ফন গোলডার যে-কটা তালা আছে রানার আছে ঠিক সে-কটা চাবি। মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের চেয়ারম্যান, ফিল্ম প্রোডিউসার, সেই সঙ্গে একটা শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের লিডার
অষ্টম এবং শেষ পর্ব
মাসুদ রানা সিরিজ থেকে
স্বর্ণদ্বীপ (অখণ্ড) - শেখ আবদুল হাকীম
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৯৫
স্বর্ণদ্বীপ || মাসুদ রানা || সতেরো
.
ফন গোলডার যে-কটা তালা আছে রানার আছে ঠিক সে-কটা চাবি। মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের চেয়ারম্যান, ফিল্ম প্রোডিউসার, সেই সঙ্গে একটা শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের লিডার হিসেবে ব্যক্তিগত অনেক জিনিসই নিয়ে এসেছেন তিনি। কাপড়চোপড়ের কথাই ধরা যাক, সংখ্যায় সেগুলো অগুণতি। শুধু সুটই দেখা গেল বারোটা, যদিও বেয়ার আইল্যাণ্ডে এগুলো তার কি কাজে আসবে বলা কঠিন। দুটো বাদামি রঙের সুটকেস পাওয়া গেল। আসলে এক জোড়া ধাতব উড-বক্স আড়াল করা হয়েছে ওগুলোর ভেতর।
দুটোই খুলল রানা। প্রথমটায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়া গেল না। প্রচুর পেপার কাটিং দেখল ও, বিশ-পঁচিশ বছরের পুরানো। সে-সব খবর থেকে জানা যায়, সিনেমা জগতে ফন গোলডা একটা দুর্লভ প্রতিভা। দ্বিতীয় উড-বক্সে পাওয়া গেল টাকা-পয়সার হিসাব। কত আয় করেছেন তিনি, কত খরচ করেছেন, এই সব। এগুলোও আগ্রহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলো। তারপর দেখতে পেল কয়েকটা বাতিল করা চেক-বই। যেহেতু বাতিল, আর্কটিকে ফন গোলডার কোন কাজেও আসবে না, তাই নিঃসঙ্কোচে পকেটে ভরল ও। সব আবার আগের মত সাজিয়ে রেখে বেরিয়ে এল তার কিউবিকল থেকে। এরপর ঢুকল ক্লার্ক বিশপের কিউবিকলে।
কোম্পানীর অ্যাকাউন্ট্যান্ট ভদ্রলোক। স্বভাবতই তিনিও তাঁর জিনিসপত্র তালার ভেতর রাখবেন। তবে পরিমাণে কম বলে সার্চ করতে সময়ও লাগল কম। টাকা-পয়সা সংক্রান্ত ব্যাপারেই আগ্রহী রানা, তিনটে আইটেম দেখে কৌতূহল হওয়ায় সেগুলোও পকেটে ভরল পরে ভাল করে পরীক্ষা করার জন্যে। আইটেম তিনটে হলো–মার্ভেলাস প্রোডাকশন্স-এর বেতনের তালিকা, ক্লার্ক বিশপের ব্যক্তিগত ব্যাংক-বুক আর একটা ডায়েরী। ডায়েরীর পাতায় সাঙ্কেতিক সংখ্যা লেখা রয়েছে, তবে বোঝা যায় টাকা-পয়সারই হিসাব।
বাকি আধ ঘণ্টায় আরও চারটে কিউবিকলে হানা দিল রানা। জানত, কার্লসনের কিউবিকলে কিছুই পাওয়া যাবে না, পেলও না। তার যে ইতিহাস আর অভিজ্ঞতা, খুব ভাল করেই জানেন যে রেকর্ড ফাঁইল করার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো নিজের মাথা। তবে তার কিউবিকলে বেয়ার আইল্যাণ্ডের কয়েকটা লার্জ-স্কেল চার্ট পাওয়া গেল। একটা নিল ও।
রবার্ট হ্যামারহেডের ব্যক্তিগত কাগজ-পত্রের মধ্যে না মেটানো বিলই বেশি। ব্যাংকের তাগাদা-পত্রও রয়েছে। কাউন্টের কিউবিকলে একটা লোড করা অটোমেটিক পাওয়া গেল, পাশেই এনভেলাপে ভরা লাইসেন্স। ফার্গুসন আর ব্রাখটম্যান একই কিউবিকলে থাকে, সেখানে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তবে ফাসনের সুটকেসে ছোট একটা প্যাকেট দেখে অস্বস্তিবোধ করল রানা। প্যাকেটটা সীল করা। সেটা নিয়ে মেইন কেবিনে ফিরে এল ও। এক জানালা থেকে আরেক জানালা পর্যন্ত হাটাহাটি করছে এলিনা। মোট চারটে জানালা, সবগুলোর ওপর নজর রাখছে সে।
ফিরছে না কেউ? জিজ্ঞেস করল রানা। মাথা নাড়ল এলিনা। স্টোভে একটা কেটলি বসাও।
কফি আছে। কিছু খাবারও আছে।
কফি বা খাবার দরকার নেই। গরম পানি দরকার আমার। প্যাকেটটা এলিনার হাতে ধরিয়ে দিল রানা। গরম বাপ লাগিয়ে সীলটা খোলো।
বাষ্প…কি এটা?
জানলে তোমাকে খুলতে বলতাম না।
জক মুরের কিউবিকলে চলে এল রানা। কিন্তু এখানে তাঁর স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নেই-একটা পারিবারিক অ্যালবাম, পুরানো অস্পষ্ট ফটোয় ঠাসা। দুএকটা বাদ দিলে, সব ফটোই সম্ভবত জক মুরের নিজের তোলা। প্রথম কয়েকটা ফটোয় সুন্দরী এক তরুণীকে দেখা গেল, কোলে যমজ কন্যা সন্তান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জক মুরের স্ত্রীর চুল কাটা ও বাঁধার ধরন পাল্টে গেছে। বয়েস বাড়ার পর বদলে গেছে তাদের যমজ কন্যাদের চেহারা ও পোশাক-আশাক। আরও পরে তাদের চেহারার সঙ্গে মায়ের চেহারার মিল দেখা গেল। শেষ দিকের ফুটোয় মেয়ে দুটোর বয়েস হবে আঠারো। অ্যালবাম বন্ধ করে চোখ বুজল রানা, দুঃখী একজন মানুষের ব্যক্তিগত স্বপ্নের ভেতর উঁকি দেয়ায় সামান্য হলেও অপরাধ বোধ করছে।
এডির কিউবিকলে ঢুকতে যাবে রানা, ওর সামনে এসে দাঁড়াল এলিনা। প্যাকেটটা খুলেছে সে, ভেতরের জিনিস বের করে একটা রুমালে রেখেছে। পাঁচ হাজার পাউণ্ড, বলল সে। দশ পাউণ্ডের নোট, সব নতুন।
পাঁচ হাজার পাউণ্ড অনেক টাকা। ওগুলো শুধু নতুন নয়, সিরিয়াল। নম্বরগুলোও পাশাপাশি। প্রথম ও শেষ নম্বরটা লিখে নিল রানা, খোঁজ নিতে সুবিধে হবে। আবার প্যাকেটে ভরা হলো সব, সীল করা হলো সেটা, তারপর আগের জায়গায় রেখে আসা হলো।
এডি আর ব্রায়ানের কিউবিকলে কিছু পাওয়া গেল না। তবে মরগানের। কিউবিকলে অনেকগুলো স্কচের বোতল পাওয়া গেল, সন্দেহ নেই ফন গোলডার স্টক থেকে সরানো হয়েছে। তিন দেবতার কেবিনে রানা ঢুকল না, জানে ওখানে কিছু পাওয়া যাবে না। ঢুকল না হিউমের কিউবিকলেও।
বেলা তিনটে, আকাশ থেকে আলো মুছে যাচ্ছে। ফন গোলডাকে খবর দিয়ে। ইতিমধ্যে ফিরে আসার কথা দলটার, কিন্তু ফিরছে না তারা। মেইন কেবিনে জোর করে রানাকে খাওয়াতে বসাল এলিনা। শুধু খানিকটা স্টেক আর কফি খেলো ও। ওরা ফিরছে না দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করল এলিনা। চিন্তার কিছু নেই, সময় হলে। ফিরবে, বলে নিজের কিউবিকলে চলে এল রানা।
কটে শুয়ে বিভিন্ন কিউবিকল থেকে সংগ্রহ করা আইটেমগুলোর ওপর চোখ বুলাল ও। কোনটার কি গুরুত্ব, বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। স্যালারি বুকে নির্দেশগুলো দেয়া হয়েছে স্পষ্টভাবে। ফন গোলডার চেক-বই আর ক্লার্ক বিশপের ব্যাংক-বই, এ-দুটোর মধ্যে করেসপণ্ডেন্স অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো রানার। তবে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল জাগাল লার্জ-স্কেল চার্টটা। সোর-হামনার পাশের বে ইভজেবুতা-র বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে এতে। পাহাড়ের মাথা থেকে এই বে-ই আজ দেখে এসেছে রানা। ফাঁক বা প্রবেশপথটার কথা মনে পড়ল ওর। তারপর অনেকক্ষণ ধরে এলিনার মা-বাবার কথা ভাবল। এক সময় ওর কিউবিকলে এসে ঢুকল এলিনা।
ওঁরা আসছেন।
কে, কারা?
জানি না। অন্ধকার খুব বেশি, তুষারও পড়ছে।
কোনদিক থেকে আসছে?
ওদিক থেকে। দক্ষিণ দিকটা দেখাল এলিনা।
ব্রায়ান আর তিন দেবতা। কাগজগুলো ছোট একটা তোয়ালেতে জড়িয়ে এলিনার হাতে ধরিয়ে দিল রানা। এগুলো তোমার কামরায় লুকিয়ে রাখো। মেডিকেল ব্যাগটা দুমড়ে-মুচড়ে উল্টো করল ও, পকেট থেকে ছোট একটা স্কু ড্রাইভার বের করে ব্যাগটার খুদে চারটে পায়া খুলে ফেলল। ব্যাগটার তলা থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এল কালো একটা বাক্স। সেটাও ধরিয়ে দিল এলিনার হাতে। সাবধানে ধরো, খুব ভারি। এটাও লুকিয়ে রাখবে।
কিন্তু কি…?
জলদি! দরজায় ওদের আওয়াজ পাচ্ছি!
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল এলিনা। ব্যাগের পায়াগুলো আবার জায়গামত লাগিয়ে রাখল রানা। মেইন কেবিনে ফিরে দেখল ব্রায়ান আর তিন দেবতা স্টোভ থেকে নিয়ে গরম কফি খাচ্ছে। ফিরে আসতে পারায় সবাই তারা খুশি। কিন্তু রানার মুখে মোনাকার মৃত্যু সংবাদ শুনে হাঁ হয়ে গেল সবাই। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি কেউ, এই সময় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন ফন গোলডা। উদ্বেগে ব্যাকুল হয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। কোথায় ও? কোথায় আমার মেয়ে?
তাঁর পথ আটকাল রানা। শুনুন, মি. গোলডা, শুনুন। শান্ত হোন, প্লীজ। জানি সাংঘাতিক আঘাত পেয়েছেন…।
কোথায় ও? কোথায় আমার মেয়ে? কর্কশ গলায় আবার জিজ্ঞেস করলেন ফন গোলডা। হাউ ইন গডস নেম…?
তাঁকে তাঁর কিউবিকলেই রাখা হয়েছে, বলল রানা। দ্রুতপায়ে সেদিকে ছুটলেন ফন গোলডা, আবার তার পথ রোধ করে দাঁড়াল রানা। একটু পর যান, মি. গোলডা। প্রথমে আমি একবার দেখব… বুঝতেই পারছেন।
কাঁচা-পাকা ভুরুর ভেতর দিয়ে রানার দিকে এক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকলেন। ফন গোলডা, ধৈর্য হারিয়ে মাথা ঝাঁকালেন দ্রুত। তাড়াতাড়ি করবেন, প্লীজ।
মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। এলিনার দিকে তাকাল রানা। মি. গোলডাকে খানিকটা স্কচ দাও।
মোনাকার কিউবিকলে ঢুকে কাজটা সারতে মাত্র দশ সেকেণ্ড লাগল ওর। জিন আর বারবিচুরিটের বোতল কাপড়ে মুড়ে রাখা হয়েছে কেন, প্রশ্ন করতে পারেন ফন গোলডা; সে সুযোগ তাকে দিতে চায় না ও। সেগুলো বের করে রেখে। দিল চোখের সামনে। তারপর ডাকল ফন গোলডাকে।
ভেতরে ঢুকতেই তার একটা বাহু ধরল রানা, লাশের খুব একটা কাছে যেতে দিল না। দেখে আর কি করবেন, চলুন বাইরে যাই।
প্যাসেজে বেরিয়ে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সুইসাইড, অবশ্যই?
কোন সন্দেহ নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফন গোলডা। গড, নিজেকে আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না…।
আপনার অপরাধ বোধ করার কোন কারণ নেই, মি. গোলডা। দেখেছেনই তো, স্বামী মারা যাওয়ায় কি রকম ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। প্রবল শোক, মি. গোলডা। কারও সাহায্য করার থাকে না।
এরকম সময়ে আপনার মত সদয় লোক পাশে থাকলে মনে বড় শান্তি পাই, বিড়বিড় করলেন ফন গোলডা।
মেইন কেবিনে ফিরে এসে তার হাতে স্কচের গ্লাসটা ধরিয়ে দিল রানা। বাকি সবাই কোথায়? জিজ্ঞেস করল ও।
আসছে। ছুটতে ছুটতে ওদের আগে চলে এসেছি আমি।
ওরা তিনজন আপনাদেরকে খুঁজে বের করতে এত দেরি করল কেন বলুন তো?
শুটিঙের জন্যে দিনটা দারুণ। সবই ব্যাকগ্রাউণ্ডের কাজ, এক স্পট থেকে আরেক স্পটে সরে যাচ্ছিলাম আমরা। তারপর ঘাড়ে চাপল উদ্ধারের কাজটা। মাই গড, লোকেশন ইউনিট যদি এভাবে বাধার মুখে পড়ে…
উদ্ধারের কাজ? শিরশির করে উঠল রানার শরীর।
ব্রাখটম্যান। নিজের দোষে আহত হয়েছে। হাতের গ্লাস নামিয়ে এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন ফন গোলডা, যেন এত ভার তার আর সহ্য হচ্ছে না। মি. ওয়েন আর ব্রাটম্যান ঢাল বেয়ে উঠছিল, এই সময় পড়ে যায় সে। গোড়ালি মচকে গেছে, কিংবা হয়তো ভেঙে গেছে, ঠিক বলতে পারব না। আমরা যে লারনারস ওয়ের দিকে যাচ্ছি, ওরা দেখতে পায়। মোটামুটি ওদের দিকেই এগোচ্ছিলাম আমরা, যদিও আমাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে ছিল ওরা। মনে হলো। মি. ওয়েনকে একা এগিয়ে যেতে রাজি করিয়ে ফেলে ব্রখটম্যান, তারপর আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। আবার মাথা নেড়ে গ্লাসটা তুলে নিলেন। ফন গোলডা।
বুঝলাম না, বলল রানা। এঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। ফিরে আসছে।
তার উচিত ছিল গলার আওয়াজ শুনতে পাবার মত কাছাকাছি যতক্ষণ না আসি আমরা ততক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকা, বললেন ফন গোলডা। কিন্তু সে অপেক্ষা করেনি, একার চেষ্টায় ওই পা নিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে চেষ্টা করে। তারপর আর কি, তাল সামলাতে না পেরে একটা নালায় পড়ে যায়। ঈশ্বরই জানে কতক্ষণ অচেতন হয়ে পড়ে ছিল, আমরা তার চিৎকার শুনতে পাই বিকেলে। ঢাল থেকে তাকে নামিয়ে আনতে যে কি কষ্ট হয়েছে আমাদের! বাইরে কি এ-ক্যাটের আওয়াজ হচ্ছে?
মাথা ঝাঁকাল রানা। তারপর ফন গোলডার পিছু নিয়ে দরজার দিকে এগোল। আর মি. ওয়েন? জিজ্ঞেস করল ও। তাঁকে আপনি দেখেননি?
মি. ওয়েন? সামান্য অবাক হয়ে রানার দিকে তাকালেন ফন গোলডা। না, প্রশ্নই ওঠে না। আপনাকে তো বললামই, একা চলে গেছেন তিনি।
ও, হ্যাঁ, বলল রানা। ভুলে গিয়েছিলাম।
দরজার কাছে পৌচেছে ওরা, বাইরে থেকে খুলে গেল সেটা। হিউম আর কাউন্ট ঢুকলেন ভেতরে, ওদের দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এল ব্ৰাখটম্যান। ক্লান্তিতে ঝুলে পড়েছে তার মাথা, মুখে ও কপালে আঁচড় আর কাটাকুটির দাগ। ধরাধরি করে একটা কাউচে বসানো হলো তাকে, ডান পায়ের বুটটা খুলে নিল রানা। গোড়ালি সত্যি ফুলে আছে, কয়েক জায়গায় চামড়া উঠে যাওয়ায় সামান্য রক্তও দেখা গেল। এলিনাকে পানি গরম করতে বলল রানা। ব্রাখটম্যানকে ব্র্যাণ্ডি খেতে দিয়ে হাসল ও, আশ্বাস দিয়ে বলল, ভয়ের কিছু নেই, নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ায় ধন্যবাদ দিন ভাগ্যকে।
.
বলে মনে করছেন না।
বাকি সবাইকে তো আর জিরো টেমপারেচারে বাইরে বেরুতে হবে না।
কি? তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রানার দিকে তাকালেন ফন গোলডা। কি বলছেন?
বলছি আর কয়েক মিনিটের মধ্যে ওরা যদি ফিরে না আসেন, চোদ্দ ফুটী বোটটা নিয়ে ওদেরকে আমি খুঁজতে যাব।
হোয়াট! এ সম্পূর্ণ অন্য ধরনের গলা, ফন গোলডার বলে চেনা মুশকিল। টুল ছেড়ে অতি কষ্টে দাঁড়ালেন তিনি। খুঁজতে যাবেন? ওদেরকে আপনি খুঁজতে যাবেন? পাগল হলেন, স্যার? এরকম দুর্যোগের রাতে, অন্ধকারে নিজের হাতও দেখতে পাবেন না। মাফ করবেন। না। ইতিমধ্যে অনেক লোক হারিয়েছি। আমি এর ঘোর বিরোধী।
ভেবে দেখেছেন, ওদের এঞ্জিন নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকতে পারে? অসহায়ভাবে। হয়তো ঘুরে মরছে, অথচ এখানে আমরা চুপচাপ বসে আছি।
এঞ্জিন নষ্ট হবার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ওগুলো নতুন এঞ্জিন, আসার আগে পরীক্ষাও করা হয়েছে। তাছাড়া, ফার্সন অত্যন্ত দক্ষ মেকানিক।
তবু আমি যাচ্ছি।
আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই বোটটা কোম্পানীর সম্পত্তি।
ওটা আমি নিয়ে গেলে কে আমাকে বাধা দেবে?
ফোঁৎ ফোঁৎ করে নাক ঝাড়লেন ফন গোলডা, তারপর বললেন, আপনি বুঝতে পারছেন…?
পারছি। ফন গোলডা ক্লান্ত করে তুলেছেন রানাকে। এই মাত্র আপনি আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন।
আপনি তাহলে আমাকেও বরখাস্ত করুন, বলল হিউম। সবাই ওরা তার দিকে তাকাল। আমিও ডক্টর রানার সঙ্গে যাচ্ছি।
হিউমের কাছ থেকে এটা আশা করতে পারে রানা, কাজেই বিস্মিত হলো না। দেখল হিউমের একটা বাহু ধরে আছে এলিনা, তাকিয়ে আছে তার দিকে, চোখে-মুখে হতাশা। এলিনা যদি ব্যর্থ হয়ে থাকে, ওর চেষ্টা না করাই ভাল, ভাবল রানা।
ডগলাস!ফন গোলডার গলায় কর্তত্বের ধার ও ভার সবটুকু বিদ্যমান। তোমাকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে তোমার সঙ্গে কোম্পানীর একটা চুক্তি আছে।
ছিড়ে ফেলে দিন ওটা, বলল হিউম।
চোখে অবিশ্বাস, কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকলেন ফন গোলডা, বন্ধ করলেন খোলা মুখ, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে থপথপ করে নিজের কিউবিকলের দিকে চলে গেলেন। তিনি কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই সবাই একযোগে কথা বলতে শুরু করল। এগিয়ে এসে কাউন্টের পাশে দাঁড়াল রানা। মনের সুখে স্কচ খাচ্ছেন ভদ্রলোক। আপনার যদি তৃতীয় সুইসাইডাল ভলানটিয়ার হবার ইচ্ছে থাকে…
মি. গোলডাকে কতদিন থেকে চেনেন আপনি?
কি বললেন? মুহূর্তের জন্যে হলেও, প্রশ্নটা বুঝতে পারেননি কাউন্ট।
মেইন কেবিনে ব্রাখটম্যান ছাড়াও ষোলোজন লোক বসে আছে। মোনাকা তার কিউবিকলে মরে পড়ে আছে, বোধহয় সে-কথা স্মরণ করেই কেউ তার কিউবিকলে যাচ্ছে না। দুজন, তিনজন করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে সবাই, কথা বলছে নিচু গলায়, কেউ কেউ নিঃশব্দে স্কচ খাচ্ছে, তবে মাঝে-মধ্যে আড়চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সবাই। ইতিমধ্যে তুষারপাত আরও বেড়েছে, ঘন হয়েছে অন্ধকার, কিন্তু কার্লসন, বিশপ আর ফার্গুসন এখনও ফেরেনি।
অদ্ভুত ব্যাপার, ফন গোলডা স্কচ খাচ্ছেন না, তার বদলে একটা চুরুট চিবাচ্ছেন তিনি। খানিক আগে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে রানার। ফন গোলডা আন্দাজ করেছেন, ওরা তিনজনই সম্ভবত ডুবে মরেছে। তার অনুমানের কারণ হিসেবে বলেছেন, তিনজনের কেউই বোট সামলাতে জানে না, এমন কি সাতারও জানে না।
সবাই এই মুহূর্তে চুপ করে আছে। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ফন গোলডা। যেন পরিবেশটাকে হালকা করার জন্যেই তিক্ত হাসি হেসে বললেন, কি ব্যাপার, ডক্টর, আপনার হাতে গ্লাস দেখছি না কেন?
না, বলল রানা। কাজটা ঠিক হবে না। কেবিনের চারদিকে চোখ বুলালেন ফন গোলডা। বাকি সবাই তো বেঠিক তারপর গ্লাসে আরও খানিকটা স্কচ ঢেলে বললেন, ত্রিশ বছরের ওপর। এটা কোন গোপন ব্যাপার নয়। যুদ্ধের আগে, ভিয়েনায়। কিন্তু কি ব্যাপার?
তখনও আপনি ফিল্ম বিজনেসে ছিলেন?
হ্যা এবং না। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন কাউন্ট। এ-ও রেকর্ডে পাবেন আপনি। আমার তখন রমরমা অবস্থা, ডক্টর। আমি তখন কাউন্ট অর্থে কাউন্ট কাউন্ট বট্রিউলা আইকারভস্কি। আমি ছিলাম মি. গোলডার ফেরেশতা, তার প্রথম পৃষ্ঠপোষক। এবার তার মুখে সকৌতুক হাসি ফুটল। বুঝে দেখুন না, তা না হলে বোর্ডের একজন সদস্য হই কি করে!
উনিশশো আটত্রিশ সালে ভিয়েনা থেকে হঠাৎ গায়েব হয়ে যান এরিক কার্লসন, তাই না? এ-ব্যাপারে কি জানেন আপনি?
কৌতুকের ভাব চেহারা থেকে মুছে গেল, রানার দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকলেন কাউন্ট।
রানা বলল, তারমানে এটা রেকর্ডে নেই। কাউন্ট কিছু বলেন কিনা শোনার জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ও। তারপর আবার বলল, সাবধানে থাকবেন, কাউন্ট। নিজের পিছন দিকে নজর রাখতে ভুলবেন না।
আ-আমার…আমার পিছন দিকে?
পিছন থেকে পিঠে ছুরি মারা খুব সহজ, বলল রানা। নাকি লক্ষ করেননি মার্ভেলাস-এর বোর্ড সদস্যরা একে একে খসে পড়ছে? একজন বাইরে মরে পড়ে আছে, আরেকজন ভেতরে মরে পড়ে আছে। আরও দুজনের সম্ভবত সলিল সমাধি ঘটেছে। কেন আপনার মনে হচ্ছে আপনি ভাগ্যবান? নিজে তো সাবধান থাকবেনই, মি. হ্যামারহেড আর মি. মুরকেও সাবধান থাকতে বলে দেবেন, অন্তত আমি চলে যাবার পর। বিশেষ করে মি. মুরকে। আমি খুশি হব আপনি যদি তাকে আমার অনুপস্থিতিতে এই কেবিনের বাইরে বেরুতে না দেন।
.
******
.
ঝাড়া এক মিনিট কথা বললেন না কাউন্ট। চেহারা দেখে কিছুই বোঝা গেল না। তারপর মুখ তুলে বললেন, আপনার কথা আমার বোধগম্য হলো না, ডক্টর রানা।
জানি হবে না, বলল রানা, হাত বাড়িয়ে তাঁর কোটের পকেটে টোকা মারল। জিনিসটা এখানে থাকা দরকার, আপনার কিউবিকলে নয়।
মানে?
আপনার নাইন এমএম বেরেটা অটোমেটিক।
কাউন্টকে পাশ কাটিয়ে জক মুরের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। তার গ্লাস ধরা হাতটা থর থর করে কাঁপছে। বললেন, আমাদের মহৎপ্রাণ হিলার আবার মানুষকে বাঁচাবার জন্যে ছুটছেন। মাই বয়, আপনাকে নিয়ে কতখানি গর্বিত আমি সে-কথা…।
আমি চলে গেলে কেবিন ছেড়ে কোথাও বেরুবেন না। ভুলেও না, প্লীজ ফর মি, মি. মুর।
মার্সিফুল হেভেনস। হেঁচকি তুললেন জক মুর। শুনলে লোকে ভাববে আমি যেন কোন্ বিপদের মধ্যে আছি।
সত্যি আছেন। বিশ্বাস করুন, সত্যি বিপদের মধ্যে আছেন।
আমি? আমি? দেখে মনে হলো জক মুর সত্যি বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু কে বেচারা বুড়ো মুরের ক্ষতি করতে চাইবে?
সে-সব পরে শুনবেন। আপনি আমাকে কথা দিন, কোন অবস্থাতেই কেবিন ছেড়ে আজ রাতে কোথাও যাবেন না।
ব্যাপারটা আপনার কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ, মাই বয়?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে। এখানে বসে আমি শুধু স্কচ সাবাড় করব…
এরপর হিউম আর এলিনার সামনে এসে দাঁড়াল রানা। নিচু গলায় তর্ক করছে ওরা, তবে দুজনের চেহারাতেই তীব্র উত্তেজনার ছাপ। বিচ্ছিন্ন হলো ওরা, এলিনা রানার একটা বাহু আঁকড়ে ধরল। স্ত্রীজ, ডক্টর রানা, প্লীজ! ডগলাসকে আপনি নিষেধ করুন যেতে। আপনার কথা শুনবে ও। শিউরে উঠল মেয়েটা। আমি জানি আজ রাতে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটবে।
তোমার ধারণা সত্যি হতে পারে, বলল রানা। মি. হিউম, আমরা কেউ চাই না আপনি খরচ হয়ে যান।
রানার কথা শুনে হকচকিয়ে গেল এলিনা, যেন ওর কথার অন্য কোন গভীর তাৎপর্য ধরা পড়েছে তার কাছে। এবার রানার বাহুটা দুহাতে আঁকড়ে ধরল সে, চোখে রাজ্যের হতাশা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে। চলে গেল নিজের কিউবিকলের দিকে।
ওর পিছু নিন, হিউমকে বলল রানা। ওকে বলুন…।
আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি, ডক্টর। ও জানে।
গলা খাদে নামাল রানা। যা বলছি শুনুন। গিয়ে বলুন জানালাটা খুলে যে কালো বাক্সটা আমি ওকে দিয়েছি সেটা যেন বাইরের তুষারে নামিয়ে দেয়। তারপর জানালাটা বন্ধ করতে হবে।
প্রতিবাদ করে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল হিউম, তারপর মাথা কঁকিয়ে চলে গেল। এক মিনিট পরই আবার ফিরে এল সে। দুজনেই ওরা গরম। কাপড়চোপড় পরে তৈরি হলো, সঙ্গে নিল চারটে টর্চ। ওরা বেরিয়ে যাবে, হুপারের পাশ থেকে উঠে এসে রানাকে ডাকল পামেলা। ডক্টর রানা।
সোনালি চুলের যেখানে কান আছে বলে মনে হয় ঠিক সেখানটায় মাথা নামাল রানা, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, য়্যাম আই ওয়াণ্ডারফুল?
সম্মোহিত ভক্তের মত মাথা ঝাঁকাল পামেলা, চশমার পিছনে চোখ দুটো বিষণ্ণ, আলতোভাবে চুমো খেলো রানাকে। কোন কথা হলো না। বাইরে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদের সুরে রানাকে বলল হিউম, মেয়েটা আমাকেও একটা চুমো খেতে পারত।
আপনাকে চুমো খাবার মানুষ এখানে একজন আছে, আমার নেই, বলল রানা।
খানিক দূর এগিয়ে টর্চ নিভিয়ে অপেক্ষা করল ওরা, দেখতে চায় পিছু নিয়ে কেউ আসছে কিনা। এরপর এলিনার জানালার নিচ থেকে কালো বাক্সটা সংগ্রহ করল।
জেটি পর্যন্ত আসতে কোন সমস্যা হলো না। বোটে চড়ে স্টার্ট দিল রানা, হিউম বলল, নরকও বোধহয় এরকম অন্ধকার নয়, ডক্টর। কাজটা আপনি কি করে করবেন?
কি কাজ?
মি. কার্লসনকে কিভাবে খুঁজে বের করবেন?
কার্লসন বা তার সঙ্গীদের জীবনে আর কখনও যদি দেখতে না পাই, আমার মন একটুও খারাপ হবে না, বলল রানা। ওদেরকে খুঁজে বের করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। সত্যি কথা বলতে কি, ওদেরকে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করব আমরা। বোট চালিয়ে সোর-হামনার উত্তর তীরে চলে এল ওরা, তারপর এঞ্জিন বন্ধ করে দিল রানা। অলসভঙ্গিতে ভাসতে ভাসতে তীরের দিকে এগোল বোট, একটা রশি ছুঁড়ল রানা। চার্ট বলছে, পানি এখানে তিন ফ্যাদম গভীর। আর এক্সপার্টরা বলছে, পঞ্চাশ ফুট রশি ফেললে বোট কোথাও ভেসে যাবে না। পিছনে জমিন থাকায় আকাশের গায়ে বোট বা আমাদের কাঠামো ফুটবে না, অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকে কেউ এলে দেখতে পাবে না কিছু। ধূমপান নিষেধ, প্লীজ।
আমার খুব মজা লাগছে, বলল হিউম। দক্ষিণ দিক থেকে কে আসবে বলে আপনার ধারণা?
আমরা যাদেরকে খুঁজতে বেরিয়ে খুঁজছি না।
তারমানে আপনি বলতে চান ওরা কোন বিপদে পড়েনি?
আমি বলতে চাই ওরা আসলে বিপদ ঘটাচ্ছে।
কিছুক্ষণ চিন্তা করল হিউম, তারপর বলল, মনে হচ্ছে আমাদেরকে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে। সময়টা কাটাবার জন্যে আমাকে আপনি একটা রূপকথা শোনাবেন নাকি, মি. রানা।
কাজেই যতটুকু যা জানে বা জানে বলে মনে করে, বলে গেল রানা। শোনার পরও কোন মন্তব্য করল না হিউম। রানা জিজ্ঞেস করল, আমাকে কথা দিচ্ছেন। তো, দেখামাত্র আপনি কার্লসনের মাথা ফাটাবেন না?
দিচ্ছি, অনিচ্ছাসত্ত্বেও দিচ্ছি। শিউরে উঠল হিউম। ওহে যীশু, বড় ঠাণ্ডা!
চুপ!
প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর স্পষ্ট এঞ্জিনের আওয়াজ ভেসে এল। তিন মিনিট পর জেটির উত্তর বাহু ঘুরে উদয় হলো কার্লসনের ষোলো ফুটী বোট। এঞ্জিন বন্ধ হলো। সঙ্গে সঙ্গে কার্লসন, বিশপ বা ফার্গুসন তীরে নামল না। জেটির পাশে প্রায় মিনিট দশেক থাকল তারা। অন্ধকারে দেখা গেল না কি করছে, তবে টর্চের আলো দেখা গেল, আর পানিতে ভারি কিছু ফেলার আওয়াজ ভেসে এল। তারপর জেটি ধরে কেবিনের দিকে চলে গেল দলটা।
এখন আমরা কি করব? জানতে চাইল হিউম।
পাশের বে-তে যাব, সংক্ষেপে জবাব দিল রানা। পাহাড়-প্রাচীরের সেই ফাঁকটার কথা ভোলেনি ও।
বোট নিয়ে রওনা হলো ওরা। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর হিউম জিজ্ঞেস করল, আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
আপনি এমন কি উত্তরও পেতে পারেন। ভাল কথা, ইভনিং স্টারের কথা মনে আছে আপনার, নাকি ভুলে গেছেন?
সেকি, ভুলব কেন!
আজ রাতে ওটাকে আবার আপনি দেখার সুযোগ পেতে পারেন।
হোয়াট!
সত্যি বলছি।
ইভনিং স্টার?
আদি ও অকৃত্রিম। মানে, দেখতে পাব বলে আশা করছি আর কি। শুনুন, আজ সকালে বিনকিউলার দিয়ে আমি একটা ফাঁক দেখেছি পাথরের গায়ে, ইভজেবুকতা বে-তে।
ফাঁক মানে?
একটা টানেল। দূর থেকে দেখেছি, তবে আমার ধারণা লম্বায় অন্তত দুশো গজ হবে টানেলটা। চার্টে ওটার একটা নামও আছে-পাল পোটেন। খুঁজে বের করতে হলে বেয়ার আইল্যাণ্ডের একটা লার্জ-স্কেল ম্যাপ দরকার হবে আপনার। আজ বিকেলে সেরকম একটা আমার হাতে এসেছে।
আপনার ধারণা মি. কার্লসন আর তার সঙ্গীরা ওই টানেলে ছিলেন?
আমার ধারণা নেই আর কোথায় থাকতে পারেন ওঁরা। দুটো বে-র এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আজ সকালে ওঁদেরকে আমি খুঁজিনি।
দশ মিনিটের মধ্যে দ্বিতীয় বে-তে প্রবেশ করল ওরা। অন্ধকারের ভেতরও পাহাড়চূড়াগুলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বোটের সামনে সরে গিয়ে শক্তিশালী একজোড়া টর্চ জ্বালল হিউম। দুমিনিটের মধ্যে কালো পাহাড়-প্রাচীর ওদের দৃষ্টিসীমার ভেতর চলে এল, একশো গজ দূরেও নয়। স্টারবোর্ডের দিকে বাঁক নিল বোট, পাহাড়-প্রাচীর ঘেঁষে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। এক মিনিট পর পাথরের গায়ে একটা ফাঁক দেখা গেল, কিন্তু আকারে সেটা খুবই ছোট। আবার বোট ছাড়ল ওরা, গতি মন্থর। আরও এক মিনিট পর যা খুঁজছিল পেয়ে গেল। টানেলে ঢুকে পড়ল বোট।
দেখে যতটা মনে হয় তারচেয়ে বড় টানেলটা, যদিও ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। রানার ধারণা, টানেলটা এক বে থেকে শুরু হয়ে আরেক বে-তে গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু সরু হতে হতে সামনের পথ বন্ধ হয়ে গেল। তারপর টর্চের আলোয় ওরা দেখল, টানেলের এক ধারে পাথরের শেলফ রয়েছে, সমতল, চওড়ায় দুই থেকে পাঁচ ফুট। শেলফের ওপর ধূসর রঙে রাঙানো ধাতব বার স্থূপ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
কেউ কোন কথা বলল না। বাকি দুটো টর্চও জ্বালল হিউম, শেলফের ওপর এমনভাবে রাখল যাতে চারদিকে আলো পাওয়া যায়। বোট থেকে শেলফে উঠে এল ওরা। ছোট ছুরি দিয়ে একটা বারের রঙ সামান্য একটু তুলল রানা। কেউ কোন কথা বলল না। একটা বোট-হুঁক ফেলে পানির গভীরতা মাপল রানা। পানি এখানে মাত্র পাঁচ ফুট গভীর। নিচের পাথরগুলোকে অদ্ভুত লাগল ওর। হুকটা কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করতে কিছু একটায় আটকাল, পানির ওপর তুলে আনল সেটা। আধ ইঞ্চি চওড়া চেইন একটা, এখানে সেখানে মরচে ধরে গেছে। হুকটা আবার পানিতে ডোবাল ও। এবার তুলল চৌকো একটা বার, আই-বোল্ট-এর সঙ্গে চেইন দিয়ে আটকানো। পানি থেকে তোলা বার আর শেলফের বার, একই আকৃতির, তবে এটার রঙ চটে গেছে। চেইন আর বারটা পানিতে ফেলে দিল রানা।
ছুরিটা আবার হাতে নিয়ে একটা বারের গা পরীক্ষা করল রানা। প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া চলে বার-এর গা সীসা দিয়ে তৈরি, তবে খুব পাতলা, শুধু আবরণ হিসেবে কাজ করছে। নিচে রয়েছে শক্ত কিছু। জোরে ছুরি চালিয়ে এক বর্গ-ইঞ্চির মত সীসা চেঁছে ফেলল রানা। টর্চের আলোয় হলুদ কি যেন চকচক করে উঠল।
অ্যাডভেঞ্চারারদের ভাষায় কি বলে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল হিউম। গুপ্তধন?
আমার ভাষায় হারানো ধন।
দেখুন এখানে কি পেয়েছি আমি, বলে বারগুলোর পিছন থেকে রঙের একটা ক্যান তুলল হিউম। ক্যান-এর গায়ে লেখা রয়েছে-ইনস্ট্যান্ট গ্রে।
খুব চালাকির সঙ্গে কাজটা করা হয়েছে, বুঝলেন, বলল রানা। একটা বারে আঙুল ছোঁয়াল ও। শুকনো। আই-বোল্ট কেটে ফেলে দিন, তারপর রঙ চড়ান, কি পেলেন?
একটা ব্যালাস্ট বার। নকল সাবমেরিনে যে ব্যালাস্ট বার আছে, রঙ ও আকৃতিতে তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাবে।
দশে দশ পেলেন, বলল রানা। একটা বার দুহাতে ধরে তুলে ফেলল ও। বহন করাও সহজ। চল্লিশ পাউণ্ডের একটা ইনগট।
কি করে জানলেন?
বললাম না, হারানো ধন। যার হারায় তাকে অনেক গবেষণা করতে হয়, তা হলে হারানো জিনিস দেখতে পেলেও চিনতে পারবে না। এগুলো সব গহনা ছিল। একাধিক বার হাত বদল হবার ফাঁকে কোন এক সময় গলিয়ে বার বানানো হয়েছে। শেলফের ওপর সব মিলিয়ে কটা বার হবে বলুন তো?
একশো। বেশি।
এগুলো স্রেফ নমুনা, বেশিরভাগ পাওয়া যাবে পানির তলায়। রঙের সঙ্গে কি ব্রাশও আছে?
আছে। হাত বাড়াল হিউম, তাকে বাধা দিল রানা।
থাক, ফিঙ্গারপ্রিন্টের কথা চিন্তা করুন। ওগুলো প্রমাণ হিসেবে কাজে আসবে। চলুন, এবার কেটে পড়া যাক।
ফিরতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল ওদের। জেটিতে প্রথমে উঠল হিউম, তার হাতে কালো বাক্সটা ধরিয়ে দিল রানা, তারপর নিজেও উঠে এল। কালো বাক্সটা চেয়ে নিয়ে ঢাকনি খুলল ও, অন্ধকারের ভেতর আঙুল দিয়ে খুঁজে নিয়ে অন করল সুইচ, তার আগে টেলিস্কোপিক এরিয়ালটা পুরোপুরি লম্বা করে নিয়েছে। আরও একটা সুইচ অন করল ও। মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল, সেই সঙ্গে জ্বলে উঠল মৃদু সবুজ আলো। গুঞ্জনটা অবশ্য এক গজ দূর থেকেও শোনা যাবে না।
এ ধরনের খেলনা সত্যি কি কাজ করে? জিজ্ঞেস করল হিউম।
গরম পানিতে সেদ্ধ করুন, বরফে লুকিয়ে রাখুন, ডুবিয়ে রাখুন অ্যাসিডে, চারতলা ছাদ থেকে ফেলে দিন, তারপরও কাজ করবে। এটার এক ছোট বোন। আছে, ন্যাভাল গান থেকে ফায়ার করা যায়।
রেঞ্জ?
চল্লিশ মাইল। আজ রাতে তার চার ভাগের এক ভাগও দরকার হবে না।
ওটা কি এখন ট্রান্সমিট করছে?
করছে।
এরপর নকল সাবমেরিনের খোলে নামল রানা। দুমিনিট পর আবার ফিরে এল জেটিতে। হিউম জিজ্ঞেস করল, কোনও সমস্যা?
দুটো রঙ হুবহু এক নয়, তবে পার্থক্যটা ধরা সহজ নয়।
.
স্বর্ণদ্বীপ || মাসুদ রানা || আঠারো
.
একা শুধু কার্লসন ব্যাখ্যা দিলেন, শেষ বিকেলে তাঁদের বোটের এঞ্জিন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, মেরামত করতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বিশপ কিছু বললেন না, চুপ করে থাকল ফার্গুসনও। ফন গোলডা স্কচ খাবার জন্যে বেশ কয়েকবার অনুরোধ। করলেন, কিন্তু তার অনুরোধ রানা রক্ষা করল না। ওর ইচ্ছে আবার বাইরে। বেরুবে ও। হাতঘড়ি দেখল, বেরুবে আর দশ মিনিট পর, ওর সঙ্গে থাকবেন মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের চারজন ডিরেক্টর আর জক মুর। চারজন ডিরেক্টর কেবিনেই রয়েছেন, অনুপস্থিত শুধু জক মুর। তাঁকে ডাকার জন্যে তার কিউবিকলে নিজেই চলে এল রানা।
জানালা খোলা, কিউবিকল খালি। বিছানায় পড়ে থাকা টর্চটা তুলে নিয়ে। জানালার বাইরে আলো ফেলল রানা। তুষারের ওপর একজোড়া পায়ের দাগ দেখা গেল। তার মানে নিজের ইচ্ছায় যাননি জক মুর, তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মেইন কেবিন হয়ে স্টোররুমে চলে এল রানা, কিন্তু এখানেও তাকে পাওয়া গেল না। খবরটা শোনার পর স্বেচ্ছাসেবকের কোন অভাব হলো না, খুঁজতে যেতে এক পায়ে খাড়া সবাই। জক মুর সজ্ঞানে কখনও কারও সঙ্গে শত্রুতা করেননি।
এক মিনিটের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল তাঁকে। পেলেন কাউন্ট। জেনারেটর। শেডের পিছনে তুষারস্তূপের ওপর পড়ে ছিলেন। জ্ঞান নেই, বোধহয় প্রাণও নেই। পরনে শুধু শার্ট, পুলওভার আর ট্রাউজার; পায়ে কার্পেট পিপার। একদম বরফ হয়ে গেছে শরীর, বোধহয় অনেকক্ষণ থেকে পড়ে ছিলেন তুষারের ওপর। তুষারে হলুদ দাগ দেখা গেল, হাতে ধরা বোতলটা থেকে খানিকটা তরল পদার্থ গড়িয়ে পড়েছে। চিৎ করা হলো তাকে, বুকে কান চেপে ধরল রানা। মনে হলো ক্ষীণ একটু শব্দ যেন হচ্ছে।
কিউবিকলে নিয়ে এসে শোয়ানো হলো কটে। কম্বল দিয়ে মোড়া হলো শরীরটা, হট-ওয়াটার ব্যাগ দিয়ে সেঁক দেয়া চলছে। ইতিমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তার হার্ট এখনও সচল। তবে বাঁচবেন কিনা বলা কঠিন।
খুঁজে পাবার পনেরো মিনিট পর মনে হলো নিঃশ্বাস ফেলছেন। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করে দিল রানা। শুধু পামেলা আর এলিনাকে থাকতে বলল।
আরও পাঁচ মিনিট পর নড়ে উঠল জক মুরের চোখ।
এ কাজ কেন আপনি করলেন? জিজ্ঞেস করল রানা।
আহা! বিড়বিড় করলেন তিনি।
কে আপনাকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল?
জক মুরের ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠল, তবে কোন আওয়াজ বেরুল না। তার ঠোঁটের কাছে কান পাতল রানা। গলার ভেতর থেকে ক্ষীণ আওয়াজ বেরিয়ে এল, দয়ালু এক লোক। খুব দয়ালু এক লোক।
রানার ভয় হলো ঝুঁকি দিলে না মরে যান। জিজ্ঞেস করল, কার কথা বলছেন?
আপনি জানেন কি?
কি জানব?
শেষে কিন্তু দয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না…। আবার চোখ বুজলেন জক মুর।
এলিনার দিকে তাকাল রানা। মি. হিউমকে গিয়ে বলো, কাউন্টকে আমি আমার কিউবিকলে ডাকছি। তাড়াতাড়ি।
কথা না বলে চলে গেল এলিনা। পামেলা বলল, উনি বাঁচবেন তো, ডক্টর রানা?
জানি না।
কিন্তু এখন তো ওঁর শরীর গরম…
ঠাণ্ডায় পড়ে থাকায় মারা যাবেন, ব্যাপারটা তা নয়।
আ-আপনি বলতে চাইছেন…বলতে চাইছেন…মারা যাবেন অ্যালকোহলিক পয়জনিঙে?
যেতে পারেন। জানি না।
ওঁর ওপর আপনার কোন মায়া নেই, তাই না?
নিজের ওপরই ওঁর কোন মায়া নেই, পামেলা। মি. মুর অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।
নিজের কিউবিকলে এসে কাউন্টকে দেখল রানা। কোন ভূমিকা না করে জিজ্ঞেস করল, বুঝতে পারছেন তো, মি. মুরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা। হয়েছিল?
না। তবে সন্দেহ হয়েছে।
আপনি জানেন মোনাকাকে খুন করা হয়েছে?
খুন করা হয়েছে! চেহারা দেখে মনে হলো সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেছেন কাউন্ট।
বেশি মাত্রায় মরফিন দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁকে। সিরিঞ্জটা আমার, মরফিনটুকুও আমার। কাউন্ট কিছু না বলে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারছেন তো, বেআইনী গুপ্তধন খুঁজতে এসে কি বিপদে জড়িয়ে পড়েছেন?
হ্যাঁ, বিপদেই…।
আপনাকে স্বীকার করতে হবে খুনীদের সঙ্গে রয়েছেন আপনি।
হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারছি।
আইন আপনার সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, আপনার ধারণা আছে?
আছে।
অস্ত্রটা কোথায়? জিজ্ঞেস করল রানা। ওটা চালাতে জানেন?
আহত দেখাল কাউন্টকে। আমি একজন পোলিশ কাউন্ট, স্যার!
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আপনার বাঁচার একমাত্র উপায় রাজসাক্ষী হওয়া?
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
.
মি. গোলডা, মি. কার্লসন, মি. বিশপ ও কাউন্ট বডিউলা, চারজনের নাম উচ্চারণ করল রানা। আপনাদেরকে আমার সঙ্গে একটু বাইরে যেতে হবে, প্রীজ।
কি? বাইরে যেতে হবে? প্রতিবাদ করলেন ফন গোলডা। এই ঠাণ্ডায়? কেন, কেন?
প্লীজ। কেবিনের চারদিকে তাকাল রানা। আমি কৃতজ্ঞ বোধ করব, বাকি সবাই আপনারা যদি আমি না ফেরা পর্যন্ত এই মেইন কেবিন ছেড়ে কোথাও না যান। বিশ্বাস করুন, অনুরোধটা আমি আপনাদের স্বার্থেই করছি। আজ সকাল থেকে আমি জানি আমাদের মধ্যে কে খুনী। তবে তার নাম উচ্চারণ করার আগে মি. গোলডা আর তার সহ ডিরেক্টরদের সঙ্গে আমি একটু আলাপ করে নিতে চাই।
ফন গোলডা কর্কশ সুরে জানতে চাইলেন, আপনি তার পরিচয় জানেন?
জানি।
মানে তার অপরাধ আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?
না, তা পারব না।
হাহ্! হেসে উঠলেন ফন গোলডা। কেবিনে উপস্থিত সবার ওপর চোখ বুলালেন। আপনি বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন, তাই না, ডক্টর রানা?
কোন্ অর্থে?
লক্ষ করছি, সবার ওপর কর্তৃত্ব ফলাবার একটা চেষ্টা করছেন আপনি। খুনীকে যদি চিনে থাকেন, নামটা বলে ফেললেই তো পারেন, এত নাটক করছেন কেন? ভুলে যাবেন না, আপনিও আমাদের একজন। আপনিও মার্ভেলাসের একজন কর্মচারী…।
মার্ভেলাসের কর্মচারী আমি নই। আমি চাকরি করি বিসিআই-এর-বিসিআই মানে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স। ব্রিটেনের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টও আমাকে কিছু ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়েছে, কাজেই বলতে পারেন আমি এখানে ব্রিটিশ সরকারেরও প্রতিনিধিত্ব করছি। আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছিল মার্ভেলাস প্রোডাকশন্সের কিছু ব্যাপার তদন্ত করে দেখার জন্যে। আমার তদন্ত শেষ হয়েছে।
ফন গোলডার চোয়াল ঝুলে পড়ল। সরকারী এজেন্ট! সিক্রেট এজেন্ট!
এরিক কার্লসনও যেন গুঙিয়ে উঠলেন। বিসিআই মানে? হোয়াট ইজ দিস!
তদন্ত? কিসের তদন্ত? হাঁপাচ্ছেন ফন গোলডা। একজন ডাক্তারের মুখ। থেকে এ-সব কথা বেরোয় কিভাবে?
মনে পড়ে, ইন্টারভিউ-এর জন্যে সাতজন ডাক্তারকে ডাকা হয়েছিল? কিন্তু হাজির হয় মাত্র একজন-মাসুদ রানা?
ক্লার্ক বিশপ শান্ত সুরে বললেন, আমাদের বোধহয় শোনা উচিত মি. রানার কি বলার আছে।
মি. হিউম, আপনার সঙ্গে কথা আছে, বলে তার দিকে এগোল রানা।
ওর পথ রোধ করলেন ফন গোলডা। যা বলার আমাদের সামনে বলতে হবে, ডক্টর রানা।
পারলে ঠেকান, বলে ফন গোলডাকে ধাক্কা দিয়ে এগোল রানা। হিউমকে নিয়ে চলে এল নিজের কিউবিকলে। আমাদের বন্ধুরা আসছে। এসে যদি আমাকে জেটিতে না পায়, সরাসরি এখানে চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে, আমি চাই, তাদের আপনি জানাবেন আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে। আরও জরুরী কাজ, আমি চাই ফার্গুসনের ওপর আপনি সারাক্ষণ নজর রাখবেন। সে যদি কেবিন থেকে বেরুতে চায়, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করবেন। যদি আপনার কথা না শোনে, যেতে দেবেন-তিন ফুট। হাতের কাছে আর কিছু না পান, স্কচের একটা বোতল অন্তত রাখবেন। অবশ্যই মাথার পিছনে মারবেন, যত জোরে খুশি।
আমি বরং কাঁধে মারব। মাথায় মারলে যদি মরে যায়!
.
সঙ্গে করে একটা কোলম্যান স্টর্ম লণ্ঠন নিয়ে এসেছে রানা, এখন সেটা খাড়া মইয়ের একটা ধাপের সঙ্গে ঝুলছে, মইটা নেমে গেছে কনিং-টাওয়ার থেকে নকল সাবমেরিনের ভেতরে। সবাই দাঁড়িয়ে আছেন ওঁরা, দৃষ্টিতে একাধারে বিদ্রূপ ও ক্রোধ, রানার কাজ দেখছেন। ভ্রু খুলে কাঠের একটা পাটাতন সরাল ও, ভেতর থেকে একটা ব্যালাস্ট বার তুলে এনে সাবধানে কমপ্রেসরের ওপর রাখল। ছুরির ফলা দিয়ে বারটার গায়ে খোঁচা দিল বার কয়েক। দেখুন কেমন চকচক করছে, ফন গোলডাকে বলল ও। চকচক করলেই সোনা হয় না, কথাটা সত্যি। তবে। এই বারটা সোনাই।
একে একে সবার দিকে একবার করে তাকাল রানা। কেউ নড়ছেন না, কথাও বলছেন না।
আশ্চর্য, আপনাদের কোন প্রতিক্রিয়া নেই! হাসল রানা, ছুরিটা ভাজ করে পকেটে ভরল। আবার আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ আপনারা এই সোনা উদ্ধার করার জন্যেই তো ছবি তৈরি করার নাম করে বেয়ার আইল্যাণ্ডে এসেছেন।
এবারও কেউ কথা বললেন না। রানার দিকে নয়, সবাই তাকিয়ে আছেন সোনার বারটার দিকে, ওটা যেন ওঁদেরকে জাদু করেছে।
কি হলো? কারও কিছু বলার নেই?
আমার ধারণা, মি. রানা, গম্ভীর গলায় বললেন ফন গোলডা, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কারণটাও বুঝি। সেজন্যে আপনার প্রতি আমাদের সবার সহানুভূতি রয়েছে। এই কদিনের ঘটনা আপনার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, আপনাকে এখন প্রায় একটা মেন্টাল কেসই বলা যায়।
ধন্যবাদ, আপনার মূল্যবান বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হলো আমাদের। মি. বিশপ, আপনি? কিছু অন্তত বলুন। ভুলে যাবেন না, আপনি আমার কাছে ঋণী। আমি না থাকলে, এই নাটকটার আয়োজন না করলে হপ্তা ঘুরে আসার আগেই আপনি মারা যেতেন।
আমার ধারণা মি. গোলডা ঠিক কথাই বলছেন, শান্ত গলায় বললেন বিশপ। গোটা ব্যাপারটা আপনার অসুস্থ মনের কল্পনা।
চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের এই সোনার বারটাও কি কল্পনা? কাঠের পাটাতনের ওপর পা ঠুকল রানা। এর নিচে আরও পনেরোটা বার রয়েছে, সেগুলো? পার্সপোর্টেনের শেলফে রয়েছে এরকম একশোর বেশি বার, সেগুলোও কল্পনা? আর পার্লপোর্টেনের পানির নিচে যেগুলো রয়েছে? সব যখন ফাস হয়ে গেছে, না। বোঝার ভান করে কি লাভ বলুন তো? সব মিলিয়ে চার টন সোনা, পাঁচ টনও হতে পারে। কত দাম হবে?
কেউ কথা বললেন না।
ফিল্ম ইউনিট আসলে একটা কাভার। বলা যায় নিখুঁত কাভার। সবাই জানে সিনেমা লাইনের লোকজন একটু খেয়ালী হয়, তাদের উদ্ভট আচরণকেও স্বাভাবিক। বলে মেনে নেয় মানুষ। বছরের এই সময়টায় বেয়ার আইল্যাণ্ডে দিনের আলো থাকে মাত্র অল্প কিছুক্ষণ, তাহলে শূটিং করতে আসার কি কারণ? কারণ রাতের অন্ধকারে সোনা উদ্ধারের কাজটা যাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে নিরাপদে সারা যায়। সঙ্গে করে নিয়ে আসা হয়েছে নকল একটা সাবমেরিন, চিত্রনাট্যে ওটার। প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। সাবমেরিনের সঙ্গে ব্যালাস্ট তো থাকবেই। কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে সোনার বারগুলো ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যাবার কৌশল এটা। লোহার ব্যালাস্ট বার ফেলে দিয়ে তার জায়গায় রাখা হবে সোনার বার। কার সাধ্য ধরতে পারে।
সবাই চুপ।
আপনারা সম্ভবত নকল সাবমেরিনটাকে পার্লপোর্টেনে নিয়ে যাবার একটা অজুহাত তৈরি করতেন, বারগুলো সাবমেরিনে তুলতে যাতে সুবিধে হয়। তারপরই রওনা হয়ে যেতেন ফিরতি পথে। চার-পাঁচ টন সোনা, আপনাদের আর পায় কে!
ঠিকই ধরেছেন আপনি। আপনার সব কথাই সত্যি। ফন গোলডা সম্পূর্ণ শান্ত। তবে ব্যাপারটাকে ক্রিমিনাল কেস হিসেবে দাঁড় করাতে পারবেন বলে মনে হয় না। অভিযোগটা কি, শুনি? চুরি? হাস্যকর শোনাবে। সবাই জানে, গুপ্তধন যে পায় তার।
যে পায় তার? মাত্র কয়েক টন সোনা? আর গুপ্তধন বলছেন কেন? পরিচয় দিলাম, তারপরও বুঝতে পারছেন না? বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, মি. গোলডা। গুপ্তধন নয়, এ সোনা বাংলাদেশ থেকে ছিনতাই করা হয়েছিল। ছিনতাই করেছিল জাপানীরা, আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সে-সব। অবশ্য আপনাদের জানার কথা নয়। চোরের ওপর বাটপারি হয়ে যায়, জাপানীদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় জার্মানরা। থাক এ-সব কথা। আপনারা বরং মি. কার্লসনের দিকে একবার ভাল করে তাকান। উনি যে কতটা গভীর জলের মাছ, আপনাদের কারও সে ধারণা নেই। কি, মি. কার্লসন, আমি কি ভুল বললাম?
সবাই কার্লসনের দিকে তাকালেন। কিন্তু কার্লসন কারও দিকে তাকালেন না।
আগেই বলেছি, আমি ব্রিটিশ সরকারেরও প্রতিনিধিত্ব করছি। সত্যি কথা বলতে কি, ইউরোপের অনেক সরকারই মি. কার্লসন সম্পর্কে আগ্রহী। মি. কার্লসন, এ-কথা কি সত্যি নয়, আপনি ত্রিশ বছরেরও বেশি সোভিয়েত সরকারের হয়ে কাজ করছেন?
বিস্ফারিত চোখে কার্লসনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ফন গোলডা। কার্লসন নিঃশব্দে ফুঁসছেন, তাকিয়ে আছেন রানার দিকে।
উনি যখন কিছু বলবেন না, আমাকেই তাহলে বলতে হয়। মি. কার্লসন হলেন একজন ট্রেজার-হান্টার, এক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। তবে শুধু যে। গুপ্তধন খুঁজে বেড়ান, তা নয়। আরও একটা জিনিস খুঁজে বেড়ান তিনি, যদিও সে-সম্পর্কে আপনাদেরকে কিছু বলেননি। উনি শর্ত দেন, গুপ্তধনের বখরা পেতে হলে এলিনা স্টুয়ার্টকে মার্ভেলাসে চাকরি দিতে হবে। তার পরিচয় দেন নিজের ভাগ্নী বলে। যদিও কথাটা সত্যি নয়।
এলিনার বাবা আপনাদের মতই একজন বদ লোক। জার্মান নেভি আর নাৎসী পার্টিতে খুব বড় পদে ছিলেন তিনি। যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে বুঝতে পেরে পালিয়ে যান, তবে খালি হাতে নয়। বিভিন্ন দেশ থেকে লুঠ করা সোনা কোথায় রাখা হয় তিনি জানতেন। যতটা সম্ভব জাহাজে ভরে নিয়ে কেটে পড়েন তিনি। চলে আসেন বেয়ার আইল্যাণ্ডে, লুকিয়ে রাখেন পার্লপোর্টেনে। সম্ভবত জাহাজ নিয়ে নয়, একটা সাবমেরিন নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
তবে পার্লপোর্টেনে শুধু সোনা নিয়ে আসা হয়নি। এখানেই এলিনার প্রসঙ্গ এসে পড়ে আবার। সোনার সঙ্গে বিপুল পরিমাণে ব্যাংক বণ্ড বা সিকিউরিটিজও নিয়ে আসা হয়। এ-ধরনের সিকিউরিটিজ এখনও বিনিময়যোগ্য। সম্প্রতি ত্রিশ মিলিয়ন পাউণ্ড বা সমমূল্যের বণ্ড ভাঙাবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু মালিকানা সম্পর্কে প্রমাণের অভাবে জার্মান ফেডারেল ব্যাংক ওগুলোর বিনিময়ে টাকা দিতে অস্বীকার করে। তবে মালিকানা প্রমাণ করা এখন কোন সমস্যা নয়, তাই না, মি. কার্লসন?
আগের মতই চুপ করে থাকলেন এরিক কার্লসন।
কিন্তু কোথায় সেগুলো? ডামি স্টীল ইনগট-এর ভেতর লুকানো আছে? কেউ জবাব না দেয়ায় আবার রানা বলল, কিছু আসে যায় না, যেখানেই থাকুক ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাবে। এ-প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলি। ওই ডকুমেন্টগুলোয় আপনি এলিনার বাবার সই ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করতে পারছেন না।
কে বলল পারছি না? এতক্ষণে এই প্রথম কথা বললেন কার্লসন।
আমি বলছি।
কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন, অ্যাডমিরাল টুডিয়ার আমাদের হাতে বন্দী।
ওটাই কি এলিনার বাবার আসল নাম? ও, তা-ও আপনি জানেন না?
না। তবে এর কোন গুরুত্ব নেই। না, এলিনার বাবা যে আপনার হাতে বন্দী। তা আমি ভুলিনি। তবে এ-প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে আপনার বন্ধুদের প্রসঙ্গে আরও দুএকটা কথা বলে নিই। সরি, বন্ধু বলা বোধহয় ঠিক হলো না। ওদের চেহারা লক্ষ করুন। বন্ধু বলে মনে হচ্ছে কি?
এ অবিশ্বাস্য! চাপা গলায় গর্জে উঠলেন ফন গোলডা। এ অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। ভাবা যায়, আমাদের একজন পার্টনার…
জঘন্য ষড়যন্ত্র! হিস হিস করে উঠলেন বিশপ। স্রেফ বেঈমানী!
হা, সিকিউরিটিজ-এর ভাগ আপনাদের উনি দিতেন না। তবে ফাঁকি দেয়ার। কাজে একা শুধু কার্লসনই দক্ষ নন, নিজেদের আসল উদ্দেশ্য গোপন করার ব্যাপারে আপনারাও কেউ কারও চেয়ে কম যান না।
কাউন্টকে ধরুন। আপনাদের তুলনায় তাকে আমি ফেরেশতা বলব, তবে তিনিও ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে পটু। বোর্ডে আজ তিনি ত্রিশ বছর ধরে আছেন, প্রাপ্য না হলেও বখরা পাচ্ছেন লাভের। কিভাবে? ভিয়েনা থেকে মি. গোলডা আর মি. কার্লসন যখন পালালেন, কাউন্ট তখন ওখানেই ছিলেন। কার্লসন পালালেন গোলডা তাকে পালাতে প্ররোচিত করায়, কারণ কার্লসন। পালিয়ে গেলে তিনি তার ফিল্ম কোম্পানীর পুঁজি দেশের বাইরে সরিয়ে নিয়ে। যেতে পারবেন। বন্ধুর সঙ্গে বেঈমানী করার সুযোগ পেলে মি. গোলডা কখনোই তা হাতছাড়া করেন না।
কিন্তু গোলডা জানতেন না, কাউন্ট তাঁকে বলেননি, কার্লসন নিখোঁজ হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। বেশ কিছুদিন থেকে জার্মানদের হয়ে গোপনে কাজ করছিলেন তিনি, এই সময় জার্মানীতে তাকে ডেকে নেয়া হয়। কিন্তু জার্মানরা জানত না যে রাশিয়ানরা আগেই তাকে হাত করেছে। এ-প্রসঙ্গ থাক। আমার বলার কথা হলো, গোলডা জানেন তিনি তার বন্ধুর সঙ্গে বেঈমানী করেছেন, সেই সঙ্গে এ-ও জানেন যে কথাটা কাউন্টের কাছে গোপন নেই। কাউন্ট খুব একটা লোভী লোক নন, তাই মোটা টাকার বেতনেই খুশি থাকলেন। তিনি, হাঁসটাকে জবাই করে সবগুলো ডিম পেতে চেষ্টা করেননি। সেজন্যেই তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে কেস দাঁড় করানো কঠিন হবে। আর সেজন্যেই তাকে আমি রাজসাক্ষী হবার প্রস্তাব দিয়েছি। উনি আমার প্রস্তাব গ্রহণও করেছেন। আদালতে উনি ওঁনার সহ-ডিরেক্টরদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন।
ফন গোলডা আর ক্লার্ক বিশপের মত এবার এরিক কার্লসনও অগ্নিদৃষ্টি হানলেন কাউন্টের দিকে।
কিংবা গোলডার কথা ধরুন, বলে চলেছে রানা। বহু বছর ধরে কোম্পানী থেকে মোটা অঙ্কের টাকা সরাচ্ছেন তিনি, বলা যায় ঝাঁঝরা করে ফেলছেন। এবার বিশপ আর কার্লসন ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে গোলডার দিকে তাকালেন। কিংবা বিশপের কথা ধরুন। গোলডা যে টাকা সরাচ্ছেন, দুতিন বছর আগে উনি তা টের পেয়ে যান। সেই থেকে গোলডাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন তিনি, বলা যায় প্রায় ফতুর করে ফেলছেন।
এবার আসল প্রসঙ্গ। আপনাদের মধ্যে খুনী কে? নাকি বলা উচিত কারা খুনী? মি. গোলডা, আপনার কিছু বলার আছে?
রানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন গোলডা। জবাব দিলেন না।
আপনার যে যাবজ্জীবন হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আপনার ভাড়াটে দুজন খুনীরও যাবজ্জীবন হবে। ফার্গুসন আর ব্রাশটম্যানের।
ফ্রিজিং পয়েন্টের অনেক নিচে নেমে গেছে কেবিনের তাপমাত্রা, কিন্তু ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করছে বলে মনে হলো না।
ফন গোলডা এক মহা পাপী, শয়তান লোক, বলল রানা। তার অপরাধের কোন সীমা নেই। তবে তার কপালটাও খারাপ। শুধু যে আপনারা তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করছিলেন তা নয়, তার মেয়ে এবং জামাইও এই কাজে নেমে পড়ে। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা কার অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা ঘটে। দুটো গাড়ির একটা ছিল জক মুরের। তাঁর গাড়িতে আরোহী ছিল তিনজন মিসেস মুর আর তাঁদের দুই যমজ মেয়ে। তিনজনই মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় ছিল। অপর গাড়িটা ছিল মিখায়েল ট্যাকারের, তবে গাড়িতে তিনি ছিলেন না। মুরের পরিবার ট্যাকারের দেয়া পার্টি থেকে বেরোন, ওই একই পার্টি থেকে বেরোন গোলডা আর হ্যামারহেড। দ্বিতীয় গাড়িটায় তারা দুজন ছিলেন। বলাই বাহুল্য, মাতাল অবস্থায়। তাই না, মি. গোলডা?
এ-সব প্রলাপ কখনোই প্রমাণ করা যাবে না।
গাড়িটা চালাচ্ছিলেন গোলডা। অ্যাক্সিডেন্টের পর অচেতন হয়ে পড়েন হ্যামারহেড। জ্ঞান ফেরার পর তাকে জানানো হয়, গাড়িটা তিনিই চালাচ্ছিলেন। হ্যাঁ, গোলডাই তাঁকে জানান। ফলে হ্যামারহেড বুঝলেন, তিনজন মানুষকে খুন করে ফেললেও তার জেল হবে না, শুধু যদি গোলডা মুখ না খোলেন। বেতনের তালিকা থেকে জানা যায়…
বেতনের তালিকা? কোত্থেকে পেলেন আপনি? জিজ্ঞেস করলেন বিশপ।
আপনার কিউবিকল থেকে, ওটার সঙ্গে আপনার ব্যাংক-বুকও পেয়েছি।
…তালিকা থেকে জানা যায়, হ্যামারহেড বছরের পর বছর ধরে অতি সামান্য বেতন পাচ্ছেন। সত্যি, মি. গোলডা, আপনার তুলনা আপনিই। হ্যামারহেডের কাঁধে মৃত্যুগুলোর দায় তো চাপিয়েছেনই, প্রায় বিনা বেতনে তাকে চিরকালের জন্যে ক্রীতদাসও বানিয়ে রেখেছেন।
কিন্তু ট্যাকার জানতেন কে দায়ী, কারণ তার বাড়ি থেকে রওনা হবার সময়। গাড়িটা গোলডাই চালাচ্ছিলেন। কাজেই চুপ করে থাকার বিনিময়ে কোম্পানীতে মোটা বেতনে চাকরি নেন ট্যাকার আর মোনাকা। আপনারা কি জানেন, গোলডা আজ জক মুরকেও মেরে ফেলার চেষ্টা করেছেন? কেন শুনবেন? মারা যাবার মাত্র কিছুক্ষণ আগে মুরকে আসল ঘটনা বলে দিয়েছেন মোনাকা। গোলডা ব্যাপারটা জানতে পেরে আর দেরি করেননি।
বেয়ার আইল্যাণ্ডে ছবি বানাতে আসার প্রস্তাবটা সম্ভবত কার্লসনের। প্রস্ত বিটা একাধিক কারণে লুফে নেন গোলডা। অনেক সমস্যা ছিল তার, এক ঢিলে সবগুলোর সমাধান করতে চেয়েছিলেন। সহজ সমাধানটাই বেছে নেন তিনি। ডিরেক্টরদের পাঁচজনকেই মেরে ফেলবেন। হ্যাঁ, নিজের মেয়েকেও, যে মেয়ে। তাঁকে ঘৃণা করে। সেজন্যেই দুজন ভাড়াটে খুনীকে সঙ্গে করে আনেন। ওরা যে ভাড়াটে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজ বিকেলে আমি ফার্গুসনের সুটকেস। থেকে পাঁচ হাজার পাউণ্ডের নতুন নোট পেয়েছি। ওদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। অভিনেতা হিসেবে, কিন্তু তা ওরা নয়। ক্লার্ক বিশপের দিকে তাকাল রানা। বলেছিলাম, আপনিও মারা যাবেন, মনে আছে কি? গোলডার প্ল্যান ছিল আপনাদের সবাইকে…
ঠিক আছে, বুঝলাম, বললেন বিশপ। কিন্তু ওঁর উদ্দেশ্য শুধু যদি বোর্ড ডিরেক্টরদের মেরে ফেলা হয়…।
তাহলে বাকি লোকগুলো মরল কেন, এই তো? এজন্যে দায়ী করতে হয়। দুর্ভাগ্য আর অব্যবস্থাকে। প্রথম টার্গেট ছিল কাউন্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যের শিকারে পরিণত হয় ক্লাউড কেডিপাস। অতীত খুঁজলে, আমার বিশ্বাস, জানা যাবে যে বিষ। সম্পর্কে গোলডা একজন বিশেষজ্ঞ। সেই রাতে একটা সাইড টেবিল থেকে মেইন টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হয়। কাউন্টের প্লেটে সামান্য একটু অ্যাকোনাইট মিশিয়ে দেন তিনি। কিন্তু কেডিপাসের দুর্ভাগ্য হলো, কাউন্ট হর্সর্যাডিশ একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি তাঁর প্লেটটা কেডিপাসকে দিয়ে দেন। ফলে মারা যায় বেচারা।
একই সময়ে কার্লসনকেও বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সী সিকনেসে অসুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েন কার্লসন, প্লেটে হাত না দিয়েই। প্লেটে কেউ হাত দেয়নি দেখে বাবুর্চি মরিসন খাবারটা ফেলে না দিয়ে। রেখে দিল। সেখান থেকে পরিবেশন করা হলো বাক আর পিটারসনকে। সেখান থেকেই খানিকটা চুরি করে খেয়ে ফেললেন ব্যারন। তিনজনই অসুস্থ হয়ে পড়ল, মারা গেল দুজন। দুর্ভাগ্য ছাড়া কি বলা যায়?
কিন্তু গোলডা নিজেও তো বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল, তাই না? জিজ্ঞেস করলেন কাউন্ট।
স্বেচ্ছায়, কেউ যাতে তাকে সন্দেহ না করতে পারে। তবে অ্যাকোনাইট নয়, হালকা কিছু। আপনাদের মনে আছে, সেই রাতে গোলডা আমাকে ইভনিং স্টার টুর করতে পাঠালেন, সী-সিকনেসে কে কে অসুস্থ হয়ে পড়েছে জানার জন্যে? আসলে উনি জানতে চাইছিলেন ভুল করে কাকে বা কাঁদেরকে তিনি বিষ খাইয়ে ফেলেছেন। কেডিপাস মারা গেছে শুনে অস্বাভাবিক রেগে যান তিনি, কিন্তু তখন তাঁর এই প্রতিক্রিয়ার অর্থ আমি বুঝতে পারিনি।
সেই রাতে আরও একটা ঘটনা ঘটে। চেক করার জন্যে দুজন লোক ঢোকে আমার কেবিনে। একজন হয় ফার্গুসন বা ব্রাশটম্যান, অপর জন আর্চার। কার্লসনের দিকে তাকাল রানা। সে আপনার লোক ছিল, তাই না?
নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালেন কার্লসন।
কার্লসনের সন্দেহ হয় আমাকে। আমার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যে আর্চারকে দিয়ে কেবিনটা চেক করান। সন্দেহ হয় গোলডারও, তাঁর ভাড়া করা এক লোক জানতে পারে অ্যাকোনাইট সম্পর্কে একটা আর্টিকেল পড়ছি আমি। কাজেই এরপর তিনি আমাকেও সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন-স্কচের বোতলে বিষ মিশিয়ে। আর্চারের দুর্ভাগ্য, আমার মেডিকেল ব্যাগে হাত দেয়া যায়। কিনা দেখতে এসে ওই বোতল থেকে খানিকটা স্কচ খেয়ে ফেলে সে।
বাকি মৃত্যুগুলো ব্যাখ্যা করা সহজ। সবাই মি. ওয়েনকে খুঁজছে, এই সময় ফাগুসন আর ব্রাটম্যান মি. ট্যাকারকে খুন করে। তাদের দ্বারাই আহত হয় মি. হুপার, উদ্দেশ্য ছিল ট্যাকার-হত্যার দায়ে তাকে ফাঁসানো। গোলডা নিজেই তাঁর মেয়েকে মেরে ফেলার আয়োজন করেন। তিনি ফাগুসনকে নিয়ে পাহারায় ছিলেন, খুনটা নিশ্চয়ই ওই সময় ঘটেছে। গোলডার দিকে তাকাল রানা। মোনাকার জানালাটা আপনার চেক করা উচিত ছিল। আমি ওটা স্ক্রু দিয়ে বন্ধ করে রাখি, বাইরে থেকে কেউ যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে। আরও একটা তথ্য-আমার মেডিকেল ব্যাগ থেকে এক ফাঁইল মরফিন ও একটা হাইপডারমিক চুরি গেছে। এ-সব অভিযোগ আপনার স্বীকার করার দরকার নেই, ফাগুসন আর ব্রাখটম্যানই তোতাপাখির মত সব ফাস করে দেবে।
সবই আমি স্বীকার করছি, ফন গোলডা কথা বলছেন আশ্চর্য শান্ত গলায়। আপনার প্রতিটি বর্ণনা সত্যি। তবে আপনার তাতে কোন লাভ হবে বলে মনে করি না। হঠাৎ তার হাতে একটা কালো অটোমেটিক বেরিয়ে এল।
সব অপরাধ স্বীকার করার পর ভাবছেন হাতের ওই অস্ত্র আপনাকে রক্ষা করতে পারবে? রানা দাঁড়িয়ে আছে কনিং-টাওয়ার হ্যাঁচওয়ের সরাসরি নিচে। সাবমেরিনে আসার খানিক পর থেকে ইচ্ছে করেই এখানে পজিশন নিয়েছে ও। ও যা দেখতে পাচ্ছে গোলডা তা দেখতে পাচ্ছেন না। ইভনিং স্টারের কথা ভাবুন, গোলডা। ওটা এখন কোথায় বলুন তো?
কি বলতে চান? ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে কোনই লাভ নেই! ফন গোলডার আঙুল ট্রিগারের ওপর চেপে বসছে।
ইভনিং স্টার টুনহেইম পর্যন্ত গেছে, তারপর আর এগোয়নি। ওখানে আমার লোকজন আছে, গোলডা। আমার মেসেজ পাবার অপেক্ষায় আছে তারা। এ-কথা সত্যি ইভনিং স্টারের রিসিভার আপনি নষ্ট করে ফেলায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব নয়, কিন্তু এখান থেকে চলে যাবার আগে ইভনিং স্টারে আমি একটা রেডিও ডিভাইস তুলে দিয়েছি। ওটাকে আপনি একটা রেডিও হোমার বলতে পারেন। রেডিও ট্রান্সমিটার থেকে ওটায় রেডিও সিগন্যাল পাঠানো যায়। ট্রান্সমিটারটা চালু করা হয়েছে এখন থেকে প্রায় নব্বই মিনিট আগে। রেডিও সিগন্যাল পাওয়া মাত্র কি করতে হবে জানা আছে আমার লোকজনদের। ইভনিং স্টারে এই মুহূর্তে নরওয়ে, ব্রিটেন ও বাংলাদেশের সশস্ত্র লোকজন রয়েছে। বেশিরভাগই সেনাবাহিনীর লোক। প্লীজ, আমার কথা বিশ্বাস করুন। তা হলে শুধু শুধু রক্ত ঝরবে।
রানার কথা বিশ্বাস করলেন না গোলডা। দ্রুত সামনে বাড়লেন তিনি, মুখ। তুলে কনিং-টাওয়ারের দিকে তাকালেন, একই সঙ্গে হাতের অস্ত্রটা তুলছেন। দাঁড়িয়ে আছেন উজ্জ্বল আলোয়, তাকিয়ে আছেন অন্ধকারে। বদ্ধ জায়গার ভেতর গুলির শব্দটা হলো কান ফাটানো। গুলির আওয়াজ আর তার চিৎকার প্রায় একই সঙ্গে শোনা গেল। হাতের অস্ত্রটা সোনার বারের ওপর পড়ায় ধাতব একটা শব্দও কানে এল।
দুঃখিত, বলল রানা। আপনি আমাকে বলার সুযোগও দিলেন না যে ওরা সবাই বাছাই করা সৈনিক।
নকল সাবমেরিনে চারজন লোক উঠে এল। দুজনের পরনে সাদা পোশাক, বাকি দুজন পরে আছেন নরওয়েজিয়ান আর্মি ইউনিফর্ম। সিভিলিয়ানদের একজন। রানাকে বললেন, মি. রানা? মাথা ঝাঁকাল রানা। আমি ইন্সপেক্টর রবার্টসন, আর
ইনি ইন্সপেক্টর সোরেনসন। দেখে মনে হচ্ছে ঠিক সময়েই পৌঁছেছি আমরা।
হ্যাঁ, ধন্যবাদ।
আমরা এখানে পৌঁছেছি বেশ অনেকক্ষণ আগেই। আমরা আপনাকে সাবমেরিনে উঠতেও দেখেছি। উত্তর মাকেল থেকে রাবার ডিঙ্গি নিয়ে তীরে আসি আমরা। ক্যাপটেন ডানহিল রাতের অন্ধকারে সোর-হামনায় আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। উনি বোধহয় চোখে ভাল দেখেন না।
তবে আমি দেখি! ওপর থেকে ভেসে এল কর্কশ গলাটা। হাতের অস্ত্র ফেলে দিন! ফেলে দিন, তা না হলে আপনাকে আমি খুন করব! ব্ৰাখটম্যানের উচ্চারণে অবিশ্বাসের কোন অভাব নেই। অস্ত্র দেখা যাচ্ছে মাত্র একজনের হাতে, যে সৈনিকটি গোলডাকে গুলি করেছে। নরওয়েজিয়ান ইন্সপেক্টরদের একজন। তীক্ষ্ণকণ্ঠে নির্দেশ দিতেই হাতের অস্ত্র ফেলে দিল সে। খোলের ভেতর নেমে এল ব্ৰাখটম্যান, চোখে সতর্ক দৃষ্টি, তার হাতের অস্ত্র নিঃশব্দে অর্ধবৃত্ত তৈরি করছে।
সাবাস, ব্রাখটম্যান, সাবাস! ভাঙা কব্জির ব্যথা ভুলে প্রশংসা করলেন ফন গোলডা। তার হাত থেকে এখনও রক্ত ঝরে পড়ছে সোনার বারে।
তারমানে আপনি আরও একটা মৃত্যুর দায়িত্ব নিতে চান? জিজ্ঞেস করল রানা।
চুপ, একদম চুপ! পরিস্থিতি উল্টে গেছে… |
পরিস্থিতি উল্টে গেছে? এমন বোকা লোক তো দেখিনি! ভেবেছেন আমি জানি না ব্রাখটম্যান অচল নয়? আমার ডিগ্রী নেই, তবে ট্রেনিং নিয়ে কিছু কিছু ডাক্তারী ব্যাপার আমাকে শিখতে হয়েছে বৈকি, তা না হলে এখানে আমাকে ডাক্তার হিসেবে পাঠানো হবে কেন? মোটা লেদার বুট ছিল ব্রাখটম্যানের পায়ে। বুট পরা অবস্থায় যেভাবেই আহত হোক, কারও গোড়ালির চামড়া উঠে যাবে না। হ্যাঁ, হাড় ভাঙতে পারে; হাড়ে ফাটলও ধরতে পারে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি। তারমানে গোড়ালির চামড়া ইচ্ছে করে নিজেই উঠিয়েছে সে। ট্যাকারকে খুন করার সময় ভুল করেছিল, মি, ওয়েনকে খুন করার সময়ও ভুল করে। কি, ব্ৰাখটম্যান, অভিযোগটা তুমি অস্বীকার করবে?
না, বলে ব্রাশটম্যান তার হাতের অস্ত্র রানার দিকে তাক করল। মানুষ খুন। করে আমি আনন্দ পাই।
ওটা ফেলে দাও হে, তা না হলে মরবে।
রানাকে গাল দিল ব্রাখটম্যান, তবে ট্রিগার টেনে ধরার সময় পেল না। তার কপালে লাল একটা টিপ জুটল। বেরেটা ধরা হাতটা নিচু করলেন কাউন্ট, মাজল থেকে এখনও কালো ধোয়া বেরুচ্ছে। রানার দিকে ফিরে ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বললেন তিনি, কি, আপনাকে বলিনি, আমি একজন পোলিশ কাউন্ট? তবে অনেক দিন চর্চা নেই তো, জায়গামত লাগাতে পারি না।
হ্যাঁ, বলল রানা, দেখতে পাচ্ছি। লাগাতে চেয়েছিলেন হাতে, লাগল গিয়ে কপালে। তবে আমার ধারণা এই কাজটার পুরস্কার বাবদ রাজকীয় ক্ষমা অবশ্যই আপনি পাবেন।
.
জেটিতে পৌঁছে পুলিশ ইন্সপেক্টররা বিশপ, কার্লসন, এমনকি আহত গোলডার হাতেও হাতকড়া পরাতে চাইলেন। রানা তাদেরকে বোঝাল, কাউন্টকে এখন আর বিপজ্জনক বলে মনে করার দরকার নেই। কার্লসনের সঙ্গে কথা বলার অজুহাতে বাকি সবাইকে কেবিনের দিকে পাঠিয়ে দিল ও।
সবাই চলে যাবার পর কার্লসনকে বলল, হারবারের পানি ফ্রিজিং পয়েন্টের কাছাকাছি। হাতে হাতকড়া, গায়ে এত সব গরম কাপড়, পানিতে পড়লে ত্রিশ সেকেণ্ডের মধ্যে মারা যাবেন। কার্লসনের বাহু ধরে জেটির শেষ মাথায় নিয়ে এল রানা।
ব্রাখটম্যানকে আপনি ইচ্ছা করে মারলেন, তাই না? খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন কার্লসন।
অবশ্যই। আপনি তো জানেনই, ইংল্যাণ্ডে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে ও-সব আইন অচল। গুডবাই, কার্লসন।
যীশুর কিরে! মেরির কিরে! ঈশ্বরের দোহাই! প্রায় চিৎকার করছেন কার্লসন। আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, এলিনার মা-বাবাকে ছেড়ে দেব…
আপনি নিজের কথা ভাবুন, কার্লসন। সারা জীবন জেলে পচবেন? তারচেয়ে কি ভাল নয় এটা?
হ্যাঁ। থরথর করে কাঁপছেন কার্লসন, কারণটা ঠাণ্ডা বাতাস নয়। হ্যাঁ।
.
কেবিনের পরিবেশ সম্পূর্ণ শান্ত। জানা কথা সবাই পরম স্বস্তিবোধ করছে। রানা। ফেরার আগেই ইন্সপেক্টর রবার্টসন পরিস্থিতির একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন সবাইকে।
ফার্গুসন মেঝেতে পড়ে আছে, ডান হাত দিয়ে ধরে রয়েছে বাম কাধ, ব্যথায় কাতরাচ্ছে। হিউমের দিকে তাকাল রানা, হিউম তাকাল ফার্গুসনের দিকে। আপনার কথামতই কাজ করেছি। কিন্তু বোতলটা ভেঙে গেছে।
দুঃখিত, বলল রানা, মানে স্কচটুকুর জন্যে। পামেলার দিকে তাকাল ও, ফেঁপাচ্ছে সে; তার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে এলিনা, ওর চোখেও চিকচিক করছে পানি। কাঁদে না, মেয়েরা। বিপদ কেটে গেছে।
মি. মুর মারা গেছেন। পামেলা মুখ তুলে তাকাল, চশমার ভেতর লাল চোখ। দুটো ভেজা। পাঁচ মিনিট আগে।
জক মুরের জন্যে কেউ চোখের পানি ফেলবেন না। আমার কথা নয়, তার নিজের। তবু আমরা দুঃখিত।
মারা যাবার আগে মি. মুর একটা কথা বলে গেছেন, বলল পামেলা। বললেন: দয়ালু হিলারকে বলবেন…হিলার মানে নিশ্চয়ই আপনি?
রানা চুপ করে থাকল।
হিলারকে বলতে বলেছেন, তাঁর হয়ে হিলার যেন সবাইকে কোন একটা বারে স্কচ খাওয়ান।
খাওয়াব, তাঁর শেষ অনুরোধ আমাকে রক্ষা করতে হবে।
ইন্সপেক্টর সোরেনসন ঢুকলেন কেবিনে। স্যার, মি. রানা, ইভনিং স্টার। থেকে এক বাংলাদেশী মেজর রেডিওতে জানতে চাইছেন গহনাগুলোর খোঁজ পাওয়া গেছে কিনা। যদি পাওয়া গিয়ে থাকে, ইভনিং স্টারে ওগুলো লোড করার জন্যে তিনি তার লোকজনদের নিয়ে সকালে সোর-হামনায় চলে আসবেন কিনা।
হ্যাঁ, তাকে জানিয়ে দিন সকালে ওদেরকে আমি এখানে আশা করব।
.
🔺 সমাপ্ত 🔻
COMMENTS