বুনো রাজা ও রাজকুমারী-- শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী

এক বুনো রাজা। বনেই তাঁর রাজত্ব। যত অসভ্য জংলী তাঁর প্রজা। প্রজাদের ঘর নেই, দোর নেই। কেউ বা বাঁশ দিয়ে, খড় দিয়ে, গাছের পাতা দিয়ে ঘর তৈরী করে। রান্না বান

 বুনো রাজা ও রাজকুমারী-- শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী 


এক বুনো রাজা। বনেই তাঁর রাজত্ব। যত অসভ্য জংলী তাঁর প্রজা। প্রজাদের ঘর নেই, দোর নেই। কেউ বা বাঁশ দিয়ে, খড় দিয়ে, গাছের পাতা দিয়ে ঘর তৈরী করে। রান্না বান্নার বালাই নাই। তীর ধনুক নিয়ে তারা জন্তুজানোয়ার শিকার করে। আর শিকার করা পশুর মাংস আগুনে ঝলসে নিয়ে খায়। কাপর বুনতে তারা জানে না। তাই তারা পরে পশুর চামড়া।

বুনো রাজার কিন্তু বাড়ী আছে। প্রজাদের মতই লতাপাতার বাড়ী। তবে অনেকগুলো ঘর। রাজা থাকেন সেই রাজবাড়ীতে। সিংহাসনও আছে একটা-- একটা বড় পাথরের চাঙড়া। রাজা বসেন সেই খানে। এই আসনে বসেই তিনি বিচার করেন। তাঁর একটা সৈন্যদলও আছে। তাদের এক হাতে বর্শা আর এক হাতে ঢাল। পিঠে তীরধনুক। গায়ে উল্কি। কালো তাগড়া চেহারা। দেখলেই ভয় হয়। এরাই রাজার জন্য যুদ্ধ করে।

রাজার কিন্তু রাণী নেই। রাণী না হলে রাজত্ব চলে না। রাজার পণ তিনি কালো রাণী বিয়ে করবেন না। ধবধবে ফর্সা রাণী চাই। কিন্তু বনবাদারে এমন সুন্দর রাণী কোথায় পাওয়া যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি চলছে, পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যের সব লোক মনের দুঃখে দিন কাটায়। রাজার মনেও শান্তি নেই।

একদিন রাজা তার সিংহাসনে বসে আছেন। এমন সময় এক চর এক নতুন খবর নিয়ে এল। সে বলল, মহারাজ, আমাদের বন থেকে দু’দিনের পথে আছে এক রাজ্য। সেই রাজ্যের রাজা আছে। রাজার আছে এক সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু মেয়েটি বড় অহঙ্কারী। কোন বর তার পছন্দ নয়। যে বরই বিয়ে করতে আসে, তার একটা খুঁত সে ধরবেই। কারো নাক নাকি ব্যাঙের মত চ্যাপ্টা, কারো পেট জালার মত, কেউ বাঁশের কঞ্চির মতো ঢেঙা, কেউ বেঁটে বামুন, কউ আলুর মতো গোল, কারো চলন ক্যাঙ্গারুর মতো-- এমন কত কি। সবাই অপমানিত হয়ে ফিরে গিয়েছে। রাজকুমারীর ঠাট্টাবিদ্রুপে মুখ লাল করে তারা সরে পড়েছে। এবার রাজা প্রতিজ্ঞা করেছেন আর সাতদিন দেখবেন। এর মধ্যে রাজকুমারীর বিয়ে হয়, ভালোই। নয়ত আটদিনের দিন সকাল বেলা রাজা যাকে প্রথমেই দেখবেন তার হাতেই মেয়ে দেবেন। রাজকুমারীর আর কো কথা শুনবেন না।

চর আরো বলল, রাজা প্রতিদিন ভোরে একা যায় অন্দর মহলের পুকুরে স্নান করতে। রাজার হুকুমে তখন কেউ সেখানে যেতে পারে না। স্নান করবার এই সময়ে দেখা করতে পারলেই, রাজকন্যাকে পাওয়া যেতে পারে। যতদূর মনে হয়, এই সাত দিনের মধ্যে রাজ কন্যার বিয়ে হবে না।

বুনো রাজা শুনলেন সব কথা, কিন্তু কেমন করে রাজার অন্দর মহলে যাওয়া যায়? ভাবতে ভাবতেই তিনদিন কেটে গেল।

চরদিনের দিন বুনো রাজা সকালবেলা বেড়াতে বার হয়েছেন। সঙ্গে আর কেউ নেই, খানিক দূরে গিয়েই দেখে জঙ্গলের মধ্যে তিন দৈত্য ঝগড়া করছে। বুনো রাজাকে দেখেই তিনজন এক সঙ্গেই বলল, এই যে রাজা এসেছেন। রাজাই এই সম্পত্তি আমাদের মধ্যে ভাগ করে দেবেন।

বুনো রাজা এগিয়ে এলেন। এসে দেখলেন, এক জোড়া খড়ম, একখানা তরোয়াল, আর একটা জামা। এই নিয়েই বিবাদ। এই জিনিসগুলো তিন জনের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে।

দৈত্যরা রাজাকে বলর, এই খড়ম জোড়া পায়ে দিলে যে কোন জায়গায় যাওয়া যায়। এই জামা যে পরে তাকে আর কেউ দেখতে পায় না, সে একেবারে অদৃশ্য ভাবে থাকতে পারে। আর তরোয়ালকে বললেই হল, মাথা কেটে নাও। যে কোন লোকের তখনি মাথা কাটা যাবে।

বুনো রাজা দেখলেন, মজা মন্দ নয়। খড়মজোড়া পেলে ত ভালোই হয়। রাজবাড়ীর অন্দর মহলে যেতে আর কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু কি করে খড়ম জোগা নেওয়া যায়।

বুনো রাজা দৈত্যদের বলল, জিনিসগুলো আমি আগে পরীক্ষা করে ত দেখি, তারপর কি ভাবে ভাগ করা হবে, তা বিবেচনা করব। আচ্ছা, তরোয়ালটা আগে আমায় দাও।

দৈত্যরা দেখল, মহাবিপদ। বুনো রাজা যদি তরোয়াল নিয়ে বলেই বসেন, দৈত্যদের মাথা কেটে ফেল। তা হলেই ত সম্পত্তি সব গেল। প্রাণও গেল।

দৈত্যদের মনের ভাব বুঝে বুনো রাজা বললেন, তোমাদের ভয় নেই, আমি গাছের উপর এর পরীক্ষা করব।

বুনো রাজার কথায় বিশ্বাস করে তারা তরোয়ালটা তাঁর হাতে দিল। তিনি সামনের একটা বড় গাছের উদ্দেশ্যে বললেন, তরোয়াল একে কেটে ফেল।

সঙ্গে সঙ্গে তরোয়াল ছুটল। মুহূর্তের মধ্যে গাঠের ওপরের দিকটা মাটিতে পড়ে গেল। গুড়ি যেমন ছিল তমেনই দাঁড়িয়ে রইল।

তারপর জামার পরীক্ষা। জামাটা পড়তেই কেউ আর বুনো রাজাকে দেখতে পেল না।

এবারের খড়মের পরীক্ষা। বুনো রাজা খড়ম পায়ে দিয়েই বললেন, আমাকে দক্ষিণ দিকের পাহাড়টার নিয়ে নিয়ে চল।

খড়ম বুরো রাজাকে নিয়ে উড়ে গেল। রাজা আর ফেরেন না। দৈত্য দিনজন অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করল। সকাল দেখে দুপুর হল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, কই, রাজা কই।

রাজা আর ফিরে এলেন না। তাদের সম্পত্তিরও আর ভাগ হল না। বাকী দুটো জিনিস নিয়ে তিন দৈত্য সন্ধ্যার অন্ধাকরে কোথায় মিলিয়ে গেল।

এদিকে খড়ম পায়ে দিয়ে আটদিনের দিন বুনো রাজা ভুব ভোরে এসে বসে রইলেন অন্দর মহলের পুকুরের ঘাটে। রাজাও প্রতিদিনের মতো নাইতে এসে প্রথমেই দেখলেন বুনো রাজাকে।

ফলে বুনোরাজার সাথেই রাজকুমারীর বিয়ে হল। রাজকুমারী তো রেগে অস্থির। কিন্তু রাগলে আর কি হবে। বুনো রাজা রাজকুমারীকে নিয়ে এলেন নিজের রাজ্যে। বুনো রাজার বাড়ী দেখে রাজকুমারী কেঁদে ফেললেন।

বুনো রাজা বললেন, কেঁদে আর কি হবে বলো। এখন থেকে তোমাকে এই বাড়ীতেই থাকতে হবে, থাকতে হবে এই বনে। শুধু তাই নয়। তুমি বুনো দেশের রাণী হলেও তোমাকে খেটে খেতে হবে। এখানে বসে কেউ থাকে না, সবাই কাজ করে।

খাওয়ার কথা শুনে রাজকুমারীর চোখে জল এল। আগুনে ঝলসানো মাংস খেয়ে কেউ বাঁচতে পারে নাকি? কেউ কি থাকতে পারে লতাপাতার ঘরে? শিকার সে জন্মেও করে নি। শিকার করতে যেতে হবে, এই বুনোদের সঙ্গে!

কিন্তু উপায় কি? রাজকুমারীর অহঙ্কার আর রইল না। বাধ্য হয়ে তাকে কাজে হাত দিতে হল। প্রথম প্রথম তার কষ্ট হত। বাপের বাড়ীতে সে সুখে কাটিয়েছে। স্বচ্ছন্দে জীবন চলে গিয়েছে। মুখের কথা ফেলতে না ফেলতেই দাসী চলে হাজির।

আর এখানে?

তবু ক্রমে তার সব সয়ে গেল। কাজ করতে করতে ক্রমে রাজকুমারীর মনে আনন্দ এল। এখন ত এই তার দেশ, চিরজীবন এই বুনো দেশেই থাকতে হবে।

কিন্তু বুনোদের কি আছে? ঘর নেই, দোর নেই। রান্না করে জিনিস খেতে এরা জানে না। কেউ কাপড় বুনতে জানে না । রাস্তা নেই, ঘাট নেই, বাজার-বন্দর কিছু নেই।

রাজার কুমারী বাপের বাড়ীর দেশ থেকে নিয়ে এল কামার, কুমোর, ছুতার। নিয়ে এল রাধুঁনি আর নানা রকম খাবার জিনিস; নিয়ে এল কৃষক।

রাজকুমারী নিজেই তাদের সাথে কাজে লেগে গেল। বন জঙ্গল পরিষ্কার হতে লাগল। বুনো লোক কাজ করতে শিখল। মাঠে ধান চষা আরম্ভ হল। ধানে ধানে মাঠ ছেয়ে গেল। বাড়ী উঠল। ঘর উঠল, রাস্তা হল, ঘাট হল। রাজবাড়ী সুন্দর করে তৈরী করা হল। সোনার সিংহাসন গড়ে উঠল। লোকেরা কাপড় বুনতে শিখল। কাপড় পড়তে শিখল। তারা রান্না করে খেতে শিখল।

বুনো দেশ সোনার দেশ হলে গেল।

রাজকুমারী এবার সত্যিকারের রাজরানী হল। প্রজারা সব তাদের রানীর গুণে মুগ্ধ হয়ে গের।

রানীর জয় জয়কার। রাজাও খুব খুশী। রাজা-রানী পরম সুখে রাজত্ব করতে লাগল।

COMMENTS

Name

Andrew-Kishore,1,অগ্নিপুরুষ,10,অনীশ,2,অন্য-ভুবন,3,আজ-হিমুর-বিয়ে,3,আবু-ইসহাক,1,আমি-এবং-আমরা,3,আমিই-মিসির-আলি,3,উপন্যাস,15,উপেন্দ্রকিশোর-রায়চৌধুরী,2,একজন-হিমু-কয়েকটি-ঝিঁঝিঁ-পোকা,5,এবং-হিমু,5,কবিতা,2,কহেন-কবি-কালিদাস,2,কাজী-আনোয়ার-হোসেন,18,কাজী-নজরুল-ইসলাম,2,গজল,1,গল্প,3,গানের-লিরিক,9,চলে-যায়-বসন্তের-দিন,3,চোখ,1,ছোট-গল্প,35,ছোটদের-গল্প,17,জলের-গান,1,জেমস,2,তন্দ্রাবিলাস,3,তোমাদের-এই-নগরে,4,দক্ষিণারঞ্জন-মিত্র-মজুমদার,1,দরজার-ওপাশে,4,দেবী,7,দেশাত্ববোধক-কবিতা,1,দেশাত্ববোধক-গান,2,নিশীথিনী,4,নিষাদ,3,পঞ্চতন্ত্র,1,পাগলা-দাশু,4,পারাপার,4,পুফি,3,বইয়ের-তালিকা,1,বাঘবন্দি,3,বিখ্যাত-গান,3,বিপদ,2,বৃহন্নলা,2,ভয়,5,মজার-গল্প,23,ময়ূরাক্ষী,4,ময়ূরাক্ষীর-তীরে-প্রথম-হিমু,1,মাসুদ-রানা,18,মিসির-আলি-UNSOLVED,4,মিসির-আলি-আপনি-কোথায়,3,মিসির-আলি-সমগ্র,55,মিসির-আলির-অমিমাংসিত-রহস্য,3,মিসির-আলির-চশমা,3,মুহম্মদ-জাফর-ইকবাল,1,মোশতাক-আহমেদ,1,মোহাম্মাদ-জসীম-উদ্দীন-মোল্লা,2,যখন-নামিবে-আঁধার,2,রবীন্দ্রনাথ-ঠাকুর,3,রম্যগল্প,4,রাধারানী-দেবী,1,রুপকথার-গল্প,4,শরৎচন্দ্র-চট্টোপাধ্যায়,2,শেখ-আবদুল-হাকীম,8,শ্রী-ক্ষিতীশচন্দ্র-কুশারী,1,সায়েন্স-ফিকশন,1,সুকুমার-রায়,7,সে-আসে-ধীরে,4,সেবা-প্রকাশনী,4,সৈয়দ-মুজতবা-আলী,1,স্বর্ণদ্বীপ,7,হরতন-ইশকাপন,2,হলুদ-হিমু-কালো-RAB,6,হাসির-গল্প,23,হিমু-এবং-একটি-রাশিয়ান-পরী,3,হিমু-এবং-হার্ভার্ড-PhD-বল্টু-ভাই,7,হিমু-মামা,6,হিমু-রিমান্ডে,9,হিমু-সমগ্র,80,হিমুর-দ্বিতীয়-প্রহর,3,হিমুর-বাবার-কথামালা,8,হুমায়ূন-আহমেদ,135,
ltr
item
গল্প এর বই: বুনো রাজা ও রাজকুমারী-- শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী
বুনো রাজা ও রাজকুমারী-- শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী
এক বুনো রাজা। বনেই তাঁর রাজত্ব। যত অসভ্য জংলী তাঁর প্রজা। প্রজাদের ঘর নেই, দোর নেই। কেউ বা বাঁশ দিয়ে, খড় দিয়ে, গাছের পাতা দিয়ে ঘর তৈরী করে। রান্না বান
গল্প এর বই
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/06/buno-raza-o-rajkumari.html
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/06/buno-raza-o-rajkumari.html
true
2280349116972597382
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content