীন সব নিয়ন্ত্রণ করছে। ফুপা আর নেবেন না ।
আরে এখনি বন্ধ করব কী? নেশাটা মাত্র ধরেছে। তুমি মানুষ খারাপ না । I like you . তুমি পাগল ঠিকই তবে ভালো পাগল। তোমার বাবা ছিল খারাপ ধরনের পাগল।
বাবা সম্পর্কে কথাবার্তা থাক ।
ফুপা নিচুগলায় বললেন, কাউকে যদি না বল তাহলে তোমার বাবার সম্পর্কে আমার একটি ধারণা কথা বলতে পারি। আমি আর কাউকে বলি নি । শুধু তোমাকেই বলছি।
বাদ দিন, কিছু বলতে হবে না ।
জাস্ট আমার একটা ধারণা । ভুলও হতে পারে। আমার বেশিরভাগ ধারণাই ভুল প্রমাণিত হয়। হা – হা – হা। আমার বোধহয় আর খাওয়া উচিত হবে না। শুধু লাস্ট ওয়ান হয়ে যাক। ওয়ান ফর দি রোড। হিমু।
জি।
তোমার যদি ইচ্ছা করে খানিকটা খেয়ে দেখতে পার । উল্টোদিকে ফিরে খেয়ে ফেল। আমি কিছুই মনে করব না। আমার মধ্যে কোনো প্রিজুডিস নেই। তুমি হচ্ছ বন্ধুর মতো ।
আমি খাব না । আপনিও বন্ধ করুন।
নটা কি হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
দশে শেষ করা যাক। জোড়সংখ্যা – তারপর তোমার বাবার সম্পর্কে কী যেন বলছিলাম?
কিছু বলছিলেন না।
বলেছিলাম। মনে পড়েছে – আমার কী ধারণা জানো? আমার ধারণা তোমার বাবা, তোমার মাকে খুন করেছিল ।
আমি সহজ গলায় বললাম, এ রকম ধারণা হবার কারণ কী?
যখন তোমার বাবার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হলো তখন সে অনেক কথাই বলল, কিন্তু দেখা গেল নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলছে না । সে কীভাবে মারা গেছে জিজ্ঞেস করেছিলাম। প্রশ্ন শুনে রেগে গিয়ে বলেছিল- অন্য দশটা মানুষ যেভাবে মারা যায় সেইভাবে মারা গিয়েছিল।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, এটা শুনেই আপনি ধরে নিলেন বাবা মাকে খুন করেছেন?
হ্যাঁ । অবশ্য আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আমার অধিকাংশ অনুমানই ভুল হয়।
আমি চুপ করে রইলাম। ফুপার অধিকাংশ অনুমান ভুল হলেও এই অনুমানটি ভুল নয়। এটা সত্যি। আমি এটা জানি। আমি ছাড়াও অন্য কেউ এটা অনুমান করতে পারে, এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।
ফুপা মদের ঘোরে ঝিম মেরে বসে আছেন। আমি আকাশের তারা দেখছি।
হিমু ।
জি।
তোমার বন্ধুকে কাল নিয়ে এসো, চাকরি দিয়ে দেব।
আচ্ছা।
বড় ঘুম পাচ্ছে। এখানেই শুয়ে পড়ি কেমন?
শুয়ে পড়ুন।
ফুপা কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অনেক অনেক দিন আগের কথা বাবা আমাকে ছাদে এনে আকাশের তারা দেখিয়ে বলেছিলেন, যখনই সময় পাবি ছাদে এসে আকাশের তারার দিকে তাকাবি, এতে মন বড় হবে। ক্ষুদ্র শরীরে আকাশের মতো বিশাল মন ধারণ করতে হবে। বুঝলি? বুঝে থাকলে বল – হ্যাঁ।
আমি বললাম, হ্যাঁ।
বাবা হৃষ্টগলায় বললেন, তোর উপর আমার অনেক আশা। অনেক আশা নিয়ে তোকে বড় করছি। তোর মা বেঁচে না – থাকায় খুব সুবিধা হয়েছে। ও বেঁচে থাকলে আদর দিয়ে তোকে নষ্ট করত।আমি যেসব পরীক্ষা- নরীক্ষা করছি তার কিছুই করতে দিত না । পদে পদে বাধা দিত। দিত কি-না বল?
হ্যাঁ দিত।
তোর মা না- থাকায় তাহলে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে তাই না?
হ্যাঁ।
বাবা হঠাৎ গলা নিচু করে বললেন, তোর মা যে নেই এর জন্যে আমার উপর কোন রাগ নেই তো?
তোমার উপর রাগ হবে কেন?
বাবা অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন। সেই হাসি আমার বুকে বিঁধল। চট করে মনে পড়ল অনেক অনেক কাল আগে সুন্দর একটা টিয়াপাখিকে বাবা গলা টিপে মেরে ফেলেছিলেন। আমি kvšÍ¯^‡i বললাম, মা কীভাবে মারা গিয়েছিলেন বাবা?
বাবা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এই প্রশ্নের জবাব আমি দেব না । তোকেই খুঁজে বের করতে হবে। শুধু হৃদয় বড় হলেই হবে না,তোকে বুদ্ধিমানও হতে হবে। তোর জ্ঞান এবং বুদ্ধি হবে প্রেরিত পুরুষদের মতো। শুধু একটা জিনিস মনে রাখবি আমি যা করেছি তোর জন্যেই করেছি। আচ্ছা আয় এখন তোকে আকাশের তারাদের নাম শেখাই। একবার কাল পুরুষদের নাম বলেছিলাম না। বল দেখি কোন্টা কাল পুরুষ? এত দেরি করলে তো হবে না । তাড়াতাড়ি বল । খুব তাড়াতাড়ি । কুইক।
আমি ছাদ থেকে নিচে নামলাম।
একধরনের গাঢ় বিষাদ বোধ করছি। এই ধরনের বিষাদ হঠাৎ হঠাৎ আমাকে আক্রমন করে এবং প্রায় সময়ই তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। মহাপুরুষদের কি এমন হয়?
তারাও কি মাঝে মাঝে বিষাদগ্রস্ত হন? হয়তো হন, হয়তো হন না । কোনো এক জন মহাপুরুষের সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম। আমাদের কথাবার্তা তখন কেমন হত? মনে মনে আমি কথোপকথনের মহড়া দিলাম। দৃশ্যটা এ রকম- বিশাল বটবৃক্ষের নিচে মহাপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন।তিনি শীর্ণকায় কিন্তু তাঁকে বটবৃক্ষের চেয়েও বিশাল দেখাচ্ছে । তাঁর গায়ে শাদা চাদর । সেই চাদরে তাঁর মাথা ঢাকা । ছায়াময় বৃক্ষতল। তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুদ কারণে তাঁর জ্বলজ্বলে চোখের কালো মণি দৃশ্যমান। মহাপুরুষের Kɯ^i শিশুর Kɯ^‡ii মতো, কিন্তু খুব মন দিয়ে শুনলে সেই Kɯ^‡i এক জন মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের শ্লেষজড়িত উচ্চারণের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো। এই কথোপকথনের সময় তিনি একবারও আমার দিকে তাকালেন না। অথচ মনে হলো তাকিয়ে আছেন।
মহাপুরুষ : বৎস তুমি কী জানতে চাও?
আমি : অনেক কিছু জানতে চাই। আপনি কি সব প্রশ্নের উত্তর জানেন?
মহাপুরুষ : আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর জানি না, কিন্তু প্রশ্ন শুনতে ভালোবাসি।তুমি প্রশ্ন কর।
আমি : বিষাদ কি?
মহাপুরুষ : বিষাদ কী তাই আমি জানি না। কাজেই বিষাদগ্রস্ত হই কি হই না তা কী করে বলি। তুমি আরো প্রশ্ন কর।
তোমার প্রশ্ন বড়ই আনন্দ বোধ হচ্ছে।
আমি : আনন্দ কী?
মহাপুরুষ : বৎস আনন্দ কি তা আমি জানি না।
আমি : আপনি জানেন এমন কিছু কী আছে?
মহাপুরুষ : না। আমি কিছুই জানি না। বৎস তুমি প্রশ্ন কর।
আমি : আমার প্রশ্ন করার কিছুই নেই। আপনি বিদেয় হোন।
মহাপুরুষ : চলে যেতে বলছ?
আমি : অবশ্যই – ব্যাটা তুই ভাগ।
মহাপুরুষ : তুমি কী আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ?
আমি : হ্যাঁ।
মহাপুরুষ : তাতে লাভ হবে না বৎস। তুমি বোধহয় জানো না আমাদের মান অপমান বোধ নেই।
কথোপকথন আরো চালানোর ইচ্ছা ছিল। চালানো গেল না। ফুপু এসে বললেন, এই তুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিস কেন?
আমি বললাম, কথা বলছি।
কার সঙ্গে বলছিস?
মহাপুরুষদের সঙ্গে।
ফুপু অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই সবসময় এমন রহস্য করিস কেন? তুই আমাকে পেয়েছিস কী? আমাকেও কি বাদলের মতো পাগল ভাবিস? তুই কি ভাবিস বাদলের মতো আমিও তোর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করব।
আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলাম। ফুপু আমার সেই হাসি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন, তু্ই একটা বিয়ে কর। বিয়ে করলে সব রোগ সেরে যাবে।
বিয়ে করাটা ঠিক হবে না ফুপু।
ঠিক হবে না কেন?
যেসব রোগের কথা তুমি বলছ সেইসব রোগ কখনো সারাতে নেই। যে কারণে মহাপুরুষেরা বিয়ে করেন না। আজীবন চিরকুমার থাকেন । বিয়ে করার পর যারা মহাপুরুষ হন তাঁরা স্ত্রী- সংসার ছেড়ে চলে যান। যেমন বুদ্ধদেব।
ফুপু হতচকিত গলায় বললেন, তুই আমাকে আপনি না বলে তুমি তুমি করে বলছিস কেন?
আমি তো সবসময় তাই বলি।
সে কি ! আমার তো ধারণা ছিল আপনি করে বলিস।
জি না ফুপু আপনি ভুল করছেন। আমার খুব প্রিয়জনদের আমি তুমি করে বলি। আপনি যদিও খুব কঠিন প্রকৃতির মহিলা তুব আপনি আমার প্রিয়জন। সেই কারণে আপনাকে আমি তুমি করে বলি।
এই তো এখন আপনি করে বলছি।
কই না তো। তুমি করেই তো বলছি।
ফুপু খুবই বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন । মানুষকে বিভ্রান্ত করতে আমার খুব ভালো লাগে। সম্ভবত আমি মহাপুরুষের পর্যাযে পৌঁছে যাচ্ছি। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারছি।
রূপার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রও হচ্ছে বিভ্রান্তি। তাকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করতে পেরেছিলাম। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হলো শীতকালে–



COMMENTS

Name

Andrew-Kishore,1,অগ্নিপুরুষ,10,অনীশ,2,অন্য-ভুবন,3,আজ-হিমুর-বিয়ে,3,আবু-ইসহাক,1,আমি-এবং-আমরা,3,আমিই-মিসির-আলি,3,উপন্যাস,15,উপেন্দ্রকিশোর-রায়চৌধুরী,2,একজন-হিমু-কয়েকটি-ঝিঁঝিঁ-পোকা,5,এবং-হিমু,5,কবিতা,2,কহেন-কবি-কালিদাস,2,কাজী-আনোয়ার-হোসেন,18,কাজী-নজরুল-ইসলাম,2,গজল,1,গল্প,3,গানের-লিরিক,9,চলে-যায়-বসন্তের-দিন,3,চোখ,1,ছোট-গল্প,35,ছোটদের-গল্প,17,জলের-গান,1,জেমস,2,তন্দ্রাবিলাস,3,তোমাদের-এই-নগরে,4,দক্ষিণারঞ্জন-মিত্র-মজুমদার,1,দরজার-ওপাশে,4,দেবী,7,দেশাত্ববোধক-কবিতা,1,দেশাত্ববোধক-গান,2,নিশীথিনী,4,নিষাদ,3,পঞ্চতন্ত্র,1,পাগলা-দাশু,4,পারাপার,4,পুফি,3,বইয়ের-তালিকা,1,বাঘবন্দি,3,বিখ্যাত-গান,3,বিপদ,2,বৃহন্নলা,2,ভয়,5,মজার-গল্প,23,ময়ূরাক্ষী,4,ময়ূরাক্ষীর-তীরে-প্রথম-হিমু,1,মাসুদ-রানা,18,মিসির-আলি-UNSOLVED,4,মিসির-আলি-আপনি-কোথায়,3,মিসির-আলি-সমগ্র,55,মিসির-আলির-অমিমাংসিত-রহস্য,3,মিসির-আলির-চশমা,3,মুহম্মদ-জাফর-ইকবাল,1,মোশতাক-আহমেদ,1,মোহাম্মাদ-জসীম-উদ্দীন-মোল্লা,2,যখন-নামিবে-আঁধার,2,রবীন্দ্রনাথ-ঠাকুর,3,রম্যগল্প,4,রাধারানী-দেবী,1,রুপকথার-গল্প,4,শরৎচন্দ্র-চট্টোপাধ্যায়,2,শেখ-আবদুল-হাকীম,8,শ্রী-ক্ষিতীশচন্দ্র-কুশারী,1,সায়েন্স-ফিকশন,1,সুকুমার-রায়,7,সে-আসে-ধীরে,4,সেবা-প্রকাশনী,4,সৈয়দ-মুজতবা-আলী,1,স্বর্ণদ্বীপ,7,হরতন-ইশকাপন,2,হলুদ-হিমু-কালো-RAB,6,হাসির-গল্প,23,হিমু-এবং-একটি-রাশিয়ান-পরী,3,হিমু-এবং-হার্ভার্ড-PhD-বল্টু-ভাই,7,হিমু-মামা,6,হিমু-রিমান্ডে,9,হিমু-সমগ্র,80,হিমুর-দ্বিতীয়-প্রহর,3,হিমুর-বাবার-কথামালা,8,হুমায়ূন-আহমেদ,135,
ltr
item
গল্প এর বই: ময়ূরাক্ষী (১৯৯০) হুমায়ূন আহমেদ পর্ব (০৪)
ময়ূরাক্ষী (১৯৯০) হুমায়ূন আহমেদ পর্ব (০৪)
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgji6DedYIOujzwHkj1Aj3UNxz9A2XaDfWQGjTxM87DZUl1ujlfXcp4KGKo2DkPBbzL8vgNqVKmMOwcpbhLle26Z-QcDxVdJOHeTLsxzgN90My7a8D0iloH10N48H62WUGxz9coZLVvqkgS/s320/moyuorakkhi-himu-humayun-ahmed-golpoerboi-golpo-er-boi-masum-kazi.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgji6DedYIOujzwHkj1Aj3UNxz9A2XaDfWQGjTxM87DZUl1ujlfXcp4KGKo2DkPBbzL8vgNqVKmMOwcpbhLle26Z-QcDxVdJOHeTLsxzgN90My7a8D0iloH10N48H62WUGxz9coZLVvqkgS/s72-c/moyuorakkhi-himu-humayun-ahmed-golpoerboi-golpo-er-boi-masum-kazi.jpg
গল্প এর বই
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/05/moyurakkhi-himu-series-er-1st-book-porbo-04.html
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/05/moyurakkhi-himu-series-er-1st-book-porbo-04.html
true
2280349116972597382
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content