জার্মানের রূপকথার গগল্পগুলো পড়ে দেখুন ভালো লাগবে -- ১. তিনটি পালক ২. মৌমাছিদের রাণী ৩.সাহসী ক্ষুদে দর্জি
জার্মানের রূপকথার গল্প
তিনটি পালক - জার্মানের রূপকথা
এক সময় ছিলেন এক রাজা। তার তিন ছেলে। বড়ো দুজন চালাক-চতুর। কিন্তু ছোটোটি নিরীহ আর শান্ত। তাই লোকে তাকে বলত হাদাগঙ্গারাম। রাজা বুড়ো হবার পর ভাবতে শুরু করলেন—তাঁর পর কোন ছেলে সিংহাসনে বসবে। একদিন ছেলেদের ডেকে তিনি বললেন, “তোমরা বেরিয়ে পড়ো। আমার জন্যে যে সব চেয়ে সুন্দর গালচে নিয়ে আসতে পারবে, আমার মৃত্যুর পর সেই হবে রাজা।” এইনা বলে তাদের নিয়ে রাজা দুর্গের সামনে গিয়ে ফুঁ দিয়ে তিনটি পালক উড়িয়ে দিলেন। তার পর বললেন, “এই তিনটে পালক যেদিকে যাবে তোমরা তিনজন সেদিকে যেয়ো।” একটা পালক উড়ে গেল পুবে, একটা পশ্চিমে আর তৃতীয়টা সামনের দিকে খানিক গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তাই এক ভাই গেল পুবে, এক ভাই পশ্চিমে। সামনে খানিক গিয়ে যে পালকটা পড়েছিল বোকা ছোটো ভাইটাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা টিটকিরি দিয়ে হাসল।
বেচারা বোকা ছোটো ভাই সেখানে বসে মনের দুঃখে কাঁদতে লাগল। কিন্তু কয়েক মিনিট পরে সে দেখে পালকটা যেখানে পড়ে তার কাছেই একটা গুপ্ত দরজা। সেটা খুলে দেখে একটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে সে লাগল নীচে নামতে। খানিক নামার পর সে পৌছল আর-একটা দরজার সামনে। সেই দরজায় টোকা দিয়ে সে শুনতে পেল ভিতরে কে যেন গান গাইছে। দরজা খুলতে সে দেখে একটা মস্ত মোটা কোলা ব্যাঙ বসে। আর সেটাকে ঘিরে রয়েছে ছোট ছোটাে আরো অনেক ব্যাঙ।
মোটা কোলা ব্যাঙ প্রশ্ন করল—কী তার চাই।
সে বলল, “সব চেয়ে সুন্দর একটা গালচে আমার দরকার।”
ছোটো একটা ব্যাঙকে কোলা ব্যাঙ বলল বড়ো একটা বাক্স আনতে। ছোটো ব্যাঙ বাক্সটা আনতে মোটা কোলা ব্যাঙ সেটার ডালা খুলে বোকা ছোটো ভাইকে এমন সুন্দর একটা গালচে দিল, পৃথিবীতে যার জুড়ি নেই। কোলা ব্যাঙকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বোকা ছোটো ভাই আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল।
অন্য দু ভাই ভেবেছিল তাদের ছোটো ভাই এমনই বোকা যে, কিছুই আনতে পারবে না। তাই তারা বিশেষ খোঁজাখুঁজি করল না। প্রথম যে রাখাল-বউয়ের সঙ্গে দেখা তার কাছ থেকে খুব বাজে ধরনের আলোয়ান নিয়ে তারা ফিরল রাজার কাছে। একই সময় সেই নিখুঁত সুন্দর গালচে নিয়ে রাজার কাছে পৌছল তাদের বোকা ছোটো ভাই।
গালচেটা দেখে অবাক হয়ে রাজা বললেন, “ন্যায়ত আর ধর্মত এরই রাজা হবার কথা।” কিন্তু অন্য দুই ছেলে কিছুতেই রাজার কথা মানতে রাজি হল না। তারা বলল, বোকা লোকের পক্ষে রাজত্ব চালানো অসম্ভব। রাজাকে তারা বলল, আরো শক্ত একটা কাজ দিতে। রাজা বললেন, “আমার জন্যে যে সব চেয়ে সুন্দর আংটি আনতে পারবে সে-ই পাবে রাজত্ব ৷” এই-না বলে তিন ছেলেকে দুর্গের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফুঁ দিয়ে আবার তিনি তিনটে পালক উড়িয়ে দিয়ে বললেন, পালকগুলোর পেছন পেছন যেতে।
আবার বড়ো ছেলেদের একজন গেল পুবে, একজন পশ্চিমে। আর বোকা ছেলেটির পালক সামনে উড়ে গিয়ে পড়ল সেই গুপ্ত দরজাটার পাশে।
আবার সিঁড়িটা দিয়ে নামতে তার সঙ্গে দেখা হল সেই মোটা কোলা ব্যাঙের। বোকা রাজপুত্তুর বলল, “পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে সুন্দর আংটির দরকার।”
সঙ্গে সঙ্গে মোটা কোলা ব্যাঙ বলল সেই বাক্সটা আনতে আর সেটা থেকে ঝলমলে হীরে-পান্না বসানো সুন্দর একটা আংটি বার করল যার জুড়ি পৃথিবীর কোনো স্যাকরা বানাতে পারে না।
বোকা ভাইটি সুন্দর আংটির খোঁজে গেছে বলে বড়ো দুভাই খুব হাসাহাসি করল। সুন্দর আংটি জোগাড় করার কোনো চেষ্টাই নিজেরা করল না। একটা ঠেলা গাড়ির পুরনো ছোটো চাকা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে সেটার পেরেকগুলো ঠুকে বের করে তারা নিয়ে গেল রাজার কাছে।
বোকা ভাই তার হীরে-পান্না বসানো সোনার আংটিটা দেখাতে রাজা বললেন, “আমার ছোটো ছেলেই পাবে রাজত্ব।”
কিন্তু অন্য দুই ছেলে কিছুতেই রাজার কথা মানতে রাজি হল না। তাই শেষটায় রাজা আর-একটা শর্ত করে বললেন—সব চেয়ে সুন্দরী মেয়েকে যে নিয়ে আসতে পারবে সে-ই পাবে রাজত্ব। আবার বাতাসে ওড়ানো হল সেই তিনটে পালক আর আগের মতোই সেগুলো গেল তিন দিকে।
বোকা ছেলে সোজা সেই মোটা কোলা ব্যাঙের কাছে গিয়ে বলল— পরমা-সুন্দরী একটি মেয়ে দিতে।
কোলা ব্যাঙ বলল, “পরমাসুন্দরী মেয়েকে পাওয়া অত সহজ নয়। কিন্তু তোমাকে দিচ্ছি।” এই-না বলে সে তাকে দিল পুরনো হলদে একটা গাজর। সেটার মাঝখানে ফাঁপা। গাজরটার সঙ্গে সে জুতে দিল ছটা ইঁদুর।
বোকা রাজপুত্তুর করুণ গলায় প্রশ্ন করল, “এদের নিয়ে কি করব?”
কোলা ব্যাঙ বলল, “এটার মধ্যে আমার যে কোনো একটা বাচ্চাকে বসিয়ে দাও।”
এই-না বলে হাতের কাছে যে বাচ্চাকে পেল তাকে ধরে সে বসিয়ে দিল সেই হলদে গাড়িতে। আর চক্ষের নিমেষে সেই বাচ্চা ব্যাঙ হয়ে গেল পরমা সুন্দরী তরুণী মেয়ে, গাজরটা জুড়িগাড়ি আর ছটা ইঁদুর ছটা ঘোড়া। ছোটো রাজপুত্তুর মেয়েটিকে চুমু খেলো। তার পর গাড়ি হাঁকিয়ে তাকে নিয়ে গেল রাজার কাছে।
তার অন্য দু ভাই ফিরল পরে। আগের মতোই এবারও তারা কষ্ট করে খোঁজাখুঁজি করে নি। যে চাষী-মেয়েদের সঙ্গে প্রথম দেখা তাদেরই তারা হাজির করল ‘পরমাসুন্দরী’ হিসেবে।
তাই-না দেখে রাজা ঘোষণা করে দিলেন, “আমার মৃত্যুর পর রাজত্ব পাবে আমার ছোটো ছেলে।”
কিন্তু বড়ো দু ভাই আপত্তি করে রাজার কান ঝালাপালা করে দিল। তারা বলল, “তোমার রাজত্ব এক হাঁদাগঙ্গারাম শাসন করবে—এটা আমরা বরদাস্ত করব না।” তারা প্রস্তাব করল; যে-ছেলের বউ হলঘরের মধ্যে টাঙানো লোহার চাকার মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে যেতে পারবো তাকেই দিতে হবে রাজত্ব। তারা ভেবেছিল, চাষীদের মেয়েরা শক্তসমর্থ আর ডানপিটে গোছের, লাফঝাঁপের কাজ অনায়াসে তারা করতে পারবে। কিন্তু ভদ্র পরিবারের কোমল দুর্বল মেয়ে লাফঝাঁপ করতে গেলে পড়বে মারা।’
বুড়ো রাজা এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। চাষী-মেয়েরা কিন্তু সেই লোহার চাকার মধ্যে দিয়ে এমন আনাড়ির মতো লাফ দিল যে, পড়ে গিয়ে ভাঙল তাদের হাত-পা। কিন্তু বোকা রাজপুত্তুরের সুন্দরী বউ হরিণীর মতো সুন্দর ভঙ্গিতে লাফিয়ে গলে গেল সেই লোহার চাকার মধ্যে দিয়ে। আর তখন কোনো ওজর-আপত্তি খাটল না। বোকা রাজপুত্তুরই পেল রাজমুকুট আর অনেক বছর ধরে বিজ্ঞ আর বিচক্ষণের মতো রাজ-কাজ করল পরিচালনা।
মৌমাছিদের রানী - জার্মানের রূপকথা
এক সময় এক রাজার দুই ছেলে অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে বেরিয়ো পড়ল। কিন্তু বদ-সঙ্গে পড়ে বাজে আমোদ-প্রমোদে মশগুল হয়ে বাড়ি ফিরল না। ছোটো ভাইকে তারা বলত গোবুচন্দ্র! সে বেরুল তার বড়ো ভাইদের খোঁজে। ভাইদের সঙ্গে তার দেখা হতে ভাইরা তাকে নিয়ে অনেক ঠাট্টা-তামাশা করল। বলল, তার মতো হাদাগঙ্গারামকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। বলল, তাদের মতো চালাক-চতুর লোক যে পৃথিবীতে কিছুই করতে পারে নি সেখানে তার মতো লোক কোনো পাত্তাই পাবে না।
যাই হোক, একসঙ্গে যেতে-যেতে তারা পৌছল এক পিঁপড়ের ঢিবিতে। বড়ো ভাইরা বলল ঢিবিটা ভেঙে পিঁপড়েদের ডিম মুখে নিয়ে চার দিকে ছুটোছুটি করতে দেখলে তারা খুব মজা পাবে। কিন্তু তাদের বোকা ছোটো ভাই বলল, “আহা, বেচারা পিঁপড়েদের কেন মিছিমিছি সর্বনাশ করবে? ঢিবিটা আমি ভাঙতে দেবো না।”
আরো খানিক গিয়ে তারা পৌছল এক হ্রদে। অনেক হাঁস সেখানে সাঁতার কাটছিল। বড়ো ভাইরা বলল সেখান থেকে দুটো হাঁস নিয়ে ঝলসে খাবে। কিন্তু তাদের বোকা ছোটো ভাই বলল, “আহা বেচারাদের মেরো না। ওদের আমি মারতে দেবো না।”
আরো থানিক গিয়ে একটা গাছে তারা দেখে মধুতে টুসটুসে একটা মৌচাক। গাছটার গুড়ি দিয়ে মধু গড়িয়ে পড়ছিল। বড়ো ভাইরা বলল গাছের তলায় আগুন জ্বেলে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছিদের তাড়িয়ে মধু নেবে। কিন্তু তাদের বোকা ছোটো ভাই বলল, “আহা, বেচারী; মৌমাছিদের কেন সর্বনাশ করবে? ওদের আমি পোড়াতে দেবো না।”
শেষটায় তিন ভাই পৌছল এক দুর্গে। সেখানকার আস্তাবলের ঘোড়াগুলো পাথর হয়ে গিয়েছিল ৷ কিন্তু লোকজন কাউকে দেখা গেল না। সব ঘরগুলো ঘোরার পর তারা পৌঁছল একটা দরজায়। সেটায় ছিল তিনটে হুড়কো। দরজাটার মাঝখানের ছোট্টো ফোকর দিয়ে তাকিয়ে তারা দেখে ঘরের মধ্যে একটা টেবিলের সামনে বসে রয়েছে: ছোটোখাটো একটি লোক। চুলগুলো তার পাকা। তাকে বার দুয়েক তারা ডাকল। কিন্তু মনে হল না তাদের কথা সে শুনতে পেয়েছে। তৃতীয়বার ডাকার পর লোকটা উঠে দরজা খুলে তাদের কাছে এল। কোনো কথা না বলে তাদের সে নিয়ে গেল নানা খাবার-ভরা একটা টেবিলের কাছে। খাওয়া-দাওয়ার পর তাদের সে নিয়ে গেল তিনটে আলাদা আলাদা শোবার ঘরে।
পরদিন সকালে সেই ছোট্টোখাটো বুড়ো মানুষটি এসে হাতছানি দিয়ে বড়ো ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল এক পাথরের টেবিলের কাছে। দুর্গকে জাদুমুক্ত করার তিনটে কাজের কথা সেখানে ছিল লেখা! প্রথম কাজটা হল; বনের মাঝখানে জলা-জমিতে রাজকন্যের যে হাজারটা মুক্তো পোঁতা হয়েছিল সেগুলো খুঁজে বার করা। যে খুঁজতে যাবে সন্ধের আগে সে যদি সব মুক্তোগুলো খুঁজে না পায় তা হলে সে হয়ে যাবে পাথর। সারাদিন ধরে বড়ো ভাই মুক্তোগুলো খুঁজল—কিন্তু সন্ধের মধ্যে একশোটার বেশি খুঁজে পেল না। তাই টেবিলের লেখা অনুযায়ী সে হয়ে গেল পাথর। পরদিন মেজোভাই গেল মুক্তোর খোঁজে। কিন্তু বড়ো ভাইয়ের মতোই সব মুক্তো সে খুঁজে পেল না। সে পেল মাত্র দুশোটা। তাই সে-ও হয়ে গেল পাথর।
শেষটায় মুক্তো খোঁজার পালা এল সেই বোকা ছোটো ভাইয়ের। জলা-জমিতে মুক্তোগুলো খুঁজতে সে শুরু করল। কিন্তু কাজটা করা অসম্ভব দেখে একটা পাথরে বসে সে লাগল কাঁদতে। এমন সময় পাঁচহাজার প্রজা নিয়ে হাজির হল পিঁপড়েদের রাজা, যার জীবন সে বাঁচিয়েছিল। মুহুর্তের মধ্যে ক্ষুদে-ক্ষুদে পিপড়েগুলো সব মুক্তো খুঁজে এনে এক জায়গায় জড় করে রাখল।
দ্বিতীয় কাজটা হল: হ্রদের তলা থেকে রাজকন্যের শোবার ঘরের চাবি তুলে আনা। ছোটো ভাই জলের কাছে আসতে, যে হাঁসদের প্রাণ সে বাঁচিয়েছিল তারা এল সাঁতরে। আর তার পর জলে ডুব দিয়ে তারা তুলে আনল চাবিটা।
কিন্তু তৃতীয় কাজটাই ছিল সব চেয়ে কঠিন। সেটা এই: যে তিন রাজ কন্যে ঘুমিয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে সব চেয়ে ছোটো আর সব চেয়ে সুন্দরীকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। তিন রাজকন্যেকেই দেখতে হুবহু একরকম। তাদের মধ্যে একমাত্র যেটা তফাত সেটা এইঃ ঘুমবার আগে বড়ো রাজকন্য খেয়েছিল এক টুকরো মিছরি, মেজো খেয়েছিল এক চোক সিরাপ আর ছোটো খেয়েছিল এক চামচে মধু।
কিন্তু ছোটো ভাইকে সাহায্য করতে এল মৌমাছিদের রানী, যাকে সে বাঁচিয়েছিল আগুন থেকে। তিন রাজকন্যের মুখের উপর উড়তে লাগল মৌমাছির রানী। তার পর যে-রাজকন্যে মধু খেয়েছিল তার ঠোঁটের উপর নামল সে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে দেখিয়ে দিল ছোটো ভাই।
দুর্গ হয়ে গেল জাদুমুক্ত। সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সবাইকার জাদুর ঘুম ভাঙল। যারা পাথর হয়ে গিয়েছিল তারা আবার ফিরে পেল মানুষের দেহ। যে ছোটো ভাইকে সবাই বলত বোকা তার সঙ্গেই বিয়ে হল সব চেয়ে সুন্দরী ছোটো রাজকন্যের আর তার বাবার মৃত্যুর পর সে-ই হল রাজা। তার বড়ো দুভাই বিয়ে করল অন্য দুই রাজকন্যেকে।
সাহসী ক্ষুদে দর্জি - জার্মানের রূপকথা
গ্রীষ্মকালের সুন্দর এক সকালে ক্ষুদে এক দর্জি জানলার পাশে তার টেবিলের সামনে বসে হাত চালিয়ে ছুঁচ দিয়ে সেলাই করছিল। এমন সময় পথ দিয়ে যেতে-যেতে এক চাষী-মেয়ে হেঁকে চলল, “চাই ভালো সস্তা মারমালেড! ভালো সম্ভা মারমালেড” (কমলালেবুর মোরব্বা)। সেই হাঁক শুনে দর্জির লোভ হল। জানলা দিয়ে কোঁকড়াচুল-ভরা মাথা বার করে সে বলল, “এসো গো ভালোমানুষের বউ। তোমার সওদার খদ্দের এখানে রয়েছে।”
ভারী চুবড়িটা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে সেই চাষী-মেয়ে দর্জির কাছে এসে তার কথামতো সব পাত্রগুলো সে বার করল। দর্জি একটা একটা করে পাত্রগুলো নাকের সামনে ধরে শেষটায় বলল, “ভালো— মানুষের বউ, চার আউন্স আমাকে ওজন করে দাও। পৌনে এক পাউণ্ড হলেও আপত্তি নেই।”
চাষী-বউ ভেবেছিল ভালো খদ্দের পাবে। তাই এই সামান্য মারমালেড দর্জিকে দিয়ে বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে-করতে চলে গেল।
দর্জি বলল, “এই মারমালেড নিয়ে আমি ভগবানের স্তব বলব। তা হলে নিশ্চয়ই চনচনে ক্ষিদে হবে।”
খাবারের আলমারি থেকে পাউরুটি বার করে, এক টুকরো কেটে সেটায়মার মালেড সে মাখাল, তার পর বলল, “জানি খেতে ভালোই লাগবে। কিন্তু খাবার আগে এই ওয়েস্টকোটটা শেষ করে ফেলি।”
এই-না বলে মারমালেড-মাখানো রুটির টুকরোটা পাশে রেখে মনের আনন্দে দিয়ে চলল ছুঁচে বড়ো-বড়ো ফোঁড়। ইতিমধ্যে মারমালেডের মিষ্টি গন্ধ পেয়ে ভীড় করে মাছির দল এসে দেয়ালে বসল, তার পর সেটা চাখবার জন্য এল নীচে নেমে।
“কে তোদের নেমন্তন্ন করেছে রে?” বলে সেই ক্ষুদে দর্জি তাড়িয়ে দিল সেই-সব অনাহত অতিথিদের। কিন্তু মাছিগুলো তার ভাষা বুঝল না। তাই না পালিয়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে তারা আবার এল ফিরে। তখন সেই ক্ষুদে দর্জি দারুণ চটে একটা তোয়ালে নিয়ে আছড়াতে শুরু করল। ফলে অন্তত গোটা সাতেক মাছি আকাশের দিকে পা তুলে পড়ল মারা। নিজের সাহসের নিজেই তারিফ করে সে বলল, “দারুণ কাণ্ড! শহরময় হৈহৈ পড়ে যাবে।” এই-না বলে সেই ক্ষুদে দর্জি চটপট একটা বেল্ট বানিয়ে তাতে লিখল, “এক ঘায়ে সাতটা কাবু” তার পর আপন মনে বলে উঠল, “শুধু শহর নয়, সারা পৃথিবীতে রটে যাবে খবরটা। উত্তেজনায় ভেড়ার বাচ্ছার লেজের মতো তার বুকটা উঠল ধড়ফড় করে।
সেই বেল্টটা কোমরে জড়িয়ে দর্জি বেরিয়ে পড়ল পৃথিবী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। কারণ তার বিরাট সাহস দেখাবার পক্ষে তার কাজের ঘরটা ছিল নেহাতই ছোটো। আরো কিছু সঙ্গে নিয়ে যাবার মতো আছে কি না দেখার জন্য যাত্রা করার আগে সে তাকাল চারদিকে। দেখল, খানিকটা পুরনো পনীর ছাড়া আর কিছু নেই। সেটাকে সে পকেটে ভরল। দরজার সামনে সে দেখে ঝোপে একটা পাখি আটকা পড়েছে। সেটাকেও সে পকেটে ভরল পনীরটাকে সঙ্গ দেবার জন্য। তার পর হাসিখুশি মুখে পড়ল বেরিয়ে। মানুষটা সে ছিল নেহাত ক্ষুদে। ওজনটাও খুব হালকা। তাই ক্লান্ত হয়ে পড়ল না। যেতে-যেতে সে পৌছল একটা পাহাড়ে। সেটার সব চেয়ে উঁচু চূড়োয় পৌছে সে দেখে একটা বিশাল চেহারার দৈত্য সেখানে বসে। দৈত্যটা চার দিকে শান্ত চোখে তাকাচ্ছিল। দর্জি তার কাছে গিয়ে বেপরোয়া স্বরে বলল;
“শুভদিন, দোস্ত। এখানে বসে-বসে তুমি কি সামনেকার বিরাট পৃথিবীটা দেখছ? আমিও ওখানে চলেছি। আমার সঙ্গে আসার ইচ্ছে আছে?”
নিদারুণ অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দৈত্য বলল, “দুর, ছোড়া—পুঁচকে ফাজিল কোথাকার”
ক্ষুদে দর্জি বলল, “আমাকে তাই ভেবেছ বুঝি। কিন্তু এই দেখো।” কোটের বোতাম খুলে দৈত্যকে সে দেখাল তার বেল্ট। তার পর বলল, “পড়ে দেখো কী ধরনের লোক আমি।”
দৈত্য দেখল লেখা রয়েছে “এক ঘায়ে সাতটা কাবু।” সে ভাবল এক ঘায়ে সাতটা লোককে দর্জি মেরেছে। তখন তার প্রতি দৈত্যর কিছুটা শ্রদ্ধা হল। তবু ভাবল তাকে যাচাই করে দেখা দরকার। তাই একটা পাথর তুলে হাতের মধ্যে গুড়িয়ে সে জল বার করে ফেলল।
তার পর বলল, “তোমার যদি সত্যিই শক্তি থাকে তা হলে আমার মতো পাথর গুড়িয়ে জল বার করো।”
দর্জি বলল, “এই কথা? এটা তো নেহাত ছেলেখেলা ৷” এই— না বলে পকেট থেকে নরম পনীর বার করে চটকে জল বার করে ফেললে সে।
দৈত্য অবাক হল। কিন্তু এই ক্ষুদে মানুষটার শক্তি সম্বন্ধে সন্দেহ তার ঘুচল না। তাই সে একটা পাথর তুলে এমন উঁচুতে ছুঁড়ল যে প্রায় দেখাই গেল না।
তার পর বলল, “আমার মতো ছোঁড়ো দেখি—বেঁটে-বাটকুল কোথাকার।”
দর্জি বলল, “খাসা ছুড়েছ। কিন্তু তোমার পাথরটা তো মাটিতে এসে পড়ল। আমি এমন পাথর ছুঁড়ব যেটা মাটিতেই পড়বে না।”
এই-না বলে পকেট থেকে পাখিটাকে বার করে সে দিল শূন্যে ছুড়ে। মুক্তি পেয়ে মনের আনন্দে পাখিটা উড়ে গেল, আর ফিরে এল না। ‘এবার বল দোস্ত, কেমন লাগল?” প্রশ্ন করল দর্জি ৷
দৈত্য উত্তর দিল, “মানছি তুমি ভালোই ছুঁড়তে পার। কিন্তু এবার দেখা যাক ভারি বোঝা তুমি বইতে পার কি না।”
এই-না বলে ক্ষুদে দর্জিকে সে নিয়ে গেল প্রকাণ্ড প্রকটা ওকগাছের কাছে ৷ কাটা-অবস্থায় সেটা মাটিতে পড়েছিল। দৈত্য বলল, “ক্ষমতা থাকলে এটাকে বনের বাইরে নিয়ে যেতে আমাকে সাহায্য কর।”
ক্ষুদে দর্জি বলল, “এটা আর শক্ত কি? গুড়িটা তুমি কাঁধে নাও। ডালপালাগুলো আমি বইছি—সেটাই সব চেয়ে কঠিন ৷”
দৈত্য গাছের গুড়িটা কাঁধে তুলল আর দর্জি গিয়ে বসল একটা ডালে। ঘাড় ফিরিয়ে দৈত্য দেখতে পারল না। তাই শুধু যে পুরো গাছটা তাকে বইতে হল তাই নয়, সেই সঙ্গে বইতে হল ক্ষুদে দর্জিকেও।
পিছনকার ডালে বসে যেতে-যেতে মনের আনন্দে দর্জি কখনো দেয় শিস, কখনো গেয়ে ওঠে টুকরো-টুকরো গান। ভাবখানা—ভারি গাছ বয়ে নিয়ে যাওয়া নেহাতই ছেলে খেলা।
ভারি গাছটা খানিক দূর বয়ে নিয়ে যাবার পর হাঁপাতে-হাঁপাতে দৈত্য চেঁচিয়ে বলল—আর সে বইতে পারছে না, কাধ থেকে গাছটা ফেলছে।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে নেমে পিছনকার ডালপালা দু হাত দিয়ে দর্জি ধরল। ভাবখানা—এতক্ষণ সে-ও বয়ে আনছিল গাছটা। তার পর টিটকিরি দিয়ে বলল, “কী কাণ্ড। তোমার মতো জোয়ান লোক একটা গাছ বইতে পারে না।”
খানিক যেতে-যেতে তারা পৌছল একটা চেরিগাছের কাছে ৷ সেটার মাথায় ফলেছিল পাকা-পাকা ফল। গাছটার ঝুঁটি ধরে টেনে নামিয়ে ডালটা দর্জির হাতে দিয়ে দৈত্য তাকে বলল যত খুশি ফল খেতে। কিন্তু ডালটা টেনে ধরার শক্তি সেই ক্ষুদে দর্জির ছিল না। দৈত্য ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে গাছটা আবার খাড়া হয়ে উঠল, দর্জিও সেই সঙ্গে সোঁ করে উঠে গেল উপরে।
অক্ষত শরীরে দর্জি মাটিতে পড়ার পর দৈত্য বলল, “আরে। ঐ কচি ডালটা দাবিয়ে রাখার ক্ষমতাও তোমার নেই?”
দর্জি উত্তর দিল, এর সঙ্গে ক্ষমতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। একঘাঁয়ে সাতটাকে মারার পর তুমি কি ভাব ডালটা দাবিয়ে রাখতে পারতাম না? গাছটা টপ্কে এলাম, কারণ দেখি ঝোপের মধ্যে বসে এক শিকারী আমার দিকে তাক করছে। গাছটা টপকাতে তুমি পার?” দৈত্য টপকাবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। মগডালে গেল আটকে। তাই-না দেখে দর্জি তো হেসেই কুটোপাটি।
দৈত্য বলল, “তুমি ক্ষুদে মানুষ হলেও খুব সাহসী দেখছি। চলো, আমাদের গুহায় রাত কাটাতে।”
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে ক্ষুদে দর্জি চলল দৈত্যর সঙ্গে ৷ গুহায় পৌছে তারা দেখে অন্য দৈত্যরা আগুনের চার পাশে বসে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে আগুনে ঝলসানো ভেড়া। এমনভাবে কামড় দিয়ে চলেছে যেন সেগুলো রুটির হালকা টুকরো। দৈত্য তাকে একটা বিছানা দেখিয়ে বলল সেখানে শুয়ে বিশ্রাম নিতে। কিন্তু বিছানাটা ছিল দর্জির পক্ষে বেজায় বড়ো। তাই তাতে না শুয়ে গুটিগুটি এক কোণে গিয়ে বসল দর্জি। মাঝরাত হলে দৈত্য ভাবল ক্ষুদে দর্জি নিশ্চয়ই অঘোরে ঘুমচ্ছে। তাই একটা লোহার গজাল এনে এক ঘায়ে বিছানায় সেটা গেঁথে ভাবল ক্ষুদে ফড়িঙের মতো দর্জির দফা সে নিকেশ করে দিয়েছে।
পরদিন ভোরে দর্জির কথা ভুলে দৈত্যরা গেল বনে। এমন সময় সুস্থ শরীরে আগের মতোই বেপরোয়া চালে দর্জি হাজির হল তাদের কাছে। তাকে দেখে দারুণ ঘাবড়ে গেল দৈত্যের দল ৷ ভাবল তাদের সে এবার মেরে ফেলবে। তাই পড়িমরি করে তারা ছুটে পালাল। ক্ষুদে দর্জি নাক-বরাবর সোজা চলল হেঁটে। অনেক দূর যাবার পর সে পৌছল এক রাজপ্রাসাদের অঙ্গনে। বেজায় তখন সে ক্লান্ত। তাই সেখানে শুয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল। সে যখন ঘুমচ্ছে, নানা লোক এসে তার বেল্টের উপরকার সেই লেখাটাই পড়ল—“এক ঘায়ে সাতটা?”
লোকেরা ভাবল, “নিশ্চয়ই এ মস্ত বড়ো বীরপুরুষ। কিন্তু এখন তো যুদ্ধ নেই—এখানে এসেছে কেন?” তারা গিয়ে রাজাকে খবরটা দিয়ে বলল—যুদ্ধ বাধলে লোকটা খুব কাজে লাগবে, তাই কিছুতেই তাকে যেন যেতে দেওয়া না হয়।
রাজি হয়ে দর্জির কাছে রাজা পাঠালেন তার এক অমাত্যকে। বলে দিলেন দর্জির ঘুম ভাঙলে যেন জানানো হয় তাকে সৈন্যদলে ভর্তি করতে রাজা চান। ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলে দর্জি যখন আড়মোড়া ভাঙছে, সেই অমাত্য তাকে জানাল রাজার প্রস্তাব।
দর্জি বলল, “সেইজন্যই তো এখানে আসা। রাজার সৈন্যদলে যোগ দিতেই তো চাই।”
তাকে সসম্মানে সৈন্যদলে ভর্তি করে নেওয়া হল। থাকার জন্য দেওয়া হল খুব ভালো একটা বাড়ি। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই সেই দর্জির উপর হিংসেয় অন্যান্য অফিসাররা জ্বলেপুড়ে মরতে লাগল। ফন্দি আঁটতে লাগল সেখান থেকে তাকে তাড়াবার। নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করল, “ওর সঙ্গে যদি আমাদের ঝগড়া বাধে আর ও ঘদি এক-এক ঘায়ে আমাদের সাতজনকে খতম করতে থাকে—তা হলে, আমাদের কী দশা হবে? তাই রাজার কাছে দল বেঁধে গিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তারা বলল, “এক-এক ঘায়ে সাতটা লোককে যে সাবাড় করতে পারে তার সঙ্গে পাল্লা দেবার উপযুক্ত আমরা নই ৷”
একজন লোকের জন্য নিজের সমস্ত বিশ্বস্ত কর্মচারীদের হারিয়ে রাজা খুব ক্ষুণ্ণ হলেন। তার মনে হল লোকটার দেখা না পেলেই ভালো হত। তাই ভাবতে লাগলেন—কী করে তাকে তাড়ানো যায়। কিন্তু তাকে বরখাস্ত করার সাহস রাজার হল না। ভাবলেন, জবাব দিলে দর্জি হয়তো তাকে আর তার প্রজাদের মেরে ফেলে নিজেই সিংহাসন অধিকার করে বসবে। অনেক ভাবনা চিন্তার পর তার মাথায় একটা ফন্দি এল। লোক মারফত ক্ষুদে দর্জিকে তিনি জানালেন—সে দারুণ সাহসী বীরপুরুষ, তাই তার কাছে একটা প্রস্তাব আছে। প্রস্তাবটা এইঃ তার রাজত্বের মধ্যে এক বনে দুটো দৈত্য থাকে খুন-খারাপি লুটপাট করে তারা ভয়ংকর ক্ষতি করে চলেছে , তাদের সামনে যাবার সাহস কারুর নেই। এই দুই দৈত্যকে দর্জি মেরে ফেলতে পারলে তার সঙ্গে নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়ে তিনি দেবেন আর সেই সঙ্গে দেবেন অর্ধেক রাজত্ব। দৈত্যদের মারার জন্য দর্জিকে তার একশোজন বীর সৈন্য সাহায্য করবে।
দর্জি ভাবল, ‘সুন্দরী রাজকন্যে আর অর্ধেক রাজত্ব—কী কাণ্ড।” তাই সে উত্তরে জানাল, “নিশ্চয়ই যাব আর গিয়ে দৈত্যদের খতম করে আসব। আপনার একশোজন বীর সৈন্যের দরকার নেই। এক ঘায়ে সাতজনকে যে মারতে পারে, অনায়াসে দুজনকে সে নিকেশ করতে পারবে।”
ক্ষুদে দর্জি যাত্রা করল। তার পিছনে চলল সেই একশোজন বীর সৈন্য। বনের কিনারে পৌছে সঙ্গীদের সে বলল, “তোমরা এখানে থাকো। দৈত্যদের আমি খতম করে আসছি।” একাই সে ছুটে গেল বনের মধ্যে। যেতে-যেতে তাকাতে লাগল ডাইনে আর বাঁয়ে। খানিক পরে সেই দুটো দৈত্যের দেখা পেল সে। একটা গাছের তলায় তারা দুজন ঘুমচ্ছিল। তাদের নাকডাকার শব্দে উপরকার ডালপালার উড়ে যাবার অবস্থা। দু পকেট পাথর ভরে দর্জি সেই গাছটায় চড়ল। ঘুমন্ত দৈত্যদের উপরকার একটা ডালে বসে একটা দৈত্যের বুকের উপর ফেলতে লাগল সে পাথরগুলো। অনেকক্ষণ দৈত্যটা নড়ল না। শেষটায় জেগে উঠে তার সঙ্গীকে ঠেলা দিয়ে সে বলল, “আমাকে মারছিস কেন?" অন্যজন উত্তর দিল, “আমি তো মারি নি। নিশ্চয়ই তুই স্বপ্ন দেখছিস।”
আবার শুয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ল। দর্জি তখন আর-একটা পাথর ফেলল দ্বিতীয় দৈত্যের বুকে।
সে চেঁচিয়ে উঠল, “কী ব্যাপার? আমাকে পাথর ছুড়ে মারছিস কেন?”
প্রথমজন রেগে গরগর করে উঠল, “মোটেই পাথর ছুঁড়ে তোকে মারি নি।”
নিজেদের মধ্যে খানিক ঝগড়া করার পর আবার ঘুমে তাদের চোখ বুজে এল। কারণ দুজনেই ছিল খুব ক্লান্ত। ক্ষুদে দর্জি তখন তার সব চেয়ে বড়ো পাথরটা নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারল প্রথম দৈত্যটার বুকে।
“এ তো ভয়ানক জ্বালা হল দেখছি” বলে চেঁচিয়ে উঠে পাগলের মতো তার সঙ্গীকে এমন জোরে গাছের গুড়ির সঙ্গে সে চেপে ধরল যে, থরথর করে কাঁপতে লাগল গোটা গাছটা। অন্যজনও সমান ক্ষেপে উঠে শুরু করে দিল এলোপাথাড়ি কিল-চড়-লাথি মারতে। তার পর দারুণ রেগে শেকড়সুদ্ধ গাছ উপড়ে মারামারি করতে করতে দুজনেই তারা মরে মাটিতে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে লাফিয়ে গাছ থেকে নেমে দর্জি বলল, “কী ভাগ্যি—যে-গাছটায় বসেছিলাম সেটা ওরা ওপড়ায় নি। ওপড়ালে কাঠবিল্লীর মতো অন্য গাছে লাফিয়ে আমায় যেতে হত।” তার পর নিজের থাপ থেকে তরোয়াল বার করে তাদের বুকে কোপ বসিয়ে সেই বীর সৈন্যদের কাছে গিয়ে সে বলল, “কাজটা হাসিল হয়েছে। দৈত্য. দুটোকে খতম করেছি। সাংঘাতিক লড়তে হয়েছে। নিজেদের বাঁচাবার জন্যে গোড়াসুদ্ধ গাছ ওরা উপড়েছিল। কিন্তু এক ঘায়ে যে সাতজনকে কাবু করতে পারে তার সঙ্গে এঁটে উঠবে কী করে?”
তারা প্রশ্ন করল, “তুমি আহত হও নি?”
দর্জি বলল, “না। আমাকে মারবার ওরা খুব চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমার মাথার একগাছা চুলও ছুঁতে পারে নি।”
তার কথা সেই সৈন্যদের বিশ্বাস হল না। তাই তারা ঘোড়ায় চড়ে বনের মধ্যে গেল। আর গিয়ে দেখে নিজেদের রক্তেই দৈত্য দুটো ভাসছে আর চারি দিকে ছড়িয়ে রয়েছে ওপড়ানো অনেক গাছ।
ক্ষুদে দর্জি তার পর রাজার কাছে গিয়ে তার দাবি জানাল। নিজের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করে রাজা মনে-মনে হায় হায় করতে লাগলেন আর মতলব ভাজতে লাগলেন-কী করে এই ক্ষুদে মানুষটাকে দূর করা যায়।
শেষটায় তিনি বললেন, “আমার মেয়েকে বিয়ে করা আর আমার অর্ধেক রাজত্ব পাবার আগে তোমাকে আর-একটা দুঃসাহসী কাজ করতে হবে। বনের মধ্যে একটা ইউনিকর্ন (পৌরাণিক প্রাণী, ঘোড়ার মতো তবে মাথায় একটা শিং আছে) ভারি ক্ষতি করে চলেছে। সেটাকে তোমায় ধরতে হবে।”
দর্জি বুক ফুলিয়ে বলল, “দুটো দৈত্যের চেয়েও একটা ইউনিকর্নকে আমি কম ভয় করি। আমার লড়াই করার কায়দা—এক ঘায়ে সাতটা সাবাড় করা।”
একগাছা দড়ি আর একটা কুড়ল নিয়ে বনে পৌছে দলের লোকজনদের সে বলল বাইরে অপেক্ষা করতে। বেশিক্ষণ তাকে খোঁজাখুঁজি করতে হল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল সেই ইউনিকর্নকে। দর্জির দিকে এমনভাবে সেটা তেড়ে এল যেন চক্ষের নিমেষে শিঙ দিয়ে গুতিয়ে তাকে শেষ করে ফেলবে।
দর্জি চেঁচিয়ে উঠল, “ধীরে—ধীরে—অত তাড়াহুড়োর দরকার নেই।”
স্থির হয়ে সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। জন্তুটা একেবারে গায়ের ওপর এসে পড়তে তড়াক করে এক লাফে সে সরে গেল একটা গাছের পিছনে। পাগলের মতো সেই গাছটার দিকে ছুটে গিয়ে শিঙ দিয়ে জন্তুটা এমন জোরে গাছটার গুড়ি গুতলো যে, সেখানে শক্ত হয়ে গেঁথে গেল তার শিঙ। কিছুতেই টেনে সেটা সে ছাড়াতে পারল না।
গাছের পিছনে থেকে বেরিয়ে এসে দর্জি বলল, “এবার তোমায় কায়দায় পেয়েছি, জাদু!” তারপর দড়িটা তার গলায় বেঁধে, গাছের শুড়িতে গাঁথা শিঙটা কুড়ল দিয়ে কেটে সেটাকে সে নিয়ে গেল রাজার কাছে। রাজা কিন্তু সেই প্রতিশ্রুত পুরস্কার তাকে দিলেন না। তিনি জানালেন তৃতীয় কড়ারের কথা। বললেন–বিয়ের দিনক্ষণ স্থির হবার আগে দর্জিকে ধরতে হবে একটা বুনো শুয়োর। সেখানে সেটা দারুণ উৎপাত করে চলেছে। সেটাকে ধরতে নানা শিকারী সাহায্য করবে।
দর্জি বলল, “সানন্দেই যাচ্ছি। একটা বুনো শুয়োর ধরা তো নেহাতই ছেলেখেলা ৷” শিকারীদের সঙ্গে সে নিল না। তাতে শিকারীর দল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ আগে বুনো শুয়োরটাকে ধরতে গিয়ে তারা দারুণ নাজেহাল হয়েছিল।
দর্জিকে দেখামাত্র দাঁত কিসকিস করতে-করতে শুয়োরটা তেড়ে এল। মুখ দিয়ে তখন তার গাঁজলা বেরুচ্ছে। কিন্তু সেই চটপটে দর্জি সঙ্গে সঙ্গে সেঁধিয়ে পড়ল কাছের একটা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে আর চক্ষের নিমেষে বেরিয়ে গেল জানলা দিয়ে। শুয়োরটা তার পিছন পিছন কুড়ে ঘরে ঢুকতে পিছন থেকে ছুটে এসে দর্জি দিল দরজাটা বন্ধ করে। কুঁড়েঘরের মধ্যে বন্ধ হওয়ার দরুন গজরাতে লাগল জম্ভটা। বেজায় সেটা মোটাসোটা। তাই জানলা গলে বেরুতে পারল না।
দর্জি তখন শিকারীদের ডেকে বলল কী ঘটেছে নিজের চোখে দেখে আসতে। তার পর দর্জি গেল রাজার কাছে আর তাকে বৰল—এবার তিনি তার অঙ্গীকার পালন করতে বাধ্য; অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যেকে তাকে দিতে হবে। রাজা যদি জানতেন সে বীর সৈনিক নয়, আসলে ছোট্টো এক দর্জি তা হলে নিশ্চয়ই নিজের কথা রাখতেন না।
যাই হোক –ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। সেই দর্জি হল এক রাজা। একদিন সেই তরুণী রানী শোনে ঘুমের মধ্যে তার স্বামী বিড়, বিড়, করে বলছে, “এই ছোকরা–এক্ষুনি আমার ওয়েস্টকোট শেষ করে ট্রাউজারটা টেকে দে, নইলে তোর গজকাঠি দিয়ে তোর মাথায় বাড়ি দেবো।” তখন সে বুঝতে পারল তার স্বামীর জন্ম কোন পরিবারে। পরদিন সকালে তার বাবার কাছে গিয়ে সে অভিযোগ করল—যার সঙ্গে রাজা তার বিয়ে দিয়েছেন, আসলে সে নগণ্য একটা দর্জি।
রাজা মেয়েকে সান্তনা দিয়ে বললেন, “কাল রাতে ঘরের দরজাটা খুলে রাখিস। আমার চাকর বাইরে অপেক্ষা করবে। ও ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি ভেতরে গিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে তাকে তুলে দেবে একটা জাহাজে। জাহাজটা তাকে নিয়ে চলে যাবে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে।”
কথাটা শুনে রাজকন্যে খুশি হল। কিন্তু দর্জি-রাজার ভৃত্য অন্য রাজার কথাগুলো শুনেছিল। তাই প্রভুর কাছে গিয়ে এই ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দিল।
সব শুনে দর্জি-রাজা বলল, “ঠিক আছে। এই সামান্য ব্যাপারটার নিম্পত্তি আমি করছি।”
রাতে যথাসময়ে সে গিয়ে শুলো তার বউয়ের পাশে। রাজকন্যের যখন মনে হল দর্জি-রাজা ঘুমিয়ে পড়েছে তখন চুপি চুপি উঠে দরজাটা খুলে দিয়ে ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ল। ছোট্টো দর্জি ঘুমের শুধুই ভান করছিল। হঠাৎ সে তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “এই ছোকরা— এক্ষুনি আমার ওয়েস্টকোট শেষ করে ট্রাউজারটা টেঁকে দে, নইলে তোর গজকাঠি দিয়ে তোর মাথায় বাড়ি দেব। এক ঘায়ে সাতজনকে আমি খতম করেছি, মেরেছি দুটো দৈত্য, ধরেছি একটা ইউনিকর্ন আর বুনো শুয়োর। দরজার বাইরে যে দাঁড়িয়ে তাকে আমি পরোয়া করি নাকি? ছোট্টো দর্জির চীৎকার শুনে সবাই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। যারা তাকে বাঁধতে এসেছিল তারা পড়িমড়ি করে ছুটে পালাল। আর তার পর কেউই তাকে কোনোদিন স্পর্ম করতে সাহস করে নি। এইভাবে সেই ছোট্টো দর্জি সারা জীবন কাটালো রাজা হয়ে।
COMMENTS