মিসির আলির চশমা || ২য় পর্ব || মিসির আলি সিরিজ অনলাইন || হুমায়ূন আহমেদ

মিসির আলি কুরিয়ারে একটা দীর্ঘ চিঠি পেয়েছেন। চিঠির প্রেরকের নাম শায়লা রশিদ। পুনশ্চতে লেখা— ড. হারুন রশিদ নামে যে চোখের ডাক্তার আপনার চিকিত্সা করছেন। আম

 দ্বিতীয় পর্ব 


#মিসির_আলি সিরিজ থেকে

মিসির আলির চশমা - হুমায়ূন আহমেদ


মিসির আলি কুরিয়ারে একটা দীর্ঘ চিঠি পেয়েছেন। চিঠির প্রেরকের নাম শায়লা রশিদ। পুনশ্চতে লেখা— ড. হারুন রশিদ নামে যে চোখের ডাক্তার আপনার চিকিত্সা করছেন। আমি তাঁর স্ত্রী। দশ পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি, এক বৈঠকে লেখা এটা বোঝা যাচ্ছে। চিঠি লিখতে লিখতে উঠে গিয়ে আবার লিখতে বসলে শুরুর লেখায় টানা ভাব কমে যায়। লেখার গতি কমে যায় বলেই এটা হয়।

চিঠি না পড়েই মিসির আলি পত্ৰ লেখিকার বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন।

(ক) মহিলা ধৈর্যশীলা। যিনি এক বৈঠকে এত বড় চিঠি লিখবেন, তার ধৈর্য থাকতেই হবে।

(খ) মহিলা শান্ত। তাঁর মধ্যে অস্থিরতা নেই। মানসিক অস্থিরতার ছাপ লেখায় চলে আসে। এই মহিলার হাতের লেখায় অস্থিরতা নেই।

(গ) মহিলা অত্যন্ত গোছানো। কারণ তিনি চিঠি লেখার সময় বাংলা ডিকশনারি পাশে নিয়ে বসেছেন। ভুল বানান ডিকশনারি দেখে শুদ্ধ করেছেন।

(ঘ) মহিলা বুদ্ধিমতী। কারণ তিনি ব্যবস্থা করেছেন যেন মিসির আলি পুরো চিঠি পড়েন। সম্বোধনেই সেই ব্যবস্থা করা। মহিলা মিসির আলিকে ‘বাবা’ সম্বোধন করেছেন। ‘বাবা’ সম্বোধনে লেখা চিঠি অগ্রাহ্য করা কোনো পুরুষের পক্ষেই সম্ভব না। মেয়েদের পক্ষে ‘মা’ সম্বোধনের চিঠি অগ্রাহ্য করা। খুবই সম্ভব। তারা নানানভাবে। মা’ ডাক শুনে অভ্যস্ত। পুরুষরা ‘বাবা’ শুনে অভ্যস্ত না। কেউ বাবা ডাকলেই সেই ডাক পুরুষদের মাথার ভেতর ঢুকে যায়।

মিসির আলি চিঠি পড়তে শুরু করলেন। তাঁর হাতে একটা লাল কালির বল পয়েন্ট। চিঠির

কোনো কোনো জায়গা লাল কালি দিয়ে। আন্ডার লাইন করতে হবে বলে তাঁর ধারণা। এই কাজটা

প্রথম পড়াতেই শেষ হয়ে যাওয়া ভালো।

প্রিয় বাবা,

আমার বিনীত সালাম নিন।

মিসির আলি লাল কালি দিয়ে প্রিয় বাবা আন্ডার লাইন করলেন।

সম্বোধন পড়ে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। একজন চিরকুমার মানুষের কন্যা থাকার কথা না। কন্যাস্থানীয়া অনেকেই থাকবে, তারা বাবা। ডাকবে না। চাচা ডাকবে কিংবা আধুনিক কেতায় আংকেল ডাকবে। আপনাকে আমি কেন বাবা ডাকছি তা অন্য কোনো দিন। ব্যাখ্যা করব।

মিসির আলি আবারো লাল কালি দিয়ে দাগ দিলেন। ‘অন্য কোনো দিন ব্যাখ্যা করব’ এই বাক্যের নিচে দাগ পড়ল।

আপনি অনেকের অনেক জটিল সমস্যার সহজ ব্যাখ্যা দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। আমি আপনাকে অতি জটিল একটা সমস্যা দিচ্ছি। সমস্যার ব্যাখ্যা আমি নিজে নিজে বের করেছি। ব্যাখ্যা ঠিক আছে কি-না। তা শুধু আপনি বলে দিবেন। এই দীর্ঘ চিঠিতে আমি শুধু সমস্যাটি বলব। ব্যাখ্যায় যাব না। আপনি রহস্য সমাধানের পর আমি আমার সমাধান বলব।

আপনার সঙ্গে ‘রহস্যসমাধান’ খেলা আমি খেলতে পারি না। আমার ধৃষ্ঠতা ক্ষমা করবেন। যাই হোক, এখন। সমস্যাটি বলি।

অল্পবয়সে আমার বাবা-মা দু’জনই মারা যান। আমি বড় হই আমার ছোট চাচার আশ্রয়ে। চাচা-চাচি দু’জনই মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-মা নেই, এটা তাঁরা কোনোদিনই বুঝতে দেন নি। ছোট চাচিকে আমি চাচি না ডেকে সবসময়ই মা ডেকেছি। চাচাকে। বাবা ডাকতে শুরু করেছিলাম। চাচা ডাকতে দেন নি।

মিসির আলি লাল কলমে পুরো প্যারাটা দাগ দিলেন। তার ভুরু সামান্য কুঞ্চিত হলো। মেয়েটি তাঁকে কেন বাবা সম্বোধন করেছে তা মনে হয় পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। সে নিজের বাবাকে বাবা ডাকতে পারে নি। চাচাকে ডাকতে গিয়েছিল, অনুমতি পায় নি। কাউকে বাবা ডাকার তীব্র ইচ্ছা থেকেই কি বাবা সম্বোধন?

আমার চাচা-চাচি অনেক যাচাই-বাছাই করে আদর্শ এক পাত্রের সঙ্গে আমার বিয়ে দিলেন। পাত্র আদর্শ, কারণ তার চেহারা রাজপুত্রের মতো। আফ্রিকান কালো রাজপুত্র না, গ্রিক রাজপুত্র। আর্য সন্তান। আপনি তো আমার স্বামীকে দেখেছেন। বলুন সে রাজপুত্র না? এখন অবশ্যি চিন্তায় ভাবনায় চোখের নিচে কালি জমেছে। মাথায় টাক পড়েছে। মন্ত্রীপুত্র টেকো হলেও মানিয়ে যায়। টাক মাথার রাজপুত্র মানায় না।

যাই হোক, আমার রাজপুত্র ডাক্তার। পড়াশোনা করেছেন আমেরিকায়। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। চোখের কর্নিয়া রিপ্লেসমেন্টের একটি বিশেষ অপারেশন তাঁর আবিষ্কার। মেডিকেল জার্নালে Haroon’s cornia grafting হিসেবে এর উল্লেখ আছে।

এই রাজপুত্রের ঢাকা শহরের ওয়ারীতে একটা দোতলা বাড়ি। আছে। বাড়ির নাম ‘ছায়াকুটির’। ছায়া আমার শাশুড়ির ডাকনাম। আমার শ্বশুর সাহেব স্ত্রীকে যে নামে ডাকতেন বাড়ির কপালেও সেই জুটল। তাদের দু’টা গাড়ি আছে। একটা কালো রঙের মরিস মাইনর, একটা লাল রঙের ভক্সওয়াগন।

আমার শ্বশুর সাহেব ব্যাংকার ছিলেন। হাসিখুশি ফুর্তিবাজ মানুষ। বিয়ের পানচিনিতে তাঁকে আমি প্রথম দেখি। আমাকে পাশে বসিয়ে তিনি বললেন, আমার ছেলে আমাকে ডাকে বাবুই। তাকে শেখানো হয়েছিল বাবাই ডাক। সে ডাকা শুরু করল বাবুই। আমি তার কাছে হয়ে গেলাম—

‘পক্ষী’। তুমিও আমাকে বাবুই ডাকবে। পুত্র এবং পুত্রবধূ দু’জনের কাজেই আমি পক্ষী হিসেবে থাকব। হা হা হা।

আমার শ্বশুর সাহেবকে আমার বাবুই ডাকা হয় নি। আমাদের বিয়ে হলো রাত আটটায়। উনি সেই রাতেই এগারোটার দিকে মারা গেলেন। বিয়ের আনন্দবাড়ি শোকে ডুবে গেল। আমার শাশুড়ি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন। আমি সাক্ষাৎ ডাইনি। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।

বাসর রাত নিয়ে কত সুন্দর সুন্দর গল্প শুনেছি। আমাদের বাসর ছিল বেহুলা-লক্ষিন্দর টাইপ বাসর। যেন আমাদের দু’জনের মাঝখানে কিলবিল করছে ভয়ঙ্কর কাল সাপ।

আমার শাশুড়ি শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কথাবার্তা খুব কম। বলতেন। শুধু নিজের ছেলের সঙ্গে গলা নিচু করে নানান কথা বলতেন। তিনি এক অর্থে ভাগ্যবতী ছিলেন। ছেলে পেয়েছেন মাতৃভক্ত। বিদ্যাসাগর মায়ের জন্যে সাঁতরে দামোদর নদী পার হয়েছিলেন। আমার শাশুড়ির ছেলে মায়ের জন্যে সাঁতরে যমুনা পার হতো। যদি সে সাঁতার জানত। হারুন সাঁতার জানে না।

হারুনের মাতৃভক্তির নমুনা না দিলে আপনি বুঝবেন না। আমি নমুনা দিচ্ছি। আমার শাশুড়ি তাঁর শোবার ঘরের দরজা কখনো বন্ধ করতেন না। সারারাত দরজা খোলা থাকত। কারণ তাঁর ছেলের ভয় পাওয়া রোগ আছে। ভয় পেলে সে যেন যে-কোনো সময় মা’র ঘরে যেতে পারে

সেই ব্যবস্থা। এমন অনেকবার হয়েছে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছি, আমার বিছানার পাশে সে নেই। আমি আমার শাশুড়ির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছি, মাতা-পুত্ৰ খাটের উপর বসে গল্প করছে। দু’জনই আনন্দিত। আমি সবসময় চেষ্টা করতাম ওরা যেন আমার উপস্থিতি টের না পায়। কিন্তু

প্রতিবারই আমার উপস্থিতি আমার শাশুড়ি টের পেতেন এবং বিরক্ত কিন্তু শান্ত গলায় বলতেন, বৌমা তুমি শুয়ে পড়, আমি ওকে পাঠাচ্ছি।

আমার এবং হারুনের আলাদা কোনো জীবন ছিল না। মনে করুন রেস্টুরেন্টে খেতে যাব, সেখানেও আমার শাশুড়ি। হারুন মা’কে ছাড়া কোথাও যাবে না। আমার শাশুড়ি আপত্তি করতেন। তিনি বলতেন, তোরা দু’জন খেতে যাচ্ছিস যা। আমি কেন? হারুন রেগে গিয়ে বলত তোমাকে ছাড়া আমি যদি রেস্টুরেন্ট খেতে যাই, তাহলে আমার নাম হারুন রশীদ না। আমার নাম কুত্তা রশীদ। এরপর আর কারোই বলার কিছু থাকে। না।

তবে একবার শুধু আমরা দু’জন কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি হারুন ড্রাইভ করেছে। আমি বসেছি তার পাশে। কী আনন্দের ভ্রমণ যে সেটা ছিল! থামতে থামতে যাওয়া। দরিদ্র চায়ের দোকানে গাড়ি থামিয়ে চা খাওয়া। যাওয়ার পথে এক জায়গায় হাট পড়ল। আমরা গ্রাম্য হাটে ঘুরে বেড়ালাম। কাঁচামরিচ, পটলের দাম করলাম। হারুন বলল, ঐ দেখ গরু ছাগলের হাট। দূরদাম করে একটা ছাগল কিনে ফেলব। নাকি? আমি বললাম, কিনবেই যখন ছাগল কেন, এসো একটা গরু কিনে ফেলি। গাড়ির ছাদে করে নিয়ে যাই।

আনন্দ করতে করতে আমরা কক্সবাজারে পৌঁছলাম রাত আটটার দিকে। পর্যটনের একটা মোটেল আছে, শৈবাল নাম। সেখানে আমাদের একটা ডিলাক্সরুম বুকিং দেয়া ছিল। শৈবালের লাউঞ্জে এসে আমি হতভম্ব হয়ে দেখি, আমার শাশুড়ি বিশাল এক সুটকেস নিয়ে লাউঞ্জে বসে

আছেন। প্রথম ভাবলাম চোখে ভুল দেখছি। আমি হারুনের দিকে তাকালাম। সে আনন্দিত গলায়

বলল, তুমি সারপ্রাইজ হয়েছ কি-না বলো? আমি শীতল গলায় বললাম, সারপ্রাইজ হয়েছি।

সে বলল, বেশি সারপ্রাইজ না মিডিয়াম সারপ্রাইজ?

আমি বললাম, বেশি সারপ্রাইজ।

হারুন বলল, তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে আমি এই কাজ করেছি। মা’কে প্লেনের

টিকিট কেটে দিয়ে এসেছিলাম। আমরা রওনা হবার পর মা প্লেনে উঠেছেন। আমাদের আগে

পৌছেছেন। ভালো করেছি না?

আমি বললাম, ভালো করেছ।

হারুন বলল, আমি সাঁতার জানি না তো। মা পাশে থাকলে ভয় নেই। মা আবার সাঁতারে এক্সপার্ট।

আমি শাশুড়ির কাছে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে অনেকক্ষণ দোয়া করলেন।

কক্সবাজার ট্রিপটা আমার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার ধারণা সেখানেই আমি কনসিভ করি। এইসব জিনিস মেয়েরা বুঝতে পারে। আমি আমার বাবুর নামও ঠিক করে ফেলি। ছেলে হোক বা মেয়েই হোক, আমার বাবুর নাম হবে সাগর।

কক্সবাজার থেকে ফেরার আটমাসের মাথায় সাগরের জন্ম হলো। কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে। বড় বড় চোখ। আমি তার চোখের দিকে তাকালেই সাগর দেখতে পাই। বাবুকে যখনই কোলে। নিতাম আমার কাছে মনে হতো, আমার যা পাওয়ার আমি পেয়ে গেছি। এই পৃথিবীতে আমার আর কিছু চাইবার নেই। এক সেকেন্ডের জন্যেও বাবুকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করত না। বাধ্য হয়ে আমি বাবুকে না দেখে থাকতাম, কারণ আমি তখন। কেমিস্ট্রির লেকচারারশিপের চাকরি পেয়েছি। সরকারি কলেজের চাকরি। ক্লাস বেশি না, কিন্তু ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিনই

যেতে হতো। প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন খুবই কড়া।

চিল আকাশে উড়ে, তার দৃষ্টি থাকে স্থলে। আমি কলেজে ছাত্র পড়াই, আমার মন পড়ে থাকে বাবুর কাছে। আমার শাশুড়ি কি ঠিকমতো দেখাশোনা করছেন? কাজের মেয়েটা কি পানি সেদ্ধ করে ফর্মুলা বানাচ্ছে? না-কি ট্যাপের পানি দিয়ে। কাজ সারছে? সাগর কি ভেজা। কাঁথায় শুয়ে আছে? তার কথা কি সময়মতো বদলানো হচ্ছে? তাকে গোসল দেয়ার সময় কানে পানি ঢুকে নি তো? বিছানার ঠিক মাঝখানে তাকে শোয়ানো হচ্ছে তো? সিলিং ফ্যানের নিচে শোয়ানো হচ্ছে না তো? কতরকম দুর্ঘটনা হয়। দেখা গেল, ফ্যান সিলিং থেকে খুলে নিচে পড়ে গেছে।

একটা শিশুকে একা বড় করা যায় না। সবার সাহায্য লাগে। হারুনের কোনো সাহায্য আমি পেলাম না। সব বাবাই প্রথম সন্তান নিয়ে অনেক আহ্লাদ করে। বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে থাকা, ছবি তোলা… হারুন তার কিছুই করল না। একসময় সে আলাদা বিছানা করে ঘুমুতে শুরু করল। রাতে বাচ্চা জেগে থাকে, কান্নাকাটি করে, তার না-কি ঘুমের সমস্যা হয়।

একদিন অবাক হয়ে দেখি হারুনের গলায় দু’টা বিজ। আমি বললাম, তাবিজ কিসের?

সে জবাব দেয় না। আমতা আমতা করে। খুব চেপে ধরায় বলল, মা দিয়েছেন। সামনে আমার মহাবিপদ, এই জন্যেই তাবিজ।

আমি বললাম, উনি কী করে বুঝলেন, সামনে তোমার মহাবিপদ?

হারুন বলল, মা স্বপ্নে। দেখেছেন। উনি স্বপ্নে যা দেখেন তাই হয়।

স্বপ্নে কী দেখেছেন?

হারুন অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, মা’র স্বপ্ন। তোমাকে বলব না।

কেন বলবে না? মা নিষেধ করেছেন।

আমি অতি দ্রুত দুই এ দুই এ চার মেলালাম। আমাকে স্বপ্ন বলতে নিষেধ করা হয়েছে, এর অর্থ একটাই স্বপ্নে আমার ভূমিকা আছে। খুব সম্ভব হারুনের মহাবিপদের সঙ্গে আমি যুক্ত।

আমি বললাম, তোমার মহাবিপদে কি আমার কোনো ভূমিকা আছে? মহাবিপদটা কি আমি ঘটাচ্ছি?

হারুন মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, হু।

আমি বললাম, তোমাকে আমি খুন করছি এরকম কিছু?

হারুন আবার বলল, হঁ।

খুনটা করছি কীভাবে? গলা টিপে?

হারুন বলল, ছুরি দিয়ে গলা কেটে।

এই জন্যেই কি তুমি আলাদা ঘুমাও?

হু।

তুমি বুদ্ধিমান আধুনিক একজন মানুষ। বিদেশে পড়াশোনা করেছ। স্বপ্নের মতো হাস্যকর জিনিস তুমি বিশ্বাস কর?

না।

তাহলে গলায় তাবিজ ঝুলিয়ে ঘুরছ কেন? তাবিজ খোল।

না।

না কেন?

মা রাগ করবে।

মা-ই কি তোমার সব? আমি কিছু না? তোমার ছেলে কিছু না?

হারুন জবাব দিল না। আমি বললাম, তোমাকে একটা অনুরোধ করব। তোমাকে সেই অনুরোধ রাখতে হবে। বললা রাখবে। হারুন বলল, রাখব।

আমার হাত ধরে বলে রাখবে।

হারুন আমার হাত ধরে বলল, সে অনুরোধ রাখবে।

এবং আমার এই অনুরোধের কথা মা’কে জানতে পারবে না।

জানাব না।

আমার অনুরোধ হচ্ছে, তুমি একটা ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া করবে। সেই ফ্ল্যাটে আমি, তুমি এবং বাবু থাকব। তোমার মা থাকবেন না।

হারুনের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দিনেদুপুরে ভূত দেখলে মানুষের যে অবস্থা হয়। সেই অবস্থা। সে বিড়বিড় করে বলল, এই স্বপ্নটাই মা দেখেছেন।

আমি বললাম, বিড়বিড় করবে না। পরিষ্কার করে বলে।

হারুন বলল, মা স্বপ্ন দেখেছেন মা’কে এ বাড়িতে রেখে আমরা তিনজন আলাদা। ফ্ল্যাট

ভাড়া করেছি। তারপর তুমি আমাকে খুন করেছ।

আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমার মা স্বপ্নে যাই দেখুন, তুমি আমাকে কথা দিয়েছ আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করবে। তুমি যদি ফ্ল্যাট ভাড়া না নাও তাহলে আমি কিন্তু বাবুকে নিয়ে চাচার বাসায় চলে যাব। বাকিজীবন তুমি আমার বা তোমার ছেলের দেখা পাবে না। I mean it.

হারুন বলল, ফ্ল্যাট ভাড়া করব।

সত্যি? হ্যা সত্যি।

হারুন সত্যি সত্যি ফ্ল্যাট ভাড়া করল। তিনতলায় চার কামরার সুন্দর ফ্ল্যাট। দক্ষিণে খোলা। বারান্দা আছে। ফ্ল্যাট দেখে আমি মুগ্ধ। হারুনদের পুরনো বাড়ির উঁচু সিলিং আমার খুব অপছন্দ

ছিল। সেই বাড়ির চারদিকে বড় বড় গাছপালা। গাছের জন্যে বাড়িতে আলো ঢুকতে পারত না

এমন অবস্থা।

এপ্রিল মাস থেকে বাড়ি ভাড়া নেয়া হলো। আমরা ঠিক করলাম এপ্রিল মাসের এক তারিখ April fool’s day. সেদিন নতুন ফ্ল্যাটে না গিয়ে দু’ তারিখে। উঠব। আমি ভেবেছিলাম আমার

শাশুড়ি ব্যাপারটা নিয়ে খুব হৈচৈ করবেন, বেঁকে দাঁড়াবেন। সেরকম কিছুই করলেন না। বরং শান্তগলায় বললেন, ঠিক আছে। যাও। সপ্তাহে একদিন বাবুকে এনে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, অবশ্যই।

শাশুড়ি বললেন, তোমার চাচার বাড়ি থেকে কাউকে স্থায়ীভাবে এনে তোমাদের ফ্ল্যাটে রাখতে পার কি-না দেখ। তুমি কলেজে চলে যাবে, কাজের মেয়েদের হাতে এত ছোট বাচ্চা রেখে

যাওয়া ঠিক না।

আমি বললাম, সেই ব্যবস্থা করব।

মহা আনন্দে আমি গোছগাছ শুরু করলাম। নতুন সংসার শুরু করতে যাচ্ছি সেই আনন্দেও আমি আত্মহারা। মা’র কঠিন বলয় থেকে হারুনের মুক্তিও অনেক বড় ব্যাপার।

এপ্রিল মাসের দু’তারিখ বাড়ি ছাড়ব, এক তারিখে দুর্ঘটনা ঘটল। আমার বাবু মারা গেল। আমি তখন কলেজে। প্রাকটিক্যাল ক্লাস নিচ্ছি। কলেজের প্রিন্সিপাল হঠাৎ ক্লাসে ঢুকে বললেন, শায়লা আপনি এক্ষুনি বাড়ি যান। আপনার বাচ্চা অসুস্থ। আমার গাড়ি আছে, গাড়ি নিয়ে যান।

বাড়িতে পৌঁছে দেখি আমার শাশুড়ি মৃত বাচ্চা কোলে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। তিনি ক্ষীণগলায় বললেন, বৌমা সব শেষ।

আমার বাচ্চাটি কীভাবে মারা গেল, তার কী হয়েছিল, আমি কিছুই জানতে পারি নি। আমার

শাশুড়ি আমাকে বলেন নি। যে কাজের মেয়েটি বাচ্চার। দেখাশোনা করত তাকেও পাওয়া যায় নি। দুর্ঘটনার দিন কাচের জগ ভাঙার মতো অতি গুরুতর অপরাধে (?) তার চাকরি চলে যায়। আমার শাশুড়ি তাকে বেতন দিয়ে বিদায় করে দেন। বাসায় একজন কেয়ারটেকার থাকত, সবুর মিয়া। সবুর মিয়াও ঘটনার সময় বাসায় ছিল না। শাশুড়ি তাকে কী এক কাজে নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়েছিলেন। আমি শাশুড়ির কাছ থেকে ঘটনা জানতে চেয়েছি, তিনি কিছুই বলেন নি। শুধু

বলেছেন, আমি কিছু বলব না, তোমরা ফ্ল্যাট বাড়িতে চলে যাও। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।

আমি বাচ্চাটার সুরতহাল করাতে পারতাম, তার জন্যে পুলিশ কেইস করতে হতো। সেটা করা সম্ভব ছিল না। আমার নিজের মাথাও তখন পুরোপুরি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম আমার ছোট্ট বাবু হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে আসছে। তার সব ঠিক আছে হাসি হাসি মুখ, বড় বড় মায়াভর্তি চোখ; শুধু মুখ দিয়ে টপটপ করে। রক্তের ফোঁটা পড়ছে। দীর্ঘদিন গুলশানের এক মনোরোগ ক্লিনিকে আমাকে কাটাতে হয়েছে। সেখানেই আমি একবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইডের চেষ্টা করি।

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমার শাশুড়ি মারা গেছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু। ডায়রিয়া হয়ে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু মৃত্যুর পরও তিনি আমার স্বামীকে ছাড়েন নি। এখনো হারুনের ঘাড়ে ভর করে আছেন। তিনি হারুনকে কন্ট্রোল করে যাচ্ছেন। হারুন তার জীবিত মায়ের দ্বারা যেভাবে চালিত হতো, মৃত মাও তাকে সেভাবেই চালিত করছে।

আমাদের আর কোনো ছেলেমেয়ে হয় নি। কারণ আমার শাশুড়ি তাঁর অতি আদরের ছেলেকে বলেছেন যেন আমার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক না হয়।

আমি আপনাকে লেখা। আমার এই দীর্ঘ চিঠি এখানে শেষ করছি। আপনাকে ‘বাবা’ সম্বোধন করেছি যেন আপনি চিঠির এক কন্যার প্রতি দয়া করেন এবং চিঠি-কন্যার পুত্রের মৃত্যুরহস্য বের করেন। আমার ধারণা এই রহস্য ভেদ হওয়া মাত্র হারুনের মোহমুক্তি ঘটবে। সে তার মৃত মা’কে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলবে। আমি হারুনকে নিয়ে। সত্যিকার সংসার শুরু করতে পারব।

বিনীতা

চিঠিকন্যা শায়লা


(লেখকের কথা)

একেকজন মানুষের গল্প বলার Style একেক রকম। অতি সাধারণ কথা মিসির আলি যখন বলেন তখন মনে হয় দারুণ রহস্যময় কোনোকিছুর বর্ণনা দিচ্ছেন। উদাহরণ দেই— একদিন তাঁর বাসায় গেছি। তিনি জানালার পাশে বসে গল্প করছেন। গল্পের এক পর্যায়ে বললেন ‘বুঝলেন ভাই! তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি এত্ত বড় একটা চাঁদ। শুনে আমার গা ছমছম করে উঠল। আমি চমকে মিসির আলির জানালা দিয়ে তাকলাম। অথচ চমকাবার কিছু নেই। পূর্ণিমার রাতে জানালা দিয়ে এত্ত বড় চাঁদ দেখা যেতেই পারে।

এই তিনিই আবার অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার এমন সাদামাটাভাবে বলেন যেন এটা কিছুই না। এরকম রোজই ঘটছে। এক সিরিয়েল কিলার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হাই তুলতে তুলতে বললেন ‘লোকটার অভ্যাস ছিল খেজুরের কাঁটা দিয়ে ভিকটিমের চোখ গেলে দেয়া। তাঁর বলার ভঙ্গি, বলতে বলতে হাই তোলা থেকে শ্রোতাদের ধারণা হবে খেজুরের কাঁটা দিয়ে চোখ তোলা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এমন কিছু না।

আমি অনেকদিন থেকেই মিসির আলিকে বলছিলাম, তাঁর রহস্য সমাধানের প্রক্রিয়ায় খুব কাছ থেকে আমি যুক্ত হতে চাই। আমি দেখতে চাই তিনি কাজটা কীভাবে করেন। লজিকের সিঁড়ি কীভাবে পাতেন। রহস্যের প্রতি আমার আগ্রহ না। আমার আগ্রহ রহস্যভেদ প্রক্রিয়ার প্রতি। সুযোগ সে অর্থে আসে নি। আমি নিজে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকি, মিসির আলি ঘরকুনো মানুষ। তিনি নিজেও তাঁর মানসিক জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দু’জনের দেখা হয় না বললেই হয়।

এই সময় আমি আমার পারিবারিক ট্র্যাজেডির নায়ক হয়ে বসলাম। সমাজের একজন দুষ্ট মানুষ হিসেবে আমার পরিচয় ঘটল এবং মিটিং করে নিজের বাড়ি থেকে বের করে। দেয়া হলো। পত্র-পত্রিকাগুলিতে ছাপার মতো খবর অনেক দিন ছিল না। তারা মনের আনন্দে আমাকে নিয়ে নানান গল্প ফাঁদতে লাগল। মিসির আলি সাহেবের যে গল্পটি এখানে লিখছি, সেখানে আমার ব্যক্তিগত গল্পের স্থান নেই বলেই নিজের গল্প বাদ থাকল। অন্য কোনোদিন সেই গল্প বলা হবে।

যাই হোক, আমি বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে কিছুদিন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করলাম। বন্ধু-বান্ধবরা তেমন আগ্রহ দেখাল না। ‘মহাবিপদ’ কে সেধে পুষতে চায়? বাধ্য হয়ে উত্তরায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলাম। তিনতলায় একা থাকি। দিনেরবেলা অফিসের একজন পিয়ন থাকে। হোটেল থেকে খাবার এনে দিয়ে সন্ধ্যায় নিজের বাসায় চলে যায়। আমি তাকে চক্ষুলজ্জায় বলতে পারি না যে তুমি। থাকো। এত বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতে ভয় পাই।

ভয় পাওয়ার কারণ হচ্ছে, আমি মোটামুটি নিশ্চিত ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি না। আমার সঙ্গে বিদেহী কোনো আত্মাও থাকেন। তিনি গভীর রাতে কাঠের মেঝেতে হাঁটাহাঁটি করেন। শব্দ করে নিঃশ্বাস নেন। রান্নাঘরে পানির টেপ ছেড়ে হাতেমুখে পানি দেন। এক রাতের ঘটনা তো ভয়ঙ্কর। রাত তিনটা বাজে। বাথরুমে যাবার জন্যে বিছানা ছেড়ে নেমেছি, হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে বেঁটে মতো এক ছায়া মূর্তি। সে আমার চোখের সামনে ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চলে গেল। আমি বিকট চিৎকার দিতে গিয়েও দিলাম না। চিঙ্কার দিয়ে তো লাভ নেই। যে বিদেহী আত্মা আমার সঙ্গে বাস করেন, তিনি ছাড়া আমার চিৎকার কেউ শুনবে না।

এরপর থেকে ঐ বাড়িতে রাত কাটানো আমার জন্যে বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। সন্ধ্যার পর প্রতিটি ঘরের বাতি জ্বালিয়ে রাখি। কারেন্ট চলে যেতে পারে এই ভয়ে সব ঘরেই চার্জার। আমার বালিশের নিচে থাকে। টৰ্চলাইট। হাতের কাছে টেবিলে দেয়াশলাই এবং মোমবাতি। লোহা সঙ্গে রাখলে ভূত আসে। না। আমার শোবার ঘরে এই কারণেই রট আয়রনের খাট কিনে সেট করা হলো। তারপরেও ভয় কাটে না। রাতগুলি বলতে গেলে জেগেই কাটাই।

আমার এই বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় মিসির আলি হঠাৎ খুঁজে খুঁজে বাসায় উপস্থিত হলেন। তিনি এসেছেন পত্রপত্রিকা পড়ে। মিসির আলি আবেগপ্রবণ মানুষ কখনো ছিলেন। না। তাঁর আবেগ এবং উচ্ছাস খুবই নিয়ন্ত্রিত। তারপরেও তিনি যথেষ্ট আবেগ দেখালেন। আমাকে বললেন, আপনার মতো গৃহী মানুষকে ঘরছাড়া দেখে খারাপ লাগছে। বলুন আপনার জন্যে কী করতে পারি?

আমি বললাম, আপাতত আপনি আমাকে ভূতের হাত থেকে বাঁচান। একটা ভূত আমাকে রাতে ঘুমাতে দিচ্ছে না। কাঠের ফ্লোরে সে রাতে হাঁটাহাঁটি করে। আমি নিজে ভূতটাকে দেখেছি।

মিসির আলি বললেন, কাঠ দিনের গরমে। প্রসারিত হয়। রাতের ঠাণ্ডায় সঙ্কুচিত হয়। তখনই নানান শব্দ হয়।

আমি বললাম, কাঠের এই ব্যাপারটা মানলাম। কিন্তু রান্নাঘরে ভূতটা পানির কল ছাড়ে। ছড়ছড় করে পানি পড়ার শব্দ আমি রোজ রাতেই দুই তিনবার শুনি।

মিসির আলি শান্তগলায় বললেন, রাতে চারদিক থাকে নীরব। আপনার নিচের তলা বা উপরের তলার লোকজন যখন কল ছাড়ে তখন সেই শব্দ ভেসে আসে। এর বেশি কিছু না। আপনি ভূতের ভয়ে মানসিকভাবে উত্তেজিত থাকেন বলেই হালকা পানি পড়ার শব্দ বড় হয়ে কানে বাজে।

আমি বললাম, সরাসরি যে ভূত দেখেছি সেটা কী? বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গেলাম, হাঁটু সাইজের একটা ভূত দেয়ালের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত গেল এবং মিলিয়ে গেল।

মিসির আলি বললেন, আপনি নিজের ছায়া দেয়ালে দেখেছেন। ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দিন। ঐ রাতের মতো বিছানা থেকে নামুন। বাথরুমে যান। নিজের ছায়া দেখবেন।

আমি তাই করলাম। নিজের কোনো ছায়া দেখলাম না।

মিসির আলি মোটেই বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, ঐ রাতে নিশ্চয়ই আপনার TV খোলা ছিল। TV স্ক্রিন থেকে আসা আলোয় আপনার ছায়া পড়েছে। টিভি ছাড়ন।

আমি টিভি ছাড়তেই দেয়ালে নিজের ছায়া দেখলাম।

মিসির আলি বললেন, হেঁটে বাথরুম পর্যন্ত যান। ছায়াকে হেঁটে যেতে দেখবেন।

আমি বললাম, এখন আর তার প্রয়োজন। দেখছি না।

মিসির আলি বললেন, ভয় কেটেছে? আমি হা-সূচক মাথা নাড়লাম।

মিসির আলি বললেন, এখন কি রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে পারবেন?

আমি বললাম, না।

মিসির আলি বললেন, বাতি জ্বালিয়েই ঘুমুবেন। সমস্যা কিছু নেই। ঘুমুবার জন্যে

অন্ধকার কোনো পূর্বশর্ত না। ভালো কথা, এ। বাড়িতে গেস্টম আছে না?

আমি বললাম, আছে।

মিসির আলি বললেন, আগামী কয়েকদিন যদি আমি আপনার গেস্টরুমে বাস করি তাহলে কি কোনো সমস্যা হবে?

কবে থেকে থাকা শুরু করবেন?

আজ থেকেই। আমি প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় সঙ্গে করে এনেছি। শুধু টুথপেস্ট আনা হয় নি। টুথব্রাশ এনেছি।

এতক্ষণ চোখে পড়ে নি এখন চোখে পড়ল, মিসির আলি ছোট্ট একটা চামড়ার সুটকেস এবং হাত ব্যাগ নিয়ে এসেছেন। কাজটা তিনি করেছেন শুধুমাত্র আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যে। আনন্দে আমার চোখে পানি আসার জোগাড় হলো।

মিসির আলি বললেন, আপনি অনেকদিন থেকে বলছিলেন আমার কোনো একটা রহস্যভেদ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান। এই মুহূর্তে আমি একটা রহস্য নিয়ে ভাবছি। আপনি চাইলে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন।

আমি আগ্রহের সঙ্গে বললাম, অবশ্যই যুক্ত থাকতে চাই।

দশ পৃষ্ঠার একটা চিঠি এখন আপনাকে দিচ্ছি। রসায়নের একজন অধ্যাপিকা চিঠিটা দিয়েছেন। আপনি মন দিয়ে চিঠিটা তিনবার পড়বেন। ইতোমধ্যে আমি আপনার গেস্টমে স্থায়ী হচ্ছি। ভালো কথা, আপনার এখানে কি চা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে?

ব্যবস্থা নেই।

রাতে ঘুম না এলে আমাকে চা খেতে হয়। টি ব্যাগ, চা-চিনির ব্যবস্থা করছি। রান্নার চুলা ঠিক আছে তো?

জানি না। মিসির আলি বললেন, আপনি চিঠি পড়ন, আমি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করি।

আমি চিঠি নিয়ে বসলাম। যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েই পড়তে শুরু করলাম। এক-দুই পৃষ্ঠা পড়ার পরই স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, রসায়নের এই অধ্যাপিকার বাংলা গদ্যের উপর ভালো দখল আছে। হাতের লেখাও গোটা গোটা। নির্ভুল বানান।

চিঠির মূল বক্তব্য সন্তানের মৃত্যু রহস্যের সমাধান। আমার কাছে সমাধান খুব কঠিন বলে মনে হলো না। সন্তানের মা সমাধান নিজেই করেছেন। সমাধানের স্পষ্ট ইঙ্গিতও চিঠিতে দেয়া। ভদ্রমহিলা তাঁর শাশুড়িকে দায়ী করেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। এই বৃদ্ধা হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্নে করার জন্যে বাড়ির সবাইকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। খুনি বৃদ্ধার মোটিভও পরিষ্কার। এই বৃদ্ধা তার ছেলেকে কাছে রাখতে চান। তিনি চান না ছেলে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকুক। ছেলেকে পাশে রাখার জন্যে যে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা তিনি করেছেন তা কাজ করেছে। ছেলে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে নি।

যে রহস্যের কথা চিঠিতে বলা হয়েছে সেই রহস্য সাদামাটা রহস্য। রহস্যভেদের জন্যে মিসির আলির মতো মানুষ লাগে না। আমার মতো গড়পড়তা মেধার যে-কোনো মানুষই এই রহস্যভেদ করবে।

অনেকদিন পর হোটেলের রান্নার বাইরে খাবার খেলাম। বাবুর্চি মিসির আলি সাহেব। চিকন চালের ভাত। আলু ভর্তা। ডিম ভাজি এবং ডাল। খেতে বসে মনে হলো, অনেকদিন এত ভালো খাওয়া হয় নি।

মিসির আলি বললেন, বাঙালি রান্না দুই রকম। ব্যাপক আয়োজনের রান্না এবং আয়োজনহীন রান্না। আপনাকে কিছু রান্না আমি শিখিয়ে দেব। নিজে রাঁধবেন। নিজের রান্না খাবেন। আলু ভর্তার জন্যে আলু আলাদা সিদ্ধ করতে হবে না। ভাতের সঙ্গে দিয়ে দেবেন। ডাল রান্নার মূল মন্ত্র হচ্ছে সিদ্ধ। যত সিদ্ধ হবে ডাল তত খেতে ভালো হবে। তবে তেলে বাগার দিতে হবে। সিদ্ধ হতে হতে ডাল যখন ‘কিলয়েড’ ফর্মে চলে যাবে তখন বাগার প্রক্রিয়া শুরু করবেন। বাগারের কারণে তেল ডালের কণার উপর আস্তরণ তৈরি করবে। বাগারের তেলে বাঙালি মেয়েরা পেঁয়াজ-রসুন ভেজে নেয়। আমি তার প্রয়োজন দেখি না। পেঁয়াজরসুন ছাড়া ডাল রাধে বিধবারা। সেই ডাল খেতে সুস্বাদু। ইলিশ মাছ খুব অল্প আঁচে সিদ্ধ। হয়, এটা কি জানেন?

জানি না।

মসলা মাখিয়ে ইলিশ মাছের টুকরো রোদে রেখে দিলেও সিদ্ধ হয়ে যায়। আপনাকে রোদে রাখতে হবে না। গরম ভাতের উপর রেখে ঢাকনা দিয়ে রাখলেই হবে।

মসলা কী?

মসলা হচ্ছে লবণ। আর কিছু না। বাঙালি মেয়েরা ভাপা ইলিশে নানান মসলা দেয়। মসলা মাছের স্বাদ নষ্ট করে। কোনো রকম মসলা ছাড়া ভাপা ইলিশ একবার খেলেই আপনার আর মসলা খেতে ইচ্ছা করবে না।

আমি ঘোষণা করলাম, আগামীকাল রাতের সব রান্না আমি করব। মেন ইলিশ মাছ, ডাল, আলু ভর্তা। ভালো ঘিও কিনে আনব। গরম ভাতের উপর এক চামচ ঘি ছেড়ে দেয়া হবে। ভাতের গন্ধের সঙ্গে ঘিয়ের গন্ধ মিশে অমৃতসম কিছু তৈরি হবার কথা। ভেবেই আনন্দ পাচ্ছি এবং এক ধরনের উত্তেজনাও বোধ করছি। দুপুরে বাজার করতে হবে। একটা ফ্রিজ কেনা দরকার।

মিসির আলি হঠাৎ বললেন, ব্যাচেলর জীবনে কিছু আনন্দ আছে, তাই না?

আমি ধাক্কার মতো খেলাম। আমার মনে হলো, রান্নাবান্নার এই বিষয়টি মিসির আলি ইচ্ছা করে আমার ভেতর ঢুকিয়েছেন যেন আমি ব্যস্ত থাকতে পারি।

রাতের খাওয়া শেষে দু’জন বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছি। দক্ষিণমুখী বারান্দা। ভালো হাওয়া দিচ্ছে। দু’জনের হাতেই সিগারেট। মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান। দিয়ে বললেন, আজকাল সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে ‘ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’। পড়েছেন?

আমি বললাম, পড়েছি। মিসির আলি বললেন, আমার নিজের ধারণা সিগারেটের প্যাকেটে এই সতর্কবাণী দেয়ার পর থেকে সিগারেটের বিক্রি অনেক বেড়েছে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?

মিসির আলি হাই তুলতে তুলতে বললেন, মানুষের মৃত্যু বিষয়ে আছে প্রচণ্ড ভীতি। সে মৃত্যু কী জানতে আগ্রহী। এই আগ্রহের কারণে অবচেতনভাবে মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি যেতে চায়। সিগারেট সেই কাছাকাছি থাকার সহজ উপায়।

আমি বললাম, যুক্তি খারাপ না।

মিসির আলি আগ্রহের সঙ্গে বললেন, যারা ছাদে বেড়াতে চায় তাদেরকে দেখবেন এক সময় ছাদের রেলিং-এ বসেছে। অতি বিপদজনক জেনেও এই কাজটা করছে। মূল কারণ একটাই, মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়া। মানুষ অতি বিচিত্র প্রাণী। ভালো কথা, আপনি কি আমার কন্যার চিঠিটা পড়েছেন?

তিনবার পড়তে বলেছিলেন, আমি দু’বার পড়েছি।

মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে বললেন, চিঠি পড়ে কি কোনো খটকা লেগেছে?

আমি বললাম, হুট করে আপনাকে বাবা ডাকাটায় সামান্য খটকা লেগেছে। ‘বাবা’ ডাক ছাড়া চিঠিতে খটকা নেই। চিঠির রহস্য আপনার মতো মানুষের পক্ষে মুহূর্তেই বের করার কথা।

মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, রহস্য বের করেছি। একটা কাগজে লিখে খামে বন্ধ করে রেখেছি। খামটা আপনি রাখবেন, তবে খুলে এখনো পড়বেন না।

কখন পড়ব?

আপনি নিজে যখন রহস্যভেদ করবেন। তখন পড়বেন।

আমি রহস্যভেদ করব?

হা আপনি করবেন। আমি আপনাকে সাহায্য করব। আপনি একা বাস করছেন, রহস্য নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত থাকবেন। মানব মনের গতি প্রকৃতি জানবেন। আপনি লেখক মানুষ, এতে আপনার লাভই হবে।

আমি বললাম, সাগর নামের বাচ্চাটা তার দাদির হাতে খুন হয়েছে এটা তো বোঝা যাচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, চট করে সিদ্ধান্তে যাবেন না। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ অসুস্থ না হলে কেউ এই কাজ করতে পারে না। চিঠি পড়ে কি মনে হয়, ছেলেটির দাদি মানসিকভাবে অসুস্থ?

তা মনে হয় না। তাহলে কি ছেলেটির বাবা মানসিক রোগী? চিঠিতে সে রকম আছে। হারুন নামের ডাক্তার তার মা’কে দেখে এইসব।

মিসির আলি বললেন, এক কাজ করলে কেমন হয়? ডাক্তার ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করুন। তাঁকে চোখ দেখাতে যান। আপনি লেখক মানুষ। উনি আপনাকে চিনতে পারবেন। আমার ধারণা, উনি মন খুলে আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। রাত অনেক। হয়েছে, চলুন ঘুমুতে যাওয়া যাক।

খামটা দিন।

মিসির আলি পাঞ্জাবির পকেট থেকে খাম বের করে দিলেন। তিনি খাম পকেটে নিয়েই গল্প করতে এসেছিলেন।

ডা. হারুনের কাছে মিসির আলি আমাকে নিয়ে গেলেন। এমনিতেই তাঁর চোখ দেখাবার কথা। সঙ্গে আমিও দেখাব।

ভদ্রলোকের আচারআচরণ লক্ষ করব। তেমন সুযোগ হলে কিছু প্রশ্নও করব। তবে প্রশ্নের প্রয়োজন নেই। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একজন মানুষকে দেখলেই চেনা যাবে। তাদের চোখে থাকবে ভরসা হারানো দৃষ্টি।

আমি ডাক্তার সাহেবকে দেখে হতাশই হলাম। সম্পূর্ণ সহজ-স্বাভাবিক একজন মানুষ। হাসিখুশি। তার টেবিলে বরফ মেশানো হলুদ রঙের পানীয়। রঙ দেখে মনে হচ্ছে হুইস্কি। যদি হুইস্কি হয় তাহলে ব্যাপারটা অবশ্যই অস্বাভাবিক।

কোনো ডাক্তারই হুইস্কি খেতে খেতে রোগী দেখতে পারেন না। আমি গ্লাসের। দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, কী খাচ্ছেন?

ডা. হারুন আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বললেন, হুইস্কি খাচ্ছি। আপনি খাবেন?

আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম।

খেয়ে দেখতে পারেন। খারাপ লাগবে না। দিনের শেষে ক্লান্তি নিবারক।

আমি বললাম, আপনি ক্লান্তি নিবারণ করুন। আমি তেমন ক্লান্তি বোধ করছি না।

ডাক্তার গ্লাসে চুমুক দিয়ে আমার চোখ দেখতে বসলেন। যত্ন করেই চোখ দেখলেন। বিল দিতে গেলাম। তিনি বললেন, মিসির আলি সাহেব আমার বন্ধু মানুষ। আপনাকে বিল দিতে হবে না।

আমি বললাম, আপনি কি বন্ধুর বন্ধুদের কাছ থেকে বিল নেন না?

না।

তাহলে তো একসময় দেখা যাবে, কারো। কাছ থেকেই আপনি বিল নিতে পারছেন না। সবাই ফ্রি।

আমি এমন কোনো হাসির কথা বলি নি। কিন্তু ভদ্রলোক মনে হলো খুব মজা পেলেন। এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে অনেকক্ষণ হাসলেন। অ্যালকোহলের অ্যাফেক্টও হতে পারে। তিনি ফ্ল্যাস্ক থেকে ঐ বস্তু আরো খানিকটা ঢালতে ঢালতে বললেন, আমি টিটাটোলার মদ সিগারেট কিছুই খাই না। গ্লাসে যে বস্তু দেখছেন তা হলো তেঁতুলের পানি। তেঁতুলের পানি Arteriosclerosis কমায়। আমি যা করছি তা হলো দেশীয় ভেষজের মাধ্যমে চিকিৎসা।

আমি বললাম, আপনি তেঁতুলের পানি খাচ্ছেন, আমাকে কেন বললেন হুইস্কি খাচ্ছি!

হারুন সাহেব বললেন, আপনি ভ্রূ কুঁচকে গ্লাসটার দিকে তাকাচ্ছিলেন। এই জন্যেই বলেছি। আপনার আগেও কয়েকজন রোগী আপনার মতোই ভ্ৰ কুঁচকে গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলেছে, কী খাচ্ছেন? আমি তাদেরকেও বলেছি, হুইস্কি খাচ্ছি।

তাদের ভুল ভাঙান নি?

না। শুধু আপনারটাই ভাঙিয়েছি।

আমার ভুল ভাঙালেন কেন?

ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আপনি বন্ধু মানুষ। বেহেশতে আমরা কিন্তু আত্মীয়স্বজন পুত্রকন্যা পাব না। বন্ধু পাব। আমাদেরকে দেয়া হবে সতুরজন হুর। এরা। সবাই বন্ধু। পবিত্র সঙ্গী। কেউ আত্মীয় না।

আপনি কি বেহেশত দোজখ এইসব বিশ্বাস করেন?

অবশ্যই করি। নামাজ পড়েন?

সময়মতো পড়া হয় না, তবে রাতে ঘুমুবার আগে কাজা পড়ি।

বেহেশতে যাবার জন্যে পড়েন?

ডাক্তার বেশকিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, বেহেশত দেখার প্রতি আমার আগ্রহ আছে। সেখানে যেসব পবিত্র সঙ্গিনী আছে, তাদের একজনকে আমি দেখেছি।

স্বপ্নে দেখেছেন?

স্বপ্নে না, ঘোরের মধ্যে দেখেছি। সেই গল্প অন্য একদিন বলব।

আমরা চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছি হঠাৎ ডাক্তার মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার মা আমাকে জানিয়েছেন, আপনি এখন নিজের বাসায় থাকেন না। অন্য এক জায়গায় থাকেন। আপনি যে ঘরে থাকেন, সেখানে দেয়াল ঘড়ি আছে। ঘড়িটা বন্ধ। ঘড়িতে সবসময় তিনটা বেজে থাকে। আমার মা কি ঠিক বলছেন?

মিসির আলি চিন্তিত গলায় বললেন, হ্যাঁ।

এখন কি বিশ্বাস করছেন, আমার মা’র সঙ্গে আমার কথা হয়? দেখা হয়?

মিসির আলি বললেন, না। কখন বিশ্বাস হবে? যখন তাঁকে নিজে দেখব।

ডাক্তারের ঠোঁটের কোনায় হালকা হাসির। | আভাস দেখা গেল। যেন তিনি মজার কোনো কথা বলবেন বলে ভাবছেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।

মিসির আলি বললেন, আজ উঠি?

ডাক্তার বললেন, আরো কিছুক্ষণ বসুন, গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দেব। একটা প্রশ্নের জবাব

দিন, আপনি কি ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন বিশ্বাস করেন?

মিসির আলি বললেন, করি।

ডাক্তার বললেন, এদের তো আপনি চোখে দেখেন নি, তাহলে কেন বিশ্বাস করেন?

মিসির আলি বললেন, আমি চোখে না দেখলেও নানান যন্ত্রপাতি এদের অস্তিত্ব বের করেছে। একটি যন্ত্রের নাম সাইক্লন্ট্রন। পৃথিবীর কোনো যন্ত্রপাতি মৃত মানুষের অস্তিত্ব বের করতে পারে না।

ডাক্তার বললেন, সে রকম যন্ত্রপাতি তৈরি হয় নি বলেই পারে না। আমার পড়াশোনা যদি পদার্থবিদ্যায় হতো আমি নিজেই এরকম একটা যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করতাম। যন্ত্রটার নাম দিতাম Soul searcher. যে যন্ত্র আত্মা অনুসন্ধান করে বেড়াবে। মনে করা যাক এই ঘরে একটা আত্মা আছে, যন্ত্রের কাজ হবে ঘরের প্রতিটি স্কয়ার ইঞ্চের রেডিও অ্যাকটিভিটি মাপবে, তাপ মাপবে, ইলেট্রিক্যাল চার্জ মাপবে, ম্যাগনেটিক বলরেখার ম্যাপ তৈরি করবে। সমস্ত ডাটা কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হবে। সফটওয়্যারের কাজ হবে anamoly detect করা।

ডাক্তার সাহেব প্রবল উৎসাহে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। যেন তিনি ক্লাস নিচ্ছেন, আমরা দুই মনোযোগী শ্রোতা। তাঁর ঘরে বোর্ড না থাকায় সামান্য সমস্যা হচ্ছে। যন্ত্রের খুঁটিনাটি বোর্ডে একে দেখাতে পারছেন না। কাগজ-কলমে একে দেখাতে হচ্ছে।

আমরা রাত সাড়ে এগারোটায় ছাড়া পেলাম। ডাক্তার সাহেব নিজেই পৌঁছে। দিলেন। তবে গাড়িতেও তিনি বকবক করতেই থাকলেন, এক মুহূর্তের জন্যেও থামলেন না।

প্রথম যেটা তৈরি করতে হবে তা হলো ম্যাগনেটিক টানেল, কিংবা Magnetic Cone তৈরি করা। আত্মাকে যদি কোনোক্রমে ভুলিয়ে ভালিয়ে টানেলে ঢুকিয়ে ফেলা যায় তাহলেই কর্ম কাবার।

আমি বোকা বোকা মুখ করে বললাম, কর্ম কাবার মানে কী? আত্মা মারা যাবে? মানুষ মরে আত্মা হয়, আত্মা মরে কী হবে?

ভেবেছিলাম আমার রসিকতায় তিনি রাগ করবেন। ভাগ্য ভালো, রাগ করলেন না। তিনি বুঝাতে চেষ্টা করলেন আত্মা কী?

‘আত্মা হলো পিওর ফরম অব এনার্জি। আমরা যেসব এনার্জির সঙ্গে পরিচিত তার বাইরের এনার্জি। আমাদের এনার্জির ট্রান্সফরমেশন হয়। এক ফরম থেকে অন্য ফরমে যেতে পারে। আত্মা নামক এনার্জির কোনো ট্রান্সফরমেশন নেই। বুঝতে পারছেন তো?’

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, তারপরেও প্রবল বেগে হা-সূচক মাথা নাড়লাম।

রাতে মিসির আলি সাহেবকে নিয়ে খেতে বসেছি। আয়োজন সামান্য। দুপুরের ডাল গরম করা হয়েছে। ডিম ভাজা হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে ডাল টকে গেছে। মিসির আলি সাহেব ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। টক ডাল খেয়ে যাচ্ছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি আছেন। গভীর চিন্তায়। আমি বললাম, মিসির আলি সাহেব, আপনি কি আত্মা বিশ্বাস করেন?

তিনি আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, হা।

খুব যে ভেবেচিন্তে তিনি হা বললেন তা কিন্তু মনে হলো না। বলতে হয় বলে বলা। আত্মা-বিষয়ক দ্বিতীয় প্রশ্ন করতে যাচ্ছি তার আগেই মিসির আলি বললেন, ডাক্তার সাহেব গাড়ি করে আপনার বাসায় আমাদের পৌছে। দিয়েছেন, ব্যাপারটা আপনার কেমন লেগেছে?

আমি বললাম, ভালো লেগেছে। ভদ্ৰলোক নিতান্তই ভালো মানুষ। ভালো মানুষরা পাগলাটে হয়, উনিও পাগলাটে।

মিসির আলি বললেন, উনার গাড়ির ড্রাইভার কিন্তু আপনার বাড়ির ঠিকানা জানতে চায় নি। সে ঠিকানা জানতো। আগে এসেছে। ঠিক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমি বললাম, তাই তো!

মিসির আলি বললেন, ডাক্তার সাহেব আপনাকে চেনেন না। আজই প্রথম চিনলেন। উনি আপনার বাড়ি চেনেন, কারণ উনি আমাকে অনুসরণ করছেন। আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছেন।

আপনার পেছনে লোক লাগিয়ে রাখবে কেন?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

আমি বললাম, ঘড়ির ব্যাপারটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উনি যে বলে দিলেন আপনার ঘরের ঘড়িটা বন্ধ। তিনটা বেজে আছে।

সির আলি বললেন, এটা তুচ্ছ বিষয়। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করার কিছু নেই।

আমি বললাম, তুচ্ছ বলছেন কেন? ঘড়িটা তো বাইরে থেকে দেখা যায় না। এই ঘড়ি দেখতে হলে ঘরে ঢুকতে হবে। হবে না?

মিসির আলি আমার কথায় গুরুত্ব দিলেন। না। বরং মনে হলো কিছুটা বিরক্তই হলেন। আমাকে হতাশ গলায় বললেন, শরীরটা খারাপ লাগছে। ডালটা কি নষ্ট ছিল?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

মিসির আলি বললেন, আমার কাছে টকটক অবশ্যি লাগছিল। আমি ভাবলাম কাঁচা আম দিয়ে ডাল টক করা হয়েছে।

এই সিজনে কাঁচা আম পাবেন কোথায়? মিসির আলি বললেন, তাও তো কথা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর ভেদবমি শুরু হলো। চোখ-মুখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। সামান্য টক ডাল এই অবস্থা তৈরি করতে পারে তা আমার ধারণাতেও ছিল না।

বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার মনে হয় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। টেলিফোন করা মাত্র অ্যাম্বুলেন্স চলে এলো। তাঁকে ক্লিনিকে ভর্তি করলাম। তাঁর জ্ঞান ফিরল ভোর রাতে। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম যে বাক্যটি বললেন তা হলো আগামী দুই বছর আমি ডাল বা ডালজাতীয় কিছু খাব না।

COMMENTS

Name

Andrew-Kishore,1,অগ্নিপুরুষ,10,অনীশ,2,অন্য-ভুবন,3,আজ-হিমুর-বিয়ে,3,আবু-ইসহাক,1,আমি-এবং-আমরা,3,আমিই-মিসির-আলি,3,উপন্যাস,15,উপেন্দ্রকিশোর-রায়চৌধুরী,2,একজন-হিমু-কয়েকটি-ঝিঁঝিঁ-পোকা,5,এবং-হিমু,5,কবিতা,2,কহেন-কবি-কালিদাস,2,কাজী-আনোয়ার-হোসেন,18,কাজী-নজরুল-ইসলাম,2,গজল,1,গল্প,3,গানের-লিরিক,9,চলে-যায়-বসন্তের-দিন,3,চোখ,1,ছোট-গল্প,35,ছোটদের-গল্প,17,জলের-গান,1,জেমস,2,তন্দ্রাবিলাস,3,তোমাদের-এই-নগরে,4,দক্ষিণারঞ্জন-মিত্র-মজুমদার,1,দরজার-ওপাশে,4,দেবী,7,দেশাত্ববোধক-কবিতা,1,দেশাত্ববোধক-গান,2,নিশীথিনী,4,নিষাদ,3,পঞ্চতন্ত্র,1,পাগলা-দাশু,4,পারাপার,4,পুফি,3,বইয়ের-তালিকা,1,বাঘবন্দি,3,বিখ্যাত-গান,3,বিপদ,2,বৃহন্নলা,2,ভয়,5,মজার-গল্প,23,ময়ূরাক্ষী,4,ময়ূরাক্ষীর-তীরে-প্রথম-হিমু,1,মাসুদ-রানা,18,মিসির-আলি-UNSOLVED,4,মিসির-আলি-আপনি-কোথায়,3,মিসির-আলি-সমগ্র,55,মিসির-আলির-অমিমাংসিত-রহস্য,3,মিসির-আলির-চশমা,3,মুহম্মদ-জাফর-ইকবাল,1,মোশতাক-আহমেদ,1,মোহাম্মাদ-জসীম-উদ্দীন-মোল্লা,2,যখন-নামিবে-আঁধার,2,রবীন্দ্রনাথ-ঠাকুর,3,রম্যগল্প,4,রাধারানী-দেবী,1,রুপকথার-গল্প,4,শরৎচন্দ্র-চট্টোপাধ্যায়,2,শেখ-আবদুল-হাকীম,8,শ্রী-ক্ষিতীশচন্দ্র-কুশারী,1,সায়েন্স-ফিকশন,1,সুকুমার-রায়,7,সে-আসে-ধীরে,4,সেবা-প্রকাশনী,4,সৈয়দ-মুজতবা-আলী,1,স্বর্ণদ্বীপ,7,হরতন-ইশকাপন,2,হলুদ-হিমু-কালো-RAB,6,হাসির-গল্প,23,হিমু-এবং-একটি-রাশিয়ান-পরী,3,হিমু-এবং-হার্ভার্ড-PhD-বল্টু-ভাই,7,হিমু-মামা,6,হিমু-রিমান্ডে,9,হিমু-সমগ্র,80,হিমুর-দ্বিতীয়-প্রহর,3,হিমুর-বাবার-কথামালা,8,হুমায়ূন-আহমেদ,135,
ltr
item
গল্প এর বই: মিসির আলির চশমা || ২য় পর্ব || মিসির আলি সিরিজ অনলাইন || হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলির চশমা || ২য় পর্ব || মিসির আলি সিরিজ অনলাইন || হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি কুরিয়ারে একটা দীর্ঘ চিঠি পেয়েছেন। চিঠির প্রেরকের নাম শায়লা রশিদ। পুনশ্চতে লেখা— ড. হারুন রশিদ নামে যে চোখের ডাক্তার আপনার চিকিত্সা করছেন। আম
গল্প এর বই
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/06/misir-alir-coshma-2nd-porbo-misirali-series-humayun-ahmed.html
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/06/misir-alir-coshma-2nd-porbo-misirali-series-humayun-ahmed.html
true
2280349116972597382
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content