সাজ্জাদ হোসেন অফিসের টেবিলেই মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করছেন। গত রাতে এক ফোঁটাও ঘুমোন নি। দিনের বেলায়ও ঘন্টাখানেকের মতো শোবার সময় পা
চতুর্থ এবং শেষ পর্ব
মিসির আলি সমগ্র থেকে
#নিশীথিনী -হুমায়ূন আহমেদ
( দেবী এর ২য় অংশ )
-
🔴 পনেরো 🔴
-
রাত আটটা।
সাজ্জাদ হোসেন অফিসের টেবিলেই মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করছেন। গত রাতে এক ফোঁটাও ঘুমোন নি। দিনের বেলায়ও ঘন্টাখানেকের মতো শোবার সময় পাওয়া যায় নি এবং খুব সম্ভব আজ রাতটাও তাঁর জেগেই কাটবে। লোহার রড হাতের সেই নগ্নগাত্ৰ আগন্তক তাঁর সর্বনাশ করে দিয়েছে। পুলিশবাহিনীর নাকের ডগায় আরেকটি খুন হয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
একটি লোক রোজ রাতে লোহার রড হাতে একই জায়গায় ঘোরাঘুরি করবে, অথচ তাকে ধরা যাবে না–এটা কেমন কথা!
স্যার, আপনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান।
সাজ্জাদ হোসেন টেবিল থেকে মাথা তুললেন। এই লোকটির কি কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? তাকে বলে দিয়ে এসেছেন, যেন কিছুতেই আগামী দু ঘন্টার মধ্যে তাঁকে ডাকা না হয়। অথচ দশ মিনিট পার না-হতেই ব্যাটা ডাকতে এসেছে। তিনি বরফশীতল গলায় বললেন, বল আমি নেই।
স্যার, আমি বলেছি যে আপনি আছেন। তাতে অসুবিধা নেই। এখন গিয়ে বল যে, আমার আগের কথাটা ঠিক না। উনি আসলে নেই, কোথায় গিয়েছেন কেউ জানে না।
স্যার, উনি এক জন সাংবাদিক। পত্রিকা অফিস থেকে এসেছেন।
সাজ্জাদ হোসেন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। সাংবাদিকদের বিরাগভাজন হবার মতো সাহস তাঁর নেই। পত্রিকায় দীর্ঘ আর্টিকেল বের হয়ে যাবে–পুলিশ অফিসারের দুর্ব্যবহার।
আসতে বল, আর শোন–দু কাপ চা দিতে বল।
সাংবাদিক ভদ্রলোকের নাম মীরউদ্দিন। ভদ্রলোক শুধু যে পেশায় সাংবাদিক তাই নয়।–চেহারায়, পোশাকে, এমনকি হাবেভাবেও সাংবাদিক। প্রশ্নের ধরন ডিটেকটিভের মতো। প্রতিটি বাক্যের শেষে একটি খোঁচা আছে, যা ঠিক সহ্য করা মুশকিল। সাংবাদিক, কাজেই সহ্য করতে হবে এবং কিছুতেই চটানো যাবে না। মীরউদ্দিনের কাছ থেকে জানা গেল যে, একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা নগ্নগাত্র বিভীষিকা–এই শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনী ছাপবে। কাজেই পুলিশের বক্তব্যটি শোনবার জন্যে তিনি দয়া করে এখানে তশরিফ রেখেছেন।
আমার প্রশ্নের জবাব দিতে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?
না, নেই। প্রশ্ন করুন।
নগ্নগাত্র ব্যক্তিটি প্রসঙ্গে আপনার কী ধারণা?
তেমন কোনো ধারণা নেই। পাগল-টাগল হবে। আর কি।
তাকে পাগল বলার পেছনে আপনার যুক্তি কী?
একটাই যুক্তি—কোনো সুস্থ মাথার লোক একটা লোহার রড নিয়ে খুনখারাবি করে বেড়ায় না।
কেন, সুস্থ লোকও তো খুনখারাবি করে।
তা করে, কিন্তু তার পেছনে কোনো মোটিভ থাকে। এর কাণ্ডকারখানার পেছনে কোনো মোটিভ নেই।
বুঝলেন কি করে, মোটিভ নেই? হয়তো মোটিত আছে, আপনারা ধরতে পারছেন না।
সাজ্জাদ হোসেনের বিরক্তির সীমা রইল না। এ তো মহা ত্যাঁদড়ের পাল্লায় পড়া গেল! জ্বালিয়ে মারবে মনে হচ্ছে।
নগ্নগাত্রকে নিয়ে পুরানা পল্টন এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা কি আপনি জানেন?
না, জানি না। কী গুজব?
সেটা আপনি নিজেই কষ্ট করে জেনে নেবেন। কারণ পুলিশের উচিত শহরের চালু গুজবগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা। কি, উচিত না?
সাজ্জাদ হোসেন জবাব দিলেন না। এই লোকের সঙ্গে কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো।
এখন আপনি দয়া করে বলুন, লোকটিকে ধরবার ব্যাপারে পুলিশবাহিনী কি চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থতার পরিচয় দেয় নি?
না। ধরবার চেষ্টা হচ্ছে, শিগগিরই ধরা পড়বে। হয়তো আজ রাতেই ধরা পড়বে।
আচ্ছা, বিদেশে অপরাধীকে ধরবার জন্যে ট্ৰেইন্ড পুলিশ-কুকুর আছে, এরা গন্ধ শুঁকে—শুঁকে অপরাধীকে বের করে ফেলে। এখানে এমন কিছু নেই?
না, নেই। কারণ এটা বিদেশ নয়, বাংলাদেশ।
কিন্তু বাংলাদেশে তো পুলিশবাহিনীর একটা মাউন্টেড রেজিমেন্ট আছে। যার প্রতিটি ঘোড়া লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ করে কেনা। অপ্রয়োজনীয় ঘোড়ার পেছনে এত টাকা খরচ না করে দু-একটা শিক্ষিত কুকুর কি কেনা যায় না?
আমাকে এ সব বলছেন কেন তাই? আমি সামান্য ব্যক্তি। এ সব কর্তাব্যক্তিদের বলেন।
আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। উচিত কি উচিত না।
উচিত তো বটেই।
সাজ্জাদ হোসেন উঠে পড়লেন। শুকনো গলায় বললেন, আমার ডিউটি আছে। আর থাকতে পারছি না। এই সাংবাদিকের সঙ্গে আরো কিছু সময় কাটালে প্যাঁচে পড়ে যেতে হবে। চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। আজকের ইন্টারভ্যু দিয়েই তাঁর ভয়ভয় লাগছে, না-জানি কী ছাপা হয়! তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। চাকরি বাঁচিয়ে চলা ক্রমেই মুশকিল হয়ে পড়ছে।
সাজ্জাদ হোসেন জীপ নিয়ে খানিকক্ষণ একা-একা পুরানা পন্টন এলাকায় ঘুরলেন। তারপর খুঁজে বের করলেন মিসির আলির বাড়ি।
এটা সেই বাড়ি, যা নগ্নগাত্ৰ এসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। তাঁর জানা ছিল না। মিসির আলির সঙ্গে এর পরেও তাঁর দেখা হয়েছে, কিন্তু মিসির আলি এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেন নি। যেন এটা বলার মতো কোনো ব্যাপার নয়। অথচ মিসির আলিকে দুতিন বার স্টেটমেন্ট দিতে হয়েছে। এক জন ইনভেসটিগেটিং অফিসার এসে সব দেখেশুনে গিয়েছে। যথেষ্ট হৈচৈ করা হয়েছে এটা নিয়ে। অন্য যে-কেউ হলে প্রথম সুযোগেই ঘটনাটা বন্ধুবান্ধবদের বলতো। মিসির আলি বলেন নি। লোকটি কি ইচ্ছে করেই নিজেকে আলাদা প্ৰমাণ করবার জন্যে এ-রকম করে?
সাজ্জাদ হোসেন কড়া নাড়লেন। মিসির আলি ঘরেই ছিলেন। তিনি দরজা খুললেন। সাজ্জাদ হোসেনকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, তিনি যেন বন্ধুর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
সাজ্জাদ হোসেন বললেন, খবর কি তোর?
ভালো।
খোঁজ নিতে এলাম টিকে আছিস, না নগ্নগাত্র এসে তোকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিয়ে গেছে।
না, এখনো বানায় নি।
তোর ইমার পাত্তা এখনো লাগাতে পারি নি। পারলেই জানাবো।
পারায় সম্ভাবনা কী রকম?
কম। খুবই কম। ঠাণ্ড পানি খাওয়াতে পারবি? খুব ঠাণ্ডা।
ঠাণ্ডা পানি হবে না। ঘরে ফ্ৰীজ নেই।
বাড়িওয়ালার ঘরে নিশ্চয়ই আছে। তোর ইমাকে পাঠিয়ে দে না, নিয়ে আসুক। ঠান্ডা পানি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে!
মিসির আলি ইমাকে পাঠালেন না। নিজেই ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে এলেন। সাজ্জাদ হোসেন টেবিলে পা তুলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। দেখলেই মায়া লাগে। লোকটির ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, চা খাবি?
না। তোর সোফায় ঘন্টাখানিক শুয়ে থাকব।
সোফায় কেন? বিছানায় শুয়ে থাক।
সোফা হলেই চলবে, বিছানা লাগবে না। তুই কাঁটায়—কাঁটায় এক ঘন্টা পরে ডেকে তুলবি।
ঠিক আছে, তুলবো।
সাজ্জাদ হোসেন সোফায় লম্বা হলেন এবং দেখতে- দেখতে ঘুমিয়ে পড়লেন। তবে তাঁকে ডেকে তুলতে হল না। ঠিক এক ঘন্টা পরে নিজে নিজেই জেগে উঠলেন। প্রাণী হিসেবে মানুষের তুলনা নেই। তার অবচেতন মন সর্বক্ষণ কাজ করে। যথাসময়ে তাকে সজাগ করে দেয়। বিপদের আভাস দিতে চেষ্টা করে। মুশকিল হচ্ছে, তার কর্মপদ্ধতি আমাদের জানা নেই।
সাজ্জাদ হোসেন বললেন, এক কাপ চা খাব। তারপর যাব। আজ সারারাত ডিউটি। যেভাবেই হোক, আজ নগ্নগাত্রকে ধরবোই।
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ম্যানিয়াকদের ধরা খুব মুশকিল। এদের ইন্দ্ৰিয় খুব সজাগ থাকে।
সজাগ থাকুক আর যা-ই থাকুক, ব্যাটাকে আজ ধরবোই।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দেশ খোদ ইংল্যান্ডেও কিন্তু কিছু-কিছু ম্যানিয়াকদেরকে ধরতে তিন-চার বছর সময় লেগেছে। এক জনের নাম তুই নিশ্চয়ই জানিস—রোডসাইড স্ট্রাংগলার। বেছে বেছে ব্লন্ড মেয়েদের খুন করতো। সাড়ে ছ বছর চেষ্টা করেও কিন্তু ওকে ধরা যায় নি।
আমি ধরবো। আজ রাতেই ধরবো।
মিসির আলি চুপ করে গেলেন। সাজ্জাদ হোসেন বললেন, উঠি?
চা না খাবি বললি?
মত বদলেছি, খাব না।
মিসির আলি বললেন, আমি কি তোর সঙ্গে যেতে পারি?
আমার সঙ্গে যাবি? কেন?
আমি ধানমণ্ডির একটা বাড়িতে ঢুকতে চাই। ওরা ঢুকতে দিচ্ছে না। গেট বন্ধ করে রাখছে এবং বলছে বাড়িতে কেউ নেই। কিন্তু আমি জানি, বাড়িতে লোকজন আছে। পুলিশের গাড়িতে করে গেলে দারোয়ান ভয় পেয়ে গেট খুলবে।
আজ রাতেই যেতে হবে?
হুঁ।
তোকে ঢুকতে দিচ্ছে না কেন?
আছে, অনেক ব্যাপার আছে, পরে বলবো। আমাকে ও-বাড়িতে নামিয়ে দিতে তোর অসুবিধা আছে? অসুবিধা থাকলে থাক।
না, অসুবিধা নেই।
.
🔴 ষোলো 🔴
.
রাত সাড়ে দশটার মতো বাজে।
দারোয়ান জেগেই ছিল। মিসির আলি যা ভেবেছিলেন, তা-ই হল। পুলিশ এসেছে শুনে সে গেট খুললো। মিসির আলি ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
ওসমান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই দোতলার বারান্দা থেকে দেখলেন, মিসির আলি গেট দিয়ে ঢুকছেন এবং বেশ সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে আসছেন। ওসমান সাহেব নিচে নেমে এলেন। মিসির আলি বললেন, আপনি ভালো আছেন?
ওসমান সাহেব সে প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তার মতো করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
মিসির আলি বললেন, অসময়ে এসেছি। উপায় ছিল না বলেই আসতে হয়েছে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই।
.
ওসমান সাহেবের বসার ঘর। রাত প্ৰায় এগারটা একটি কম পাওয়ারের টেবিলল্যাম্প ছাড়া ঘরে কোনো আলো নেই। আবছা অন্ধকার। এই আবছা অন্ধকার ঘরে তিন জন মানুষ মুখোমুখি বসে ছিলেন। এক জন উঠে চলে গেলেন। ফরিদা। তিনি নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। যে আলোচনা চলছিল, তা তাঁর সহ্য না হওয়ায় উঠে গেছেন। এখন বসে। আছেন দু জন–মিসির আলি এবং ওসমান সাহেব। কথাবার্তা এখন বিশেষ হচ্ছে না। ওসমান সাহেবের যা বলার তা বলেছেন। এখন আর তাঁর কিছু বলার নেই। তিনি বসে আছেন মূর্তির মতো। দেখে মনে হচ্ছে, তাঁর মধ্যে জীবনের ক্ষীণতম স্পর্শও নেই। যেন এক জন মরা মানুষ।
মিসির আলি বললেন, আপনি বলছেন, ফিরোজকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন?
হ্যাঁ।
কবে থেকে?
আজ নিয়ে ছয় দিন।
এটা তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ এই ছয় দিনে বেশ কবার সে বের হয়ে গেছে। পুরানা পল্টন এলাকায় তাকে দেখা গেছে। পত্রিকায় নিউজ হয়েছে।
ওসমান সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, কী ভাবে কী হচ্ছে আমি জানি না। আমি যা করেছি, সেটা বললাম। তালা দেয়া আছে। আপনি নিজে গিয়ে দেখতে পারেন।
সেই তালার চাবি কার কাছে? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি, অন্য কেউ তালা খুলে দিতে পারে কি না।
না, পারে না। কারণ চাবি আমার কাছে।
অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন তালাবন্ধ করে রাখা সত্ত্বেও সে বের হয়ে পড়ছে?
আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। আপনার যা ইচ্ছা মনে করতে পারেন।
মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি কোনো আধিভৌতিক ব্যাপারে বিশ্বাস করি না। এক জনকে তালাবন্ধ করে রাখা হবে, কিন্তু তবু সে বের হয়ে যাবে–এটা আর যে-ই বিশ্বাস করুক, আমি করবো না।
বিশ্বাস করতে আমি আপনাকে বলছি না। আপনি নিজে গিয়ে দেখুন। সেটা না করে আপনি একই কথা বারবার আমাকে বলছেন কেন?
সেটা বলছি, কারণ আমি আগে সমস্ত ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা করতে চাই ওসমান সাহেব, আমি-আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই, আমি এই ছেলেটিকে সুস্থ করে তুলতে চাই। আপনি আমাকে শত্রুপক্ষ মনে করছেন, এটা ঠিক না। আমার কোনো পক্ষ নেই। আমি এক জন চিকিৎসক।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন এবং সহজ স্বরে বললেন, চলুন, ফিরোজের ঘরটা দেখে আসি।
আপনি একাই যান, আমি যাব না।
আপনি যাবেন না কেন?
আমার সহ্য হয় না। আমি নিজেও পাগল হয়ে যাব।
মিসির আলি একই রওনা হলেন।
ফিরোজের ঘর নিঃশব্দ। সে এই গরমেও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিসির আলি চমকে উঠলেন। মুখভর্তি খোঁচা-খোচা দাড়ি-গোঁফ। গালের হনু উচু হয়ে আছে। সেই উজ্জ্বল গৌরবর্ণের কিছুই নেই, কেমন কালি মেরে গেছে। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, ফিরোজের হাতের নখ বড় বড় হয়েছে। নখের নিচে ময়লা জমে দেখাচ্ছে শকুনের নখের মতো। ঘুমের মধ্যেই ফিরোজ পাশ ফিরলো। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, সে হা করে ঘুমাচ্ছে এবং মুখ দিয়ে লালা পড়ে বিছানার একটা বেশ বড় অংশ চটচটে হয়ে আছে। কুৎসিত একটা দৃশ্য!
ঘরের একটিমাত্র দরজা, সেখানে সত্যি-সত্যি বিরাট একটা তালা ঝুলছে। দু দিকে দুটি বিশাল জানোলা। জানালায় লোহার গ্রিল। সেই গ্রিল ভেঙে বের হওয়া অসম্ভব। সুস্থ মানুষ দূরের কথা, এক জল পাগলও সেই চেষ্টা করবে না।
মিসির আলি বসার ঘরে ফিরে এলেন। ওসমান সাহেব বললেন, ঘর যে বন্ধ, এটা আপনার বিশ্বাস হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে।
এখন বলুন সে কীভাবে বের হয়?
ফিরোজের ঘরের সঙ্গে একটা এ্যাটাচড বাথরুম আছে। বাথরুমের ভেতরটা আমি দেখতে পাই নি। তবে আমার ধারণা, বাথরুমে বেশ বড় একটি ভেন্টিলেটার আছে, এবং ফিরোজ সেই ভেন্টিলেটার দিয়ে বের হয়।
ওসমান সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। সিগারেট ধরালেন। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, সিগারেট ধরাতে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপছে। মিসির আলি বললেন, এক্ষুণি আপনি ভেন্টিলেটার বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন। আজ রাতে যেন সে বের হতে না পারে।
হ্যাঁ, করছি।
আমি এখন চলে যাব। কিন্তু কাল ভোরে আবার আসব। আপনার দারোয়ানকে বলে দিন, যাতে সে আমাকে ঢুকতে দেয়।
হ্যাঁ, আমি বলবো। মিসির আলি সাহেব।
বলুন আমার ছেলে কি কোনোদিন সুস্থ হয়ে উঠবে?
নিশ্চয়ই হবে। হতেই হবে।
এত রাতে আপনি বাড়ি গিয়ে কি করবেন? থেকে যান এখানে।
না, থাকতে পারব না। আমার সঙ্গে একটা ছোট মেয়ে থাকে, সে একা ভয় পাবে। আপনি দেরি না করে ভেন্টিলেটারটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন।
করছি। এক্ষুণি করছি।
ফরিদা ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে খুব উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত মনে হল। তাঁর কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম, এবং তিনি কাপছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। ফরিদা থেমে বললেন, মিসির আলি সাহেব, ফিরোজ জেগেছে। আপনাকে ডাকছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
.
কেমন আছ ফিরোজ?
ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
মিসির আলি চমকে উঠলেন। ভারি গম্ভীর গলায় কথা বলছে ফিরোজ। চোখে-মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি। সে পায়ের ওপর পা তুলে চেয়ারে বসে আছে।
তুই তুই করে বলছি বলে রাগ করছিস না তো? তুই তো আবার প্রফেসর মানুষ।
রাগ করছি না, তবে দুঃখিত হচ্ছি। সবাইকে সবার প্রাপ্য সম্মান দেয়া উচিত।
তা উচিত। কিন্তু মুশকিল কি জানিস, সারা জীবন তুই ছাড়া কোনো সম্বোধন করিনি। আমাকে চিনতে পারছিস তো? তুই তো গিয়েছিলি আমাদের বাড়িতে।
মিসির আলি চুপ করে রইলেন!! যে কথা বলছে, সে ফিরোজ নয়। ফিরোজের দ্বিতীয় সত্তা। সেকেন্ড পার্সোনালিটি।
কি রে, চুপ করে আছিস কেন? ভয় পাচ্ছিস? হা হা হা!
না, ভয় পাচ্ছি না।
খাঁচায় আটকে রেখেছিস, ভয় পাবি কেন? ছেড়ে দে, তারপর দেখি তোর কত সাহস!
আমার সাহস কম।
এই তো একটা সত্যি কথা বললি। হ্যাঁ, তোর সাহস কম–তবে তোর বুদ্ধি আছে। মাথা খুব পরিষ্কার। বোকা বন্ধুর চেয়ে বুদ্ধিমান শত্রু ভালো।
আমি কারো শত্ৰু নাই।
বাজে কথা বলিস না। তুই আমার শত্ৰু, মহা শত্রু।
কেমন করে?
তুই ফিরোজকে সারিয়ে তুলতে চাচ্ছিস। ওকে সরিয়ে তুললে আমি যাব কোথায়? ডাণ্ডাপেটা করবো কীভাবে? তুইই বল।
ডান্ডাপেটা করতেই হবে?।
করবো না? বলিস কী তুই! আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, আমি ছেড়ে দেব? পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলবো।
লাভ কী তাতে?
লাভ-লোকসান জানি না। ছোট চৌধুরী লাভ-লোকসানের পরোয়া করে না! তোকে আমি একটা শিক্ষা দেব। এক বাড়ি মেরে টপ করে মাথাটা ফাটিয়ে দেব। গল-গল করে ঘিলু বের হয়ে আসবে। ছিটকে আসবে রক্ত। বড় মজার ব্যাপার হবে। তবে দুই দেখতে পাবি না। আফসোসের কথা।
মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন, এ-বাড়ির প্রায় সবাই এসে জড়ো হয়েছে। চোখ বড় বড় করে শুনছে। এই অস্বাভাবিক কথোপকথন। কাঁদছেন শুধু ফরিদা।
ফিরোজ হিসহিস করে উঠল, কি, চুপ করে আছিস যে? কথা বলছিস না কেন? ভয় পেয়েছিস? ভয় পেয়ে শেষটায় মেয়েমানুষের আঁচল ধরলি? লজ্জা করে না?
কার কথা বলছো?
ওরে হারামির বাচ্চা, তুই জানিস না। কার কথা বলছি? তোর পেয়ারের নীলু বেগম। যার ইয়ে দুটি—। এবং যার ইচ্ছে হচ্ছে—।
কুৎসিত সব কথা। সে একনাগাড়ে বলে যেত লাগলো। কদৰ্য অশ্লীলতা। যা ছাপার অক্ষরে লেখার কোনো উপায় নেই। ফিরোজ যে-সব কথা বলতে লাগল, তার ভগ্নাংশও অশ্লীলতম পর্ণো পত্রিকায় থাকে না। ফরিদা দ্রুত ঘরে চলে গেলেন। কাজের লোকগুলি মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। ওসমান সাহেব ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, শাট আপ।
ফিরোজ হাসিমুখে তাকালো ওসমান সাহেবের দিকে যেন খুব মজার কথা বলছে, এমন ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
আমাকে ইংরেজিতে গাল দিচ্ছিস বাহু, বেশ মজা তো! কাকে তুই ইংরেজিতে গাল দিচ্ছিস? তোর নাড়ি-নক্ষত্র আমি জানি। সালেহা নামের কাজের মেয়েটির সঙ্গে তুই কী করেছিস, বলে দেব? খুব মজা পেয়ে গিয়েছিলি, তাই না? কদিন খুব সুখ করে নিলি! বলবো কী করেছিলি? বলবো? হা হা হা! কি, পালিয়ে যাচ্ছিস কেন? লজ্জা লাগছে? ফূর্তি করার সময় লজ্জা লাগে নি? একটা ঘটনা বরং বলেই ফেলি–।
ওসমান সাহেব বললেন, মিসির আলি সাহেব, আপনি চলে আসুন।
আপনি বসার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি আসছি।
তুই যাচ্ছিস না কেন? কথাগুলো শুনতে মজা লাগছে? তোর ইয়ে— (কিছু কুৎসিত কথা)।
মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, ফিরোজ, চুপ কর।
ঠিক আছে, চুপ করলাম। তুই আজ রাতে কোথায় থাকবি?
বাসাতেই থাকবো।
তাহলে দেখা হবে।
না, দেখা হবে না। বাথরুমের ভেন্টিলেটার বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ফিরোজের কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। তারপর লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করলো। চেয়ার ভাঙলো , লাথির পর লাথি বসাতে লাগলো পালঙ্কে। কাপ-বাটি ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। চোখে দেখা যায় না, এমন ব্যাপার। ভয়াবহ উন্মত্ততা! মনে হয় না এ কোনো দিন শান্ত হবে। মিসির আলি একটি সিগারেট ধরালেন। ফিরোজ চাপা গলায় গর্জন করছে। ক্রুদ্ধ পশুর গর্জন। সমস্ত আবহাওয়াই দূষিত হয়ে গেছে। নরকের একটি ক্ষুদ্র অংশ নেমে এসেছে এখানে।
মিসির আলি দাঁড়িয়ে-থাকা লোকদের বললেন, তোমরা যাও। বারান্দার বাতি নিতিয়ে দাও। ও আপনা-আপনি শান্ত হবে।
.
🔴 সতেরো 🔴
.
নাজনীন একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নটি দেখেছে ছাড়া-ছাড়াভাবে। তবু সব মিলিয়ে একটা অর্থ দাঁড় করানো যায়। এবং অর্থটি ভয়াবহ। নাজনীন দেখেছে–একটা ছোট ঘরের এক প্রান্তে একটি বিছানা। বিছানাটিতে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে এক জন লোক শুয়ে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ আরেক জন লোক ঘরে ঢুকলো। লোকটার হাতে একটা লোহার রড। লোকটি টান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা লোকটির ওপর থেকে চাদর সরিয়ে ফেললো। লোকটির মুখ দেখা যাচ্ছে এবং সেটি একটি পরিচিত মুখ–মিসির আলির মুখ। স্বপ্নের মধ্যেই প্রচণ্ড একটা শব্দ হল, এবং দেখা গেল মিসির আলির মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
নাজনীন জেগে উঠল চিৎকার করে। স্বপ্ন এত ভয়াবহ হয়! নাজনীন বাকি রাতটা আর ঘুমুতে পারলো না। ছ রাকাত নফল নামাজ পড়ল। কোরআন শরিফ পড়লো। মন শান্ত হল না। নাজনীনের মা বললেন একটা ছদকা দিয়ে দিতে। প্ৰাণের বদলে প্ৰাণ। সেই ছদকা তো ভোর না-হবার আগে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই কঠিন। নাজনীন ফুপিয়ে-ফুপিয়ে খানিকক্ষণ কাদলো। সে জানে এটা স্বপ্ন। স্বপ্ন। কখনো সত্যি হয় না। তবু এমন লাগছে কেন?
ভোর হবার সঙ্গে-সঙ্গেই সে একটি টেলিগ্রাম পাঠালো, সাবধান থাকবেন! টেলিগ্রামটি পাঠিয়েই মনে হল, এর অর্থ তো উনি কিছুই বুঝবেন না। তিন ঘন্টা পর দ্বিতীয় একটি টেলিগ্ৰাম করল। এই টেলিগ্রামটি বেশ দীর্ঘ।
চাচা, আপনার সম্বন্ধে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। একটি লোক লোহার রড দিয়ে আপনার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আপনাকে অনুরোধ করছি, সাবধানে থাকবেন।
নাজনীন।
.
*****
.
নিজের মেয়েকে চিনতে না পারার মতো কষ্টের কি কিছু আছে? জাহিদ সাহেব বসেবসে তাই ভাবেন। তাঁর বড় অস্থির লাগে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। এ-রকম হবে কী, জানতেন। দুই মেয়ে বড় হবে–এদের বিয়ে হবে, আলাদা জীবন হবে। তিনি পড়ে থাকবেন একা। এ-অবস্থা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন! পুরোপুরি সে-রকম অবশ্যি হয় নি। এক মেয়ে তাঁর সঙ্গেই আছে। কিন্তু এই মেয়েকে তিনি চেনেন না। এ এক অচেনা নীলু।
আজ দুপুরে খেতে গিয়ে দেখেন, মাংসের ভূনা তরকারি এবং খিচুড়ি করা হয়েছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আজ খিচুড়ি যে!
নীলু বলল, তুমি খেতে চেয়েছিলে, তাই।
জাহিদ সাহেব খেতে চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কাউকে সে-কথা বলেন নি। নীলুর সঙ্গে গতকাল রাত থেকেই তাঁর কোনো কথা হয় নি! অথচ সে ঠিকই জানলো। শুধু আজই নয়, এ-রকম প্রায়ই হয়। বড় অস্বস্তি লাগে। শুধু অস্বস্তি নয়, একটু ভয়ভয়ও করে। একেক রাতে ভয়টা অসম্ভব বেড়ে যায়। কেন বাড়ে, তাও তিনি জানেন না। তাঁর ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যান। যেখানে কেউ তাঁর কোনো খোঁজ পাবে না।
প্রথম এ রকম হল বিলুর বিয়ের চার দিন পর। বিলু নেই। বিয়েবাড়ির আত্মীয়স্বজনরা সব চলে গেছে। বাড়ি একেবারেই খালি। মনটন খারাপ করে জাহিদ সাহেব নিজের ঘর ছেড়ে ঘুমাতে গেলেন নীলুর পাশের ঘরে। এক জন কেউ থাকুক। আশেপাশে, যাতে ডাকলে সাড়া পাওয়া যায়।
অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর ঘুম এল না। সামনের জীবন কেমন কাটবে, তাই নিয়ে ভাবতে লাগলেন। মৃত স্ত্রীর কথা মনে করে খানিকক্ষণ কাঁদলেন। প্রথম জীবনে একটি ছেলে হয়েছিল–দেড় বছর বয়সে মারা যায়। মিষ্টি কথা বলতো। পাখিকে বলত বাকি। ফুলকে বলতো কুল। অনেক দিন পরে মৃত ছেলের কথা মনে করেও চোখ মুছলেন। আর ঠিক তখন এক অদ্ভুত ব্যাপার হল। চাঁপা ফুলের তীব্র গন্ধে অভিভূত হয়ে গেলেন। ব্যাপার কী ফুলের গন্ধ আসছে কোথেকে? তাঁর নিজের এক সময় বিরাট ফুলের বাগান ছিল। সে-সব আর কিছু নেই। বাগান জঙ্গল হয়েছে।
জাহিদ সাহেব অবাক হয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই নূপুরের শব্দ শুনলেন!! খুব হালকা, কিন্তু স্পষ্ট। এর মানে কী? তিনি নীলুর ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য নীলু যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। গভীর রাতে কে এসেছে নীলুর ঘরে? জাহিদ সাহেব ভয়ার্ত গলায় ডাকলেন, নীলু, ও নীলু।
নীলু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দরজা খুললো।
কার সঙ্গে কথা বলছিস?
আছে এক জন। তুমি চিনবে না।
জাহিদ সাহেব ঘরে উঁকি দিলেন। কাউকে দেখতে পেলেন না। নীলু বলল, ঘুমিয়ে পড় বাবা। এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন?
জাহিদ সাহেব বললেন, কী হচ্ছে এ-সব! কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
ও তুমি বুঝবে না বাবা।
বুঝব না মানে? বুঝব না মানে কী?
অনেক কথা বাবা পরে তোমাকে বলবো।
না, এখনি শুনবো।
নীলু বললো, এবং নীলুর কথা তিনি কিছুই বুঝলেন না। একজন- কেউ নীলুর সঙ্গে আছে–যে নীলুকে তার মহাবিপদ থেকে রক্ষা করেছিল। কী অদ্ভুত কথা!
জাহিদ সাহেব দারুণ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে লাগলেন। তাঁর ধারণা হল, নীলুর বড় কোনো অসুখ হয়েছে। তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললেন। দু জন পীরের কাছ থেকে তাবিজ আনালেন। সেইসব তাবিজ পরতে নীলু। কোনো আপত্তি করল না। ডাক্তারদের ঔষুধপত্র খেতেও তার কোনো অনীহা দেখা গেল না। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না এবং হবেও না কোনোদিন। তাঁর বাকি জীবন কাটবে অদ্ভুত এই নীলুকে সঙ্গে নিয়ে– যাকে তিনি চেনেন না, বোঝেন না। যে মনের কথা বুঝে ফেলে। যার ঘরে অপরিচিত এক রমণীকণ্ঠ শোনা যায় এবং দমকা হাওয়ার মতো চাঁপা ফুলের গাঢ় গন্ধ যাকে হঠাৎ ঘিরে ফেলে।
.
আজ বুধবার। আকাশে মেঘ নেই। রৌদ্রোজ্জ্বল একটি সুন্দর সকাল। জাহিদ সাহেব অনেক দিন পর উৎফুল্ল বোধ করলেন। তাঁর মনে হল, দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে। নীলু ভালো হয়ে যাবে। তাঁর চমৎকার একটি বিয়ে হবে। ছেলেপুলে আসবে তাদের সংসারে। সেই সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁর শেষজীবন ভালোই কাটবে। এক জন মানুষ তো সারা জীবন দুঃখী থাকতে পারে না। দুঃসময়ের পর আসে সুসময়। জীবনচক্রের এই এক কঠিন নিয়ম। তবে কারো-কারো ক্ষেত্রে দুঃসময়টা দীর্ঘ হয়, এই যা। যেমন তাঁর হয়েছে।
জাহিদ সাহেব ডাকলেন, নীলু, নীলু। অনেক দিন পরে তাঁর কণ্ঠে আনন্দ ঝরে পড়লো।
নীলু এল না। তিনি উঁকি দিলেন নীলুর ঘরে। তার ঘর অন্ধকার। দরজা জানালা বন্ধ। পর্দা টেনে দেয়া, ঘরের বাতাস ভারি হয়ে আছে।
কী হয়েছে নীলু?
কিছু হয় নি।
এভাবে শুয়ে আছিস কেন? শরীর ভালো না?
তিনি নীলুর কপালে হাত দিলেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। নীলুর চোখ-মুখ রক্তবর্ণ।
তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, কী হয়েছে মা?
কিছু হয় নি।
কিছু হয় নি মানে? তোর গায়ে তো প্রচণ্ড জ্বর। কখন জ্বর এল? ডাক্তার ডাকা দরকার। এক্ষুণি দরকার।
বাবা, এই নিয়ে তুমি ভাববে না। কাউকে ডাকার দরকার নেই।
দরকার নেই, বললেই হল!
বাবা, তোমায় পায়ে পড়ি! আমাকে একা থাকতে দাও। বিরক্ত করো না। ভয় নেই, জ্বর সেরে যাবে।
জাহিদ সাহেব লক্ষ্য করলেন, নীলু কাঁদছে।
মা, কী হয়েছে তোর?
কিচ্ছু হয় নি বাবা। আমি সেরে যাব। আমি আবার আগের মত হব। যে আমার সঙ্গে থাকতো, সে আমাকে বলেছে।
সে কে?
আমি নিজেও জানি না, সে কে এক মহাবিপদে সে আমাকে রক্ষা করেছিল। বাবা, তুমি যাও!
জাহিদ সাহেব মুখ কালো করে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। চমৎকারভাবে যেদিনটি শুরু হয়েছিল, সেটি খানখান হয়ে ভেঙে পড়লো। তিনি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে এক-এক বারান্দায় বসে রইলেন।
.
🔴 আঠারো 🔴
.
বুধবার। সময় সাতটা দশ।
সন্ধ্যার ঠিক পরপর মিসির আলি নিউ ইস্কাটন রোডের যে তিনতলা দালানের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তার নাম–নিকুঞ্জ। লোকজন বিশাল প্রাসাদ তৈরি করে নাম দেয়–কুটির। এ-রকম বাড়ির নাম কেউ কুটির রাখে?
বাড়ির সামনে ফুটবলের মাঠের মতো বড় লন। লনের ঘাস বড়-বড় হয়ে আছে। লনের চারদিকে একসময় ফুলের বাগান ছিল। এখন নেই। শ্বেতপাথরের একটি শিশুমূর্তি (সম্ভবত ফোয়ারা) আছে মাঝখানে, তাতে শ্যাওলা পড়েছে। চারদিকে অবহেলা ও অযত্নের ছাপ।
মিসির আলির মনে হল——এ বাড়ির মালিক দেশে থাকেন না। চাকর বাকরের হাতে বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে তিনি থাকেন বিদেশে। হঠাৎ—হঠাৎ আসেন, আবার চলে যান। মিসির আলি খানিকটা শঙ্কিত বোধ করলেন। বাড়ির মালিক এস. আকন্দ সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়া খুবই জরুরি। কারণ মিসির আলির ছাত্র শেষ পর্যন্ত ইমা নামের একটি মেয়ের খবর পত্রিকায় পেয়েছে। খবরের শিরোনাম–হারিয়ে গেল ইমা। ডল হাতে তিন বছর বয়সী একটি বালিকার ছবি আছে। খবরের সঙ্গে।
মেয়েটি তার বাবা-মা’র সঙ্গে ঢাকা থেকে খুলনা যাচ্ছিল। খুব চঞ্চল মেয়ে। সারাদিন ছোটাছুটি করেছে। স্ট্রীমারে উঠে তার খুব ফূর্তি। এক জন আয়া তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে । বরিশাল থেকে স্টীমার ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই আয়া দেখল, ইমা নেই। সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে এক-একা নিচে নেমে গেছে? সে ছুটে এল নিচে। সেখানেও ইমা নেই। সে কি রেলিং টপকে নদীতে পড়ে গেছে? আয়া ভয়ে-আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গেল। ইমার বাবা-মা তখনো কিছু জানেন না। তাঁরা টেলিস্কোপিক লেন্স লাগিয়ে দূরের একটি মাছধরা নৌকার ছবি তোলার চেষ্টা করছেন।
.
এ জাতীয় বাড়িগুলোতে সাধারণত দারোয়ান এবং কুকুর থাকে। কিন্তু এ-বাড়িতে দুটাের কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না। মিসির আলি অনেকটা দ্বিধা নিয়েই গেটের ভেতর ঢুকলেন। কলিং-বেল থাকার কথা, তাও চোখে পড়ছে না। তবে বাড়িতে লোক আছে। আলো জ্বলছে।
আচ্ছা, এ-রকম হওয়া কি সম্ভব যে, এ-বাড়িতে এস. আকন্দ নামের কেউ থাকেন না। এক কালে ছিলেন, এখন নেই কিংবা খবরের কাগজে যে এস. আকন্দের কথা আছে, ইনি সেই ব্যক্তি নন।
হওয়া অসম্ভব নয়। তবে সাজ্জাদ হোসেন বেশ জোর দিয়েই বলেছেন—এটিই ঠিকানা। খবরের কাগজের কাটিং থেকে ঠিকানা বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সাজ্জাদ হোসেনকে। এটি মনে হচ্ছে তিনি ঠিকই করেছেন।
কলিং-বেল খুঁজে পাওয়া গেল না! মিসির আলি দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজা খুলে গেল প্ৰায় সঙ্গে-সঙ্গেই।
কাকে চান?
এটা কি আকন্দ সাহেবের বাড়ি? এস. আকন্দ?
জ্বি।
উনি কি আছেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
উনি খুবই ব্যস্ত। আজ রাত দুটার ফ্লাইটে লন্ডন চলে যাচ্ছেন। আপনার কী দরকার, বলুন?
আমার খুবই দরকার।
আমাকে বলুন।
আমি তাঁকেই চাই। বেশি সময় লাগবে না। পাঁচ মিনিট সময় নেব।
ঠিক আছে, বসুন, আমি দেখি।
মিসির আলি সাহেব বসার ঘরে একা-একা দীর্ঘ সময় পৰ্যন্ত বসে রইলেন। বসার ঘরটি সুন্দর। অসংখ্য দর্শনীয় জিনিসপত্র দিয়ে জবড়াজং করা হয় নি। ঘাস রঙের একটা কার্পেট, নিচু-নিচু বসার চেয়ার। দেয়ালে একটিমাত্র পেইনটিং—চার-পাঁচ জন গ্রামের ছেলেমেয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতে নেমেছে। অপূর্ব ছবি। ছবিটির জন্যেই বসবার ঘরে একটি মায়া-মায়া ভাব চলে এসেছে। মিসির আলি মনে-মনে ঠিক করলেন, তাঁর কোনো দিন টাকা পয়সা হলে এ-রকম করে একটি ড্রইংরুম সাজাবেন। সে-রকম টাকা পয়সা অবশ্যি তার হবে না। সবার সব জিনিস হয় না।
আপনি কি আমার কাছে এসেছেন? আমি সাবির আকন্দ।
মিসির আলি ভদ্রলোককে দেখলেন। বেশ লম্বা। শ্যামলা গায়ের রঙ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মুখে একটি কঠিন ভাব আছে। তবে চোখ দুটি বড়-বড়, যা মুখের কঠিন দুভাবের সঙ্গে মানাচ্ছে না।
আমি আপনাকে কোনো সময় দিতে পারব না। আমি আজ রাত একটায় চলে যাচ্ছি।
আমি আপনার বেশি সময় নেব না। আপনি পত্রিকার এই কাটিংটি একটু দেখুন।
আকন্দ সাহেব দেখলেন। কাটিংটি ফিরিয়ে দিয়ে মিসির আলির পাশে বসে ক্লান্ত স্বরে বললেন, এটা আপনি আমাকে কেন দেখাচ্ছেন? কিছু-কিছু জিনিস আমি মনে করতে চাই না। এটা হচ্ছে তার একটি।
মিসির আলি বললেন, আমার সঙ্গে একটি মেয়ে থাকে। আমার ধারণা, ও ইমা।
ভদ্রলোক কোনো কথা বললেন না। তাঁর মুখের একটি পেশিও বদলালো না।
আপনার এই মেয়ের কি খুব ছোটবেলায় ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল?
হ্যাঁ, ইংল্যাণ্ডে। ওর বয়স তখন দু বছর। তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি আপনার পরিচয়টি জানতে পারি?
পারেন। আমার নাম মিসির আলি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন পার্ট টাইম শিক্ষক।
আকন্দ সাহেব সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টানতে লাগলেন।
মিসির আলি বললেন, আমি বুঝতে পারছি, ঘটনার আকস্মিকতা আপনাকে কনফিউজ করে ফেলেছে এবং এটা যে আপনারই মেয়ে, তা আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ভদ্রলোক কিছু বললেন না।
মিসির আলি বললেন, একবার এই মেয়েটি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং জ্বরের ঘোরে বলতে থাকে-—মামি ইট হার্টস, মামি ইট হার্টস–তখনই আমার প্রথম মনে হল–।
মিসির আলি কথা বন্ধ করে আকন্দ সাহেবের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের মুখ রক্তশূন্য! মনে হচ্ছে এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। তারপর আনন্দ আর যন্ত্রণা একসঙ্গে মেশান গলায় আকন্দ সাহেব থেমে-থেমে বললেন, খুব ছোটবেলায় হার্টের অসুখে কষ্ট পেত, তখন বলতো, মামি ইট হার্টস। ওর নাভিতে একটি কালো জন্মদাগ আছে?
আমি বলতে পারছি না। তবে এই মেয়ে আপনারই মেয়ে কি না, তা বোঝার একমাত্র উপায় হচ্ছে DNA টেষ্ট। আপনার এবং এই মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করে সেটা বলে দেয়া সম্ভব। এটা একটা অভ্রান্ত পরীক্ষা।
জানি। তার দরকার হবে না। আমি আমার মেয়েকে দেখলেই চিনতে পারবো। আমি কি এখনই যেতে পারি আপনার সঙ্গে?
হ্যাঁ, পারেন।
আমি আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিতে চাই।
নিশ্চয়ই সঙ্গে নেবেন।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর সমস্ত মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। তিনি বললেন, আপনি কী করেন? এই প্রশ্ন আগে একবার করা হয়েছে এবং তার জবাবও দেয়া হয়েছে। তবু মিসির আলি দ্বিতীয় বার জবাব দিলেন।
আকন্দ সাহেব কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, আমার মেয়েটি কী করে আপনার ওখানে।
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ও আছে কাজের মেয়ে হিসেবে। ভাতটাত রেঁধে দেয়। বিনিময়ে খেতে পায় এবং থাকতে পায়।
ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন, যেন তিনি মিসির আলির কথা বুঝতে পারছেন না। তিনি ফিসফিস করে নিজের মনেই কয়েক বার বললেন, কাজের মেয়ে! কাজের মেয়ে!
.
*****
.
বুধবার। সময় রাত আটটা একুশ।
মিসির আলি ভেবেছিলেন পিতা, কন্যা এবং মাতার মিলনদৃশ্যটি চিরদিন মনে রাখার মতো একটি দৃশ্য হবে। কিন্তু বাস্তবে সে-রকম হল না। কোনো হৈচৈ, কোনো কান্নাকাটি–কিছুই না। ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলেন হানিফার দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু ছিল না। হানিফা দেখতে অবিকল তার মার মতো। নাকের ডগায় তার মার মতো একটি তিল পর্যন্ত আছে। ভদ্রলোক বললেন, আমরা তোমার বাবা-মা, তুমি খুব ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিলে। এখন আমরা তোমাকে নিতে এসেছি।
হানিফা ফ্যালফ্যাল করে তাকালো মিসির আলি দিকে। মিসির আলি হাসলেন। সাহস দিতে চেষ্টা করলেন। এ-রকম একটি নাটকীয় মুহূর্তের জন্যে তিনি হানিফাকে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তাকে বলেছিলেন যে, তার বাবা-মার খোঁজ করবার চেষ্টা করা হচ্ছে, এবং খোঁজ পাওয়া যাবে।
ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে হানিফার হাত ধরলেন। মিসির আলি ভেবেছিলেন, এই মহিলাটি হয়তো কিছুটা আবেগ দেখাবেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। হয়তো আবেগকে সংযত করলেন। ভদ্রমহিলার গলার স্বর ভারি মিষ্টি। তিনি মিষ্টি গলায় বললেন, মা, আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখ, আয়নায় তাকিয়ে দেখ–আমি অবিকল তোমার মতো দেখতে।
মিসির আলি ওদের সামনে থেকে সরে গেলেন। বাইরের এক জনের উপস্থিতি হয়তো এদের কাছে ভালো লাগবে না।
তাঁরা চলে গেলেন। পনেরো মিনিটের মধ্যে। যাবার আগে মিসির আলি বললেন, ওর জিনিসপত্রগুলি নিয়ে যান। ভদ্রমহিলা কঠিন স্বরে বললেন, কোনোকিছুই নেবার প্রয়োজন নেই।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যাবার আগে এস. আকন্দ সাহেব অত্যন্ত শুকনো গলায় এক বার শুধু বললেন, আমাকে কষ্ট করে খুঁজে বের করবার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। ব্যস, এইটুকুই।
মিসির আলি ভেবে পেলেন না, এরা তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ কেন করলেন। তাঁদের মেয়েটি তার বাসায় গৃহভৃত্য ছিল, এইটিই কি তাঁদের মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে? এত বিচিত্র কেন মানুষের মন!
অবশ্যি তাঁদের বিচিত্র আচরণের অন্য একটি ব্যাখ্যাও দাঁড় করানো যেতে পারে। হয়তো আজকের এই ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরা হকচাকিয়ে গেছেন। আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা এসে পড়েছে এ-কারণেই।
মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। হানিফা নামের মেয়েটির জন্যে খারাপ লাগছে। বেশ খারাপ লাগছে। মেয়ে জাতটাই হচ্ছে মায়াবতীর জাত। কখন যে এই মেয়েটি মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে, নিজেই বুঝতে পারেন নি।
হানিফার সঙ্গে তাঁর আর কোনোদিন দেখা হবে না। ওরা নিশ্চয়ই তাঁদের মেয়েকে নিয়ে এখানে আসবেন না। তিনি নিজেও যাবেন না। কারণ তিনি কোনো পিছুটান রাখতে চান না কিংবা কে জানে, একদিন হয়তো যাবেন! দেখবেন, ঝড়ের রাতে পাওয়া ভিখিরি মেয়েটিকে রাজরানীবেশে কেমন লাগছে। সে কি মনে রাখবে তার দুঃসহ শৈশব? যদি রাখে, তবেই সে জীবনে অনেক বড় হবে। এবং তার ধারণা, এই মেয়েটি তা মনে রাখবে।
মিসির আলি চোখ মুছে নিজের ঘরে ঢুকলেন। বারবার চোখ ভিজে উঠছে কেন? তাঁর মতো এক জন শুকনো ধরনের মানুষের হৃদয়ে এত ভালবাসা কোথেকে এল?
দরজায় নক হচ্ছে। কে এল এত রাতে?
মিসির আলি দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখলেন–আকন্দ সাহেব! তাদের গাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে। তিনি শুধু একা নেমে এসেছেন। মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার!
বাসার কাছাকাছি পৌঁছার পর মনে হল, আপনাকে আমি যথাযথ ধন্যবাদ দিই নি।
ধন্যবাদের কোনো প্রয়োজন নেই।
আপনার নেই। আপনি সাধারণ মানুষের ঊর্ধ্ব। কিন্তু আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ।
ভদ্রলোক জড়িয়ে ধরলেন মিসির আলিকে এবং ছেলেমানুষের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী হানিফাকে নিয়ে নেমে এসেছেন গাড়ি থেকে। তিনি শক্ত করে হানিফার হাত ধরে রেখেছেন, যেন হাত ছেড়ে দিলেই মেয়েটি পালিয়ে যাবে।
মিসির আলি কোমল স্বরে বললেন, শান্ত হোন। আপনি শান্ত হোন। আসুন, ভেতরে গিয়ে বসি।
ভদ্রলোক ধরা গলায় বললেন, প্লীজ, আরো কিছুক্ষণ আপনাকে জড়িয়ে রাখার সুযোগ দিন। প্লীজ।
.
🔴 ঊনিশ 🔴
.
বুধবার। সময় রাত দশটা চল্লিশ।
ওসমান সাহেবের ঘুমের সময় হয়ে গিয়েছে। ইদানীং তিনি সিডাকসিন না খেয়ে ঘুমাতে পারেন না। তিনি উঠলেন। একটি সিডাকসিন ট্যাবলেট খেয়ে মাথায় পানি ঢাললেন, হাত-মুখ ধুলেন। বিছানায় যাবার আগে রোজকার অভ্যাসমতো উঁকি দিলেন ফিরোজের ঘরে। গত তিন দিন তিন রাত ধরে ফিরোজ তার ঘরে আটকা দু দিন দু রাত সে ছটফট করেছে, জিনিসপত্র ভেঙেছে, খাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ সারাদিন তেমন কিছু করে নি। ভাতটাত কিছুই খায় নি, তবে কোনো রকম চিৎকার এবং হৈচৈ করে নি। এখন সম্ভবত করবে। রাত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার পাগলামি বাড়ে, অস্থিরতা বাড়ে।
ওসমান সাহেব ফিরোজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ অবাক হলেন। ফিরোজ শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। গায়ে একটি শার্ট। চুল আচড়িয়েছে। মুখভর্তি খোঁচা-খোচা দাড়ি নেই শেভ করেছে এবং সম্ভবত গোসলও করেছে। ওসমান সাহেব নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।
কেমন আছ ফিরোজ?
ফিরোজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো এবং সহজ স্বাভাবিক গলায় বললো, ভালো আছি। তুমি কেমন আছ বাবা?
ভালো, ভালো। আমি ভালো, বেশ ভালো।
ওসমান সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কী অদ্ভুত কান্ড। ফিরোজ কি সুস্থ? নিশ্চয়ই সুস্থ।
বাবা, মাকে ডাকো খিদে পেয়েছে, ভাত খাব।
নিশ্চয়ই খাবি, নিশ্চয়ই। কী দিয়ে খাবি?
যা আছে, তাই দিয়ে খাব। স্পেশাল কিছু লাগবে না।
লাগবে না কেন? নিশ্চয়ই লাগবে। দাঁড়া ডাকছি। তোর মাকে ডাকছি। তোর শরীরটা এখন ভালো, তাই না?
হ্যাঁ, ভালো। বাবা, আমার ঘরটা খুব নোংরা হয়ে আছে, একটা ঝাড়ু দিতে বল। তালা খোলার দরকার নেই। জানালা দিয়েই দাও।
ওসমান সাহেব ঝাড়ু এনে দিলেন এবং ছুটে গেলেন স্ত্রীকে খবর দিতে। ফরিদাঁকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে এনে দেখেন, ফিরোজ ঘর মোটামুটি পরিষ্কার করে ফেলেছে। কত সহজ এবং স্বাভাবিক তার ব্যবহার! ফরিদার চোখে পানি এসে গেল।
মা, ভাত দাও আমাকে। খুব খিদে লেগেছে।
দিচ্ছি। বাবা, দিচ্ছি। এক্ষুণি দিচ্ছি।
জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে দিও না মা। নিজেকে জন্তুর মতো লাগে। মনে হয় আমি চিড়িয়াখানার একটা পশু।
না না, জানালা দিয়ে খাবার দেবনা। টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তুই চেয়ার-টেবিলে বসে খাবি।
আর শোন মা, আমার বিছানার চাদর-টাদর বদলে দাও। ধবধবে সাদা চাদর দেবে।
দিচ্ছি রে বাবা, দিচ্ছি।
আনন্দে ফরিদা বারবার মুখ মুছতে লাগলেন। সব ঠিক হয়ে গেছে। আর কোনো সমস্যা নেই, তাদের দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হয়েছে।
খাবার টেবিলে ভাত সাজিয়ে ওসমান সাহেব ফিরোজের ঘরের চাবি খুললেন। ফিরোজ বেরিয়ে এল। তার হাতে লোহার রড। তার পরনে একটি কালো প্যান্ট, খালি গা। সে থমথমে গলায় বলল, কি, ভয় লাগছে? ভয়ের কিছু নেই। মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি ও আমার চিকিৎসা করবে।
ওসমান সাহেব একটি কথাও বলতে পারলেন না। ফিরোজ হেঁটে-হেঁটে গেল গেটের কাছে দারোয়ানকে ঠাণ্ডা গলায় বললো গেট খুলে দিতে। দারোয়ান গেট খুলে দিল।
টপটপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমতে শুরু করেছে। রাস্তায় কেন যে স্ট্রীট-লাইট নেই! ফিরোজ লম্বা-লম্বা পা ফেলে অন্ধকারে নেমে গেল!
.
*****
.
বুধবার।
জাহিদ সাহেব রাত এগারটার দিকে এক জন ডাক্তার ডেকে আনলেন।
নীলুর আকাশ-পাতাল জ্বর। তিনি নিজে হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন। ডাক্তারের অবস্থাও তাই। ডাক্তার মুখ শুকনো করে বললো, এই মেয়েকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে। আমি আমার ডাক্তারি জীবনে এত জ্বর কারো দেখি নি। আপনি মেয়েটির মাথায় বরফ চাপা দেবার ব্যবস্থা করুন। আগে টেম্পারেচার কমাতে হবে।
ফ্রীজে বরফ ছিল না। তারা দু জন ধরাধরি করে নীলুকে বাথরুমে নিয়ে ঝরনার কল খুলে দিল। পানির ধারার স্রোতে যদি গায়ের তাপ কমানো যায়।
নীলু পড়ে আছে মড়ার মতো। তার চোখ রক্তবর্ণ। সে কিছুক্ষণ পরপরই মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে এবং ফিসফিস করে বলছে, স্যারের বড় বিপদ! তুমি কি তাকে দেখবে না? এইটুকু কি তুমি আমার জন্য করবে না?
জাহিদ সাহেব ডাক্তারকে বললেন, এই সব কী বলছে ডাক্তার সাহেব?
প্ৰলাপ বকছে। ডেলিরিয়াম। আপনি মেয়ের কাছে থাকুন, আমি অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে যাচ্ছি। টেলিফোন আছে তো?
জ্বি আছে। বসার ঘরে।
ডাক্তার সাহেব দ্রুত নিচে নেমে গেলেন। নীলু কাতর স্বরে বললো, বাবা, তুমি খানিকক্ষণ আমাকে একা থাকতে দাও। আমি ওর সঙ্গে কথা বলি।
কার সঙ্গে কথা বলবি?
যে আমার সঙ্গে থাকে, তার সঙ্গে। ওর সাহায্য আমার ভীষণ দরকার। বাবা, প্লীজ। প্লীজ। তুমি আছ বলে সে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছে না। বাবা, আমি তোমার পায়ে পড়ি।
নীলু সত্যি সত্যি হাত বাড়িয়ে বাবার পা স্পর্শ করলো। জাহিদ সাহেব বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন এবং সঙ্গে-সঙ্গেই চাঁপা ফুলের তীব্র সুবাস পেলেন।
স্পষ্ট শুনলেন নূপুর পায়ে কে যেন হাঁটছে। নীলুর কথাও শোনা যাচ্ছে, আমার এত বড় বিপদে তুমি আমাকে দেখবে না?
অপরিচিত একটি কণ্ঠ শোনা গেল। জাহিদ সাহেব কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি একমনে আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগলেন।
.
🔴 বিশ 🔴
.
বুধবার মধ্যরাত্রি।
মিসির আলির রুটিনের ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। ঘরে রান্না হয় নি। তাঁকে রাতে হোটেলে খেয়ে আসতে হয়েছে। ডাল-গোশত নামের যে খাদ্যটি তিনি কিছুক্ষণ আগে গলাধঃকরণ করেছেন, তা এখন জানান দিচ্ছে মিসির আলি পেটে ব্যথা নিয়ে জেগে আছেন। ফুড পয়জনিং-এর লক্ষণ কি না কে জানে? পেটের ব্যথা ভুলে থাকবার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে থ্রিলারজাতীয় কোনো রচনায় মনোনিবেশ করা। কিন্তু ঘরে এ জাতীয় কোনো বই নেই। তবু মিসির আলি বুকসেলফের কাছে গেলেন। সবই একাডেমিক বই। একটি সায়েন্স ফিকশন পাওয়া গেল–Horseman from the sky. তেমন কোনো ইন্টারেষ্টিং বই নয়। আগে এক বার পড়েছেন। তবুও সেই বই হাতে নিয়েই বিছানায় গেলেন এবং তখন ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বৃষ্টি ও বাতাস দুই-ই থেমে গেছে। তবুও মাঝরাতে লোড শেডিং হবার কথা নয়, কিন্তু ঢাকা শহরের ইলেকট্রিসিটির কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
মিসির আলি অত্যন্ত বিরক্ত মুখে ড্রয়ার খুললেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ড্রয়ারে বড় বড় দুটি মোমবাতি পাওয়া গেল। হানিফা নিশ্চয়ই একসময় কিনে রেখে দিয়েছে। মিসির আলি মোমবাতি জ্বালিয়ে বই খুললেন। দ্বিতীয় বার পড়বার সময় বইটি অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শারীরিক ব্যথা ভুলে আগ্রহ নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলেন। চমৎকার লেখা—এক ভোরবেলায় মস্কো শহরের প্রাণকেন্দ্ৰে এক ঘোড়সওয়ারের আগমন হল। লোকটির চেহারা কুৎসিত। মাথায় সার্কাসের ক্লাউনের টুপির মতো এক টুপি। সে তার ঘোড়া নিয়ে নানান খেলা দেখাতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে তাকে ঘিরে ভিড় জমে গেল।
এত মজার একটি বই আগের বার পড়তে এত বাজে লাগছিল কেন। মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন–চা বানাবেন। চা খেতে-খেতে আরাম করে পড়া যাবে। তাঁর মনে হল, মোমবাতির আলোয় বই পড়ায় আলাদা একটা আনন্দ আছে। আধো আলো আধো ছায়া। বইয়ের জগৎটিও তো তাই–অন্ধকার এবং আলোর মিশ্ৰণ। লেখকের কল্পনা হচ্ছে আলো, পাঠকের বিভ্রান্তি হচ্ছে অন্ধকার। নিজের তৈরি উপমা নিজের কাছেই চমৎকার লাগলো তাঁর। তিনি নিজেকে বাহবা দিয়ে সিগারেটের জন্যে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই দরজায় খুব হালকাভাবে কে যেন কড়া নাড়ল!
মিসির আলি ঘড়ি দেখলেন, রাত প্ৰায় একটা। এত রাতে কে আসবে তাঁর কাছে! তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, কে, কে?
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। মিসির আলি গলা উঁচিয়ে বললেন, কে ওখানে।
আমি।
মিসির আলির বিস্ময়ের সীমা রইল না। নীলুর গলা। সে এত রাতে এখানে কী করছে পাগল নাকি!
কি ব্যাপার নীলু?
নীলু জবাব দিল না। ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেললো। মিসির আলি ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন–নীলু নয়, ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে।
ফিরোজের দুটি হাত পেছন দিকে। সে হাতে সে কী ধরে আছে তা মিসির আলির বুঝতে অসুবিধা হল না। তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন।
কেমন আছ ফিরোজ নীলুর গলা তো চমৎকার ইমিটেট করলে। এস, ভেতরে এস। ইস, ভিজে গেছ দেখি!
ফিরোজ ভেতরে ঢুকলো। পলকের জন্যে মিসির আলির ইচ্ছা করলো ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি পারলেন না। তাঁর পা পাথরের মতো ভারি হয়ে গেছে। অত্যন্ত সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করলেন।
কিছু খাবে, ফিরোজ? চা খাবে ঠাণ্ডায় চা-টা ভালো লাগবে। ইনফ্যাক্ট আমি চা বানানোর জন্যেই উঠেছিলাম।
ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। সে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। সে মাঝেমাঝে ঠোঁট টিপে হাসছে।
মিসির আলি বললেন, বস ফিরোজ, দাঁড়িয়ে আছ কেন এতক্ষণ শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছিলাম। একটা সায়েন্স ফিকশন। তুমি কি সায়েন্স ফিকশন পড়?
ফিরোজ এবার শব্দ করে হাসলো। মিসির আলি শিউরে উঠলেন। কী অমানুষিক হাসি! এই হাসির জন্ম নয়, অন্য কোনো ভুবনে অচেনা ভয়ঙ্কর এক ভুবন, যার কোনো রহস্যই আলির জানা নেই। মিসির আলির সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেল।
তিনি বহু কষ্ট বললেন, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে ফিরোজ?
হ্যাঁ।
কেন ফিরোজ, আমি কি তোমার ক্ষতি করেছি?
ফিরোজ তার জবাব দিল না। লোহার রডটি উঁচু করল। মিসির আলি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলো , চিৎকার দিতে পারলেন না। তাঁর কাছে শুধু মনে হল, মোমবাতির আলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠছে এবং আশ্চর্যের ব্যাপার–ছেলেবেলার একটি স্মৃতি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। গ্ৰীষ্মের প্রচণ্ড গরমের এক দুপুরে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ব্ৰহ্মপুত্রের শীতল জলে। ঠাণ্ডা ও ভরি সেই পানি মাছের চোখের মতো সেই স্বচ্ছ জলে ইচ্ছে করে তলিয়ে যেতে।
মৃত্যুর আগে গত জীবন চোখের সামনে এক বার হলেও ভেসে ওঠে, এটা কি সত্য? হয়তো সত্য। নয়তো হঠাৎ করে ভুলে-যাওয়া শৈশবের এই ছবি চোখে ভাসবে কেনো ?
মিসির আলি কিছু-একটা বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু বলতে পারলেন না। তার আগেই লোহার রড প্ৰচণ্ড বেগে নেমে এল তাঁর দিকে। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। তীব্র ও তীক্ষ্ণ ব্যথা। এক গভীর শূন্যতা। মিসির আলি বুঝতে পারছেন, তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর চারদিকে সীমাহীন জলরাশি। তিনি কিছু বলতে চেষ্টা করলেন–বলতে পারলেন না।
মিসির আলি। মিসির আলি। তাকাও তুমি। তাকিয়ে দেখ।
মিসির আলি চোখ মেললেন। মোমবাতি জ্বলছে। আলো এবং আধার। তিনি কি বেঁচে আছেন? নাকি এটা মৃত্যুর পরের কোনো জগৎ? কোনো অদেখা ভুবন?
মিসির। মিসির।
কে কথা বলে? কোথেকে আসছে কিন্নরকণ্ঠ। ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু দেখার উপায় নেই। সমস্ত শরীর অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট। এত কষ্টও আছে পৃথিবীতে? কোথায়, ফিরোজ কোথায়?
মিসির। মিসির আলি। আর কোনো ভয় নেই, সে পালিয়ে গেছে? আমি এসেছি। তাকাও, তাকাও আমার দিকে।
কে পালিয়ে গেছে? কে কথা বলছে? কার দিকে তাকাতে বলছে? মিসির আলি তাকাতে গিয়ে ব্যথায় নীল হয়ে গেলেন। মুখ ভর্তি করে বমি করলেন। টকটকে লাল রক্ত এসেছে বমিতে। ফুসফুস ফুটো হয়েছে। পাঁজরের হাড় ঢুকে গেছে। ফুসফুসে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এই কারণে।
মিসির আলির চোখে জল এসে গেল-এত কষ্ট, এত কষ্ট!
মিসির। মিসির।
কে তুমি?
তাকিয়ে দেখ।
মিসির আলি তাকালেন। যন্ত্রণা এবং ব্যথার জন্যেই কি তিনি এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছেন? হেলুসিনেশন? হেলুসিনেশন।
মিসির আলি, আমি কে বল তো।
জানি না, কে।
ভালো করে দেখ, ভালো করে দেখা চোখ নামিয়ে নিচ্ছ কেন? আমার সঙ্গে কথা বলতে থাক, তাতে ব্যথা ভুলে থাকবে। বল আমি কে?
মিসির আলি আবার মুখ ভৰ্তি করে বমি করলেন।
আমিই সেই দেবী। তুমি তো আমাকে বিশ্বাস কর না। নাকি এখন করছো?
তুমি আমার কল্পনা। উইশফুল থিংকিং। দেবী আবার কী?
আমিই কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়েছি।
দেবীমূর্তি খিলখিল করে হেসে উঠল। কী চমৎকার হাসি। কী অপূর্ব সুরধ্বনি! ঘরে চাঁপা ফুলের গন্ধ,তীব্র সৌরভ। হেলুসিনেশন! হেলুসিনেশন হচ্ছে। হেলুসিনেশন ছাড়া এ আর কিছুই নয়।
দেবী হাসলো। চাঁপা ফুলের গন্ধু কি দেবীর গা থেকেই আসছে? তাকে রক্তমাংসের মানবীর মতোই লাগছে। ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কী কষ্ট! কী কষ্ট! মিসির আলি হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, দেবী, আমার কষ্ট কমিয়ে দাও।
আমাকে বিশ্বাস করছি তাহলে?
না।
কেন করছ না? এ জগতের সমস্তই কি যুক্তিগ্রাহ্য? এই আকাশ, অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জ? তুমি কি বলতে চাও, এর কোথাও কোনো রহস্য নেই? অসীম কী? এই সামান্য প্রশ্নের জবাব কি তোমার জানা আছে? বল, তুমি জান?
আজ জানি না, কিন্তু একদিন জানবো। আমি না জানলেও আমার পরবর্তী বংশধর জানবে।
মিসির আলি, তুমি বড় অদ্ভুত লোক।
মিসির আলি কাতর কণ্ঠে বললেন, আমার ব্যথা কমিয়ে দাও, আমার ব্যথা কমিয়ে দাও।
দেবী হেসে উঠলো। মৃদু স্বরে বলল, আমায় বিশ্বাস করছো না, অথচ ব্যথা কমিয়ে দিতে বলছো?
বড় কষ্ট, বড় কষ্ট!
তোমার বন্ধু চলে আসছে। তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তুমি আবার সুস্থ হয়ে উঠবে এবং মজার ব্যাপার কি জান? নীলুর সঙ্গে বিয়ে হবে তোমার। যদি কোনোদিন হয়, আমার কথা মনে করো।
মিসির আলি আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে লাগলেন। তিনি দেবীর কথা এখনো শুনতে পাচ্ছেন। কী অপূর্ব কণ্ঠ। কী অলৌকিক সৌন্দর্য। কিন্তু এ সবই মায়া। অসুস্থ ব্যথাজর্জরিত মনের সুখ-কল্পনা। প্রকৃতি চাচ্ছে নারকীয় কষ্ট থেকে তাঁর মন ফিরিয়ে নিতে। সে-জন্যেই সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁকে ভোলাচ্ছে। হয়তো নীলুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে। তাতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। প্রমাণ বড় কঠিন জিনিস। বড় কঠিন।
মিসির আলি কাতর কণ্ঠে বললেন, কষ্ট কমিয়ে দাও। কষ্ট কমিয়ে দাও।
অপরূপা নারীমূর্তি চাঁপা ফুলের গন্ধ ছড়াতে—ছড়াতে দূরে সরে যাচ্ছে। তার পায়ে ঝুমঝুম করছে নূপুর। কে যেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে কে সে? সাজ্জাদ হোসেন? ওরা কি ধরে ফেলেছে ফিরোজকে? ওকে সুস্থ করে তুলতে হবে। ইসিটি দিয়ে দেখলে হয়। মনে হয় এখন সে সুস্থ। তাকে একবার আঘাত করেই তার চেতনা ফিরে এসেছে।
হানিফা। হানিফা কেমন আছে? কোথায় আছে? সুখে আছে তো? আহ্, বড় কষ্ট। কেউ আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও—ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি তলিয়ে যেতে চাই অতল অন্ধকারে। বড় কষ্ট, বড় কষ্ট।
সাজ্জাদ হোসেন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। টর্চের আলো ফেললেন মিসির আলির মুখে। সাজ্জাদ হোসেনের মুখে এক ধরনের প্রশান্তি লক্ষ করা গেল। কারণ, নগ্নগাত্র আগন্তুককে কিছুক্ষণ আগেই ধরা হয়েছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, পুলিশকে সে প্রথম যে-কথাগুলি বলে, তা হচ্ছে, আপনারা স্যারকে বাঁচানোর চেষ্টা করুন। এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যান। আর আমার বাবাকে টেলিফোন করে বলুন, আমি ভালো হয়ে গেছি। স্যারের বাসায় এক জনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে আমাকে ভালো করে দিয়েছে।
—————
গল্পের অধিকাংশ চরিত্রই কাল্পনিক। পরিচিত কিছু চরিত্র এবং কিছু ঘটনা ব্যবহার করেছি। তবে কাউকে হেয় করবার জন্যে করা হয় নি। মানুষের প্রতি আমার মমতা মিসির আলির মতো হয়তো নয়, কিন্তু খুব কমও নয়।
.
🔺 সমাপ্ত 🔻
COMMENTS