টুনটুনির বই - উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

চলুন কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আসি ছোটবেলার সেই দিনগুলো থেকে গল্পগুলো পড়ে খুব মিস করছি ছোটবেলার সেই দিনগুলি ।। শিয়াল পন্ডিত কুঁজো বুড়ি চড়াই ও কাকের কথা


টুনটুনির বই - উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

 শিয়াল পণ্ডিত 

শিয়াল পণ্ডিত আখ খেতে বড় ভালবাসে, তাই সে রোজ আখ ক্ষেতে যায়। একদিন সে আখের ক্ষেতে ঢুকে একটি ভিমরুলের চাক দেখতে পেল। ভিমরুলের চাক সে আগে কখনো দেখেনি, সে মনে করল ওটা বুঝি আখের ফল।

শিয়াল কিনা পণ্ডিত মানুষ, তাই সে আখকে বলে ‘ইক্ষু’, ক্ষেতকে বলে ‘ক্ষেত্র’, লাঠিকে বলে ‘দণ্ড’,।

ভিমরুলের চাক দেখে সে বললে, ‘আহা ইক্ষুর কি চমৎকার ফল! খেতে না জানি কতই মিষ্টি হবে?’ এই মনে করে যেই সে ভিমরুলের চাক খেতে গিয়েছে, অমনি সব ভিমরুল বেরিয়ে কি-মজাটাই তাকে দেখাতে লাগল! শিয়াল তো প্রাণের ভয়ে খালি ছোটে, আর বলে, ‘ইক্ষুর ক্ষেত্রে আর যাব না!’

খানিক বাদে ভিমরুলগুলো তাকে ছেড়ে গেল। তখন সে ভাবলে, ‘ক্ষেত্রে তো রোজই যাই, তাতে কিছু হয় না। ফল খেতে গিয়েই আমার বিপদ হল। তবে আর ক্ষেত্রে যাব না কেন? ফল না খেলেই হল।’ এই ভেবে সে বলতে লাগল, ‘যদি ইক্ষুর ক্ষেত্রে যাব, ইক্ষুর ফল আর না খাব!’ দুদিন সে খালি এ কথাই বলে।

তারপর যখন বেদনা একটু কমে এল, তখন সে ভাবলে, ‘ঐ ফলটার ভিতর পোকা ছিল, তারাই আমাকে কামড়েছে। আগে যদি ফলটাতে নাড়া দিতুম তবে পোকাগুলি বেরিয়ে যেত। তারপর ফল খেতে কোনো কষ্ট হত না! আহা, সে ফল খেতে না জানি কতই মিষ্টি। তবে আর ফল খাব না কেন? খাবার আগে পোকা তাড়িয়ে দিলেই হবে।’ এই ভেবে সে বলতে লাগল, ‘যদি ইক্ষুর ফল খাব, আগে দণ্ড দিয়ে নাড়া দিব!’ বলতে-বলতে আখের ক্ষেতে গিয়ে সে তো লাঠি দিয়ে নাড়া দিয়েছে। অমনি আর যাবে কোথায়! ভিমরুলের দল এসে তাকে কামড়িয়ে আধমরা করে তবে ছাড়ল। সেই থেকে সে আর ইক্ষুর ফল খেত না।


 কুঁজো বুড়ির কথা 


এক যে ছিল কুঁজো বুড়ি। সে লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে চলত, আর তার মাথাটা খালি ঠক-ঠক করে নড়ত। বুড়ির দুটো কুকুর ছিল। একটা নাম রঙ্গা, আর একটার নাম ভঙ্গা।

বুড়ি যাবে নাতনীর বাড়ি, তাই কুকুর দুটোকে বললে, ‘তোরা যেন বাড়ি থাকিস, কোথাও চলে টলে যাসনে।’

রঙ্গা-ভঙ্গা বললে, ‘আচ্ছা’। তারপর বুড়ি লাঠি ভর দিয়ে, কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, আর তার মাথাটা খালি ঠক ঠক করে নড়ছে। এমনি করে সে খানিক দূর গেল।

তখন শিয়াল তাকে দেখতে পেয়ে বললে, ‘ঐ রে, সেই কুঁজো বুড়ি যাচ্ছে। বুড়ি, তোকে তো খাব!’

বুড়ি বললে, ‘রোস, আমি আগে নাতনীর বাড়ি থেকে মোটা হয়ে আসি, তারপর খাস। এখন খেলে তো শুধু হাড় আর চামড়া খাবি, আমার গায়ে কি আর কিছু আছে?’

শুনে শিয়াল বললে, ‘আচ্ছা, তবে মোটা হয়ে আয়, তারপর খাব এখন।’ বলে শিয়াল চলে গেল।

তারপর বুড়ি আবার লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, আর তার মাথাটা ঠক-ঠক করে নড়ছে। এমনি করে আরো খানিক দূর গেল।

তখন এক বাঘ তাকে দেখতে পেয়ে বললে, ‘ঐ রে, সেই কুঁজো বুড়ি যাচ্ছে। বুড়ি, তোকে তো খাব!’

বুড়ি বললে, ‘রোস, আমি আগে নাতনীর বাড়ি থেকে মোটা হয়ে আসি, তারপর খাস। এখন খেলে তো শুধু হাড় আর চামড়া খাবি, আমার গায়ে কি আর কিছু আছে?’

শুনে বাঘ বললে, ‘আচ্ছা, তবে মোটা হয়ে আয়, তারপর খাব এখন।’ বলে বাঘ চলে গেল।

তারপর বুড়ি আবার লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, আর তার মাথাটা ঠক-ঠক করে নড়ছে। এমনি করে সে আরো খানিক দূর গেল।

তখন এক ভাল্লুক তাকে দেখতে পেয়ে বললে, ‘ঐ রে, সেই কুঁজো বুড়ি যাচ্ছে। বুড়ি, তোকে তো খাব!’

বুড়ি বললে, ‘রোস, আমি আগে নাতনীর বাড়ি থেকে মোটা হয়ে আসি, তারপর খাস। এখন খেলে তো শুধু হাড় আর চামড়া খাবি, আমার গায়ে কি আর কিছু আছে?’

শুনে ভাল্লুক বললে, ‘আচ্ছা, তবে মোটা হয়ে আয়, তারপর খাব এখন।’

এই বরে ভাল্লুক চলে গেল। বুড়িও আর খানিক দূর গিয়েই তার নাতনীর বাড়ি পৌঁছল। সেখানে দই আর ক্ষীর খেয়ে-খেয়ে এমনি মোটা হল যে, কি বলব! আর একটু মোটা হলেই সে ফেটে যেত।

তাই সে তার নাতনীকে বললে, ‘ওগো নাতনী, আমি তো বাড়ি চললুম। এবারে আর আমি চলতে পারব না। আমাকে গড়িয়ে যেতে হবে। আবার পথে ভাল্লুক, বাঘ আর শিয়াল হাঁ করে বসে আছে। আমাকে দেখতে পেলেই ধরে খাবে। এখন বল দেখি কি করি?’

নাতনী বললে, ‘ভয় কি দিদিমা? তোমাকে এই লাউয়ের খোলটার ভিতরে পুরে দেব। তাহলে বাঘ ভাল্লুক বুঝতেও পারবে না, তোমাকে খেতেও পারবে না।’

বলে, সে বুড়িকে একটা লাউয়ের খোলার ভিতর পুরে, তার খাবার জন্যে চিঁড়ে আর তেঁতুল সঙ্গে দিয়ে, হেঁইয়ে বলে লাউয়ে ধাক্কা দিলে, আর লাউ গাড়ির মতন গড়গড়িয়ে চলল।

লাউ চলছে আর বুড়ি তার ভিতর থেকে বললে-

‘লাউ গড়-গড়, লাউ গড়-গড়

খাই ছিঁড়ে আর তেঁতুল,

বীচি ফেলি টুল্-টুল্।

বুড়ি গেল ঢের দূর!’

পথের মাঝখানে সেই ভাল্লুক হাঁ করে বসে আচে, বুড়িকে খাবে বলে। সে বুড়ি-টুড়ি কিছু দেখতে পেলে না, খালি দেখলে একটা লাউ গড়িয়ে যাচ্ছে। লাউটাকে নেড়ে-চেড়ে দেখলে, বুড়িও নয়, খাবার জিনিসও নয়। আর তার ভিতর থেকে কে যেন বলছে, ‘বুড়ি গেল ঢের দূর!’ শুনে সে ভাবলে, বুড়ি চলে গিয়েছে। তখন সে ঘোঁৎ করে তাতে দিলে এক ধাক্কা আর সেটা গাড়ির মতন গড়গড়িয়ে চলল।

লাউ চলছে আর বুড়ি তার ভিতর থেকে। বলছে-

‘লাউ গড়-গড়, লাউ গড়-গড়,

খাই ছিঁড়ে আর তেঁতুল,

বীচি ফেলি টুল্-টুল্।

বুড়ি গেল ঢের দূর!’

আবার খানিক দূরে বাঘ বসে আছে বুড়িকে খাবে বলে। সে বুড়িকে দেখতে পেল না, খালি দেখলে একটা লাউ গড়িয়ে যাচ্ছে। সেটাকে নেড়ে-চেড়ে দেখলে, বুড়িও নয়, খাবার জিনিসও নয়। আর তার ভিতর থেকে সে যেন বলছে, ‘বুড়ি গেল ঢের দূর।’ শুনে সে ভাবলে বুড়ি চলে গিয়েছে। তখন সে ঘোঁৎ করে তাতে দিলে এক ধাক্কা, আর সেটা গাড়ির মতন গড়গড়িয়ে চলল।

লাউ চলছে আর বুড়ি তার ভিতর থেকে চললে-

‘লাউ গড়-গড়, লাউ গড়-গড়,

খাই ছিঁড়ে আর তেঁতুল,

বীচি ফেলি টুল্-টুল্।

বুড়ি গেল ঢের দূর!’

আবার খানিক দূরে সেই শিয়াল পথের মাঝখানে বসে আছে। সে লাউ দেখে বললে, ‘হুঁ! লাউ কিনা আবার কথা বলে। ওর ভিতর কি আছে দেখতে হবে।’ তখন সে হতভাগা লাথি মেরে লাউটা ভেঙেই বলে কিনা, ‘বুড়ি তোকে তো খাব!’

বুড়ি বললে ‘খাবি বইকি! নইলে এসেছি কি করতে? তা, আগে দুটো গান শুনবিনে?’

শিয়াল বললে, ‘হ্যাঁ, দুটো গান হলে মন্দ হয় না। আমিও একটু-আধটু গাইতে পারি।’

বুড়ি বললে, ‘তবে ভালোই হল। চল ঐ চিপিটায় উঠে গাইব এখন।’

বলে বুড়ি সেই টিপির উপরে উঠে সুর ধরে চেঁচিয়ে বললে, ‘আয়, রঙ্গা-ভঙ্গা, তু-উ-উ-উ-উ!’

অমনি বুড়ির দুই কুকুর ছুটে এসে, একটা ধরলে শিয়ালের ঘাড়, আর একটায় ধরলে তার কোমর। ধরে টান কি টান! শিয়ালের ঘাড় ভেঙে গেল, কোমর ভেঙে গেল, জিভ বেরিয়ে গেল, প্রাণ বেরিয়ে গেল-তবু তারা টানছেই, টাইছেই, খালি টানছে।


 চড়াই আর কাকের কথা 


কাক আর চড়াইপাখিতে খুব ভাব ছিল।

গৃহস্থদের উঠানে চাটাই ফেলে ধান আর লঙ্কা রোদে দিয়েছে। চড়াই তা দেখে কাককে বললে, ‘বন্ধু, তুমি আগে লঙ্কা খেয়ে শেষ করতে পারবে, না আমি আগে ধান খেয়ে শেষ করতে পারব?’

কাক বললে, ‘না, আমি লঙ্কা আগে খাব।’

চড়াই বললে, ‘না, আমি ধান আগে খাব।’

কাক বললে, ‘যদি না খেতে পার, তবে কি হবে?’

চড়াই বললে, ‘যদি না খেতে পারি, তবে তুমি আমার বুক খুঁড়ে খাবে। আর যদি তুমি না খেতে পার, তবে কি হবে?’

কাক বললে, ‘তুমি আমার বুক খুঁড়ে খাবে।’

এই বলে তো দুজনে ধান আর লঙ্কা খেতে লাগল। চড়াই কুট-কুট করে এক-একটি ধান খায়, আর কাক খপ-খপ করে একটি-একটি লঙ্কা খায়। দেখতে-দেখতে কাক সব লঙ্কা খেয়ে শেষ করলে, চড়াইয়ের তখন ধানের সিকিও খাওয়া হয়নি।

তখন কাক বললে, ‘কি বন্ধু, এখন?’

চড়াই বললে, ‘এখন আর কি হবে। বন্ধু হয়ে যদি আমার বুক খেতে চাও, তবে খাবে। তবে ঠোঁট দুটো ধুয়ে নিও, তুমি নোংরা জিনিস খাও।’

কাক বললে, ‘আমি ঠোঁট ধুয়ে আসছি।’ বলে সে গঙ্গায় ঠোঁট ধুতে গেল।

তখন গঙ্গা তাকে বললেন, ‘তোর নোংরা ঠোঁট আমার গায়ে ছোঁয়াসনে। জল তুলে নিয়ে ঠোঁট ধো।’

তাতে কাক বললে, ‘আচ্ছা, আমি ঘটি নিয়ে আসছি।’ বলে সে কুমোরের কাছে গিয়ে বললে-

কুমোর, কুমোর! দে তো ঘটি,

তুলব জল, ধোব ঠোঁট-

কুমোর বললে, ‘ঘটি তো নেই। মাটি আন, গড়ে দি।’ শুনে কাক মোষের কাছে তার শিং চাইতে গেল, সেই শিং দিয়ে মাটি খুঁড়বে। কাক বললে-

মোষ, মোষ! দে তো শিং,

খুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,

তুলব জল, ধোব ঠোঁট-

তবে খাব চড়াইর বুক।

শুনে মোষ রেগে তাকে এমনি গুঁতোতে এল যে সে সেখান থেকে দে ছুট! তারপর সে কুকুরের কাছে গিয়ে বললে-

কুত্তা, কুত্তা! মারবি মোষ,

লব শিং, কুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,

তুলব জল, ধোব ঠোঁট-

তবে খাব চড়াইর বুক।

কুকুর বললে, ‘আগে দুধ আন, খেয়ে গায়ে জোর করি, তবে মোষ মারব এখন।’ শুনে কাক গাইয়ের কাছে গিয়ে বললে-

গাই, গাই! দে তো দুধ,

খাবে কুত্তা, হবে তাজা,

মারবে মোষ, লব শিং,

কুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,

তুলব জল, ধোব ঠোঁট-

তবে খাব চড়াইর বুক।

গাই বলরে, ‘আগে ঘাস আন খাই, তারপর দুধ দেব।’

শুনে কাক মাঠের কাছে গিয়ে বললে-

মাঠ, মাঠ! দে তো ঘাস,

খাবে গাই, দেবে দুধ,

খাবে কুত্তা, হবে তাজা

মারবে মোষ, লব শিং,

খুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,

তুলব জল, ধোব ঠোঁট-

তবে খাব চড়াইব বুক।

মাঠ বললে, ‘ঘাস তো রয়েছে, নিয়ে যা না!’

তখন কাক কামারের বাড়ি গিয়ে বললে-

কামার, কামার! দে তো কাস্তে,

কাটব ঘাস, খাবে গাই,

দেবে দুধ, খাবে কুত্তা,

হবে তাজা, মারবে মোষ, লব শিং,

খুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,

তুলব জল, ধোব ঠোঁট-

তবে খাব চড়াইর বুক।

কামার বললে, ‘আগুন নেই। আগুন নিয়ে আয়, কাস্তে গড়ে দি।’ তা শুনে কাক গৃহস্থদের বাড়ি গিয়ে বললে-

গেরস্ত ভাই, দাও তো আগুন,

গড়বে কাস্তে, কাটব ঘাস,

খাবে গাই, দেবে দুধ, খাবে কুত্তা,

হবে তাজা, মারবে মোষ, লব শিং,

খুঁড়ব মাটি, গড়বে ঘটি,

তুলব জল, ধোব ঠোঁট-

তবে খাব চড়াইব বুক।

তখন গৃহস্থ এক হাঁড়ি আগুন এনে বললে, ‘কিসে করে নিবি?’

বোকা কাক তার পাখা ছড়িয়ে বললে, ‘এই আমার পাখার উপরে ঢেলে দাও।’

গৃহস্থ সেই হাঁড়িসুদ্ধ আগুন কাকের পাখার উপর ঢেলে দিলে, আর সে বেটা তখুনি পুড়ে মরে গেল। তার আর চড়াইর বুক খাওয়া হল না।

 চড়াই আর বাঘের কথা 

গৃহস্থের ঘলের কোণে একটি হাঁড়ি ঝোলানো ছিল, তার ভিতরে চড়াই-চড়নী থাকত।

একদিন চড়াই বললে, ‘চড়নী, আমি পিঠে খাব।’

চড়নী বললে, ‘পিঠের জিনিসপত্র এনে দাও, পিঠে গড়ে দেব এখন।’

চড়াই বললে, ‘কি জিনিস লাগবে?’

চড়নী বললে, ‘ময়দা লাগবে, গুড় লাগবে, কলা লাগবে, দুধ লাগবে, কাঠ লাগবে।’

চড়াই বললে, ‘আচ্ছা আমি সব এনে দিচ্ছি।’ বলে সে বনের ভিতর গিয়ে গাছের সরু-সরু শুকনো ডাল মট-মট ভাঙতে লাগল।

সেই বনের ভিতর এক মস্ত বাঘ ছিল, সে চড়াইকে বলত, ‘বন্ধু’।

ডাল ভাঙার শব্দ শুনে সে বললে, ‘মট-মট করে ডাল ভাঙছ, ওকি আমার বন্ধু?’

চড়াই বললে, ‘হ্যাঁ, বন্ধু।’

বাঘ বললে, ‘ডাল দিয়ে কি হবে?’

চড়াই বললে, ‘কাঠ চাই, চড়নী পিঠে গড়বেন।’

শুনে বাঘ বললে, ‘বন্ধু, আমি কখখনো পিঠে খাইনি, আমাকে দিতে হবে।’

চড়াই বললে, ‘তবে জোগাড় সব এনে দাও।’

বাঘ বললে, ‘কি-কি জোগাড় চাই?’

চড়াই বললে, ‘ময়দা চাই, গুড় চাই, কলা চাই, দুধ চাই, ঘি চাই, হাঁড়ি চাই, কাঠ চাই।’

বাঘ বললে, ‘আচ্ছা তুমি ঘরে যাও, আমি সব এনে দিচ্ছি।’ চড়াই তখন ঘরে চলে এল, আর বাঘ দুলতে দুলতে বাজারে চলল। বাজারে গিয়ে বাঘ খালি একটিবার বললে, ‘হাল্লুম!’ অমনি দোকানীরা ‘বাবা গো! বাঘ এসেছে গো!’ পালা, পালা!’ বলে দোকান-টোকান সব ফেলে ছুটে পালাল। তখন বাঘ সব দোকান খুঁজে ময়দা, গুড়, কলা, দুধ, ঘি, হাঁড়ি আর কাঠ নিয়ে চড়াইয়ের বাড়িতে দিয়ে এল।

তারপর চড়নী চমৎকার পিঠে গড়ল, আর দুজনে মিলে পেট ভরে খেল। শেষে বাঘের জন্য একখানা পাতায় করে কতকগুলি পিঠে মাটিতে রেখে দিয়ে, দুজনে চুপ করে হাঁড়ির ভিতর বসে রইল।

বাঘ এসে পিঠে দেখতে পেয়েই খেতে বসে গেল।

একখানা পিঠে মুখে সে বললে, ‘বাঃ! কি চমৎকার!’

আর একখানা মুখে দিয়ে বললে, ‘না, এটা তত ভালো নয়, খালি ময়দা দিয়ে গড়েছে!’

আর একখানা মুখে দিয়ে বললে, ‘ছি! এটাতে খালি ভুষি আর ছাই। চড়াইবন্ধু, এ কি খাওয়ালে!’

আর একখানা মুখে দিয়ে বললে, ‘উঃ হুঁ! এটাতে কিসে গন্ধু! গোবর দিয়েছে নাকি? চড়াই বেটা তো বড় পাজী।’

এমন সময় হয়েছে কি? চড়াই হাঁড়ির ভিতর থেকে নাক-মুখ সিঁটকিয়ে বলছে, ‘চড়নী, আমি হাঁচব।’

শুনে চড়নী ভারি ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘চুপ, চুপ! এখন হাঁচতে হবে না, তাহলে বড় মুশকিল হবে।’

তাতে চড়াই চুপ করল। কিন্তু খানিক বাদেই আবার ভয়ানক নাক-মুখ সিঁটকিয়ে হাঁচতে গেল। চড়নী তাতে থামাতে কত চেষ্টা করল, কিছুতেই থামিয়ে রাখতে পারল না।

বাঘ একটা বিশ্রী পিঠে খেয়ে বললে, ‘থু! থু! এটা খালি গোবর দিয়েই গড়েছে, আর কিছু দেয়নি! যদি চড়াইয়ের নাগাল পাই, তাকে কামড়িয়ে চিবিয়ে খাব।’

তারপর আর একাট পিঠে মুখে দিয়ে সে সবে ওয়াক্-ওয়াক্ করতে লেগেছে, অমনি হ্যাঁ-চ্ছোঃ করে চড়াই ভয়ানক শব্দে হেঁচে ফেললে। সে শব্দে বাঘ সেই যেই চমকে লাফিয়ে উঠতে যাবে, অমনি হাঁড়িসুদ্ধ দড়ি ছিঁড়ে, চড়াই আর চড়নী তার ঘাড়ে পড়ল।

বাঘ কিছুতেই বুঝতে পারলে না, কি বাজ বড়ল, না আকাশ ভেঙে পড়ল! সে খুব ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে সেখান থেকে ছুট দিল, আর তার ঘরে না গিয়ে থামল না।


 টুনটুনি আর নাপিতের কথা


টুনটুনি গিয়েছিল বেগুন পাতায় বসে নাচতে। নাচতে-নাচতে খেল বেগুন কাঁটায় খোঁচা। তাই থেকে তার হল মস্ত বড় ফোঁড়া।

ও মা, কি হবে? এত বড় ফোঁড়া কি করে সারবে?

টুনটুনি একে জিগগেস করে, তাকে জিগগেস করে। সবাই বলরে, ‘ওটা নাপিত দিয়ে কাটিয়ে ফেল।’

তাই টুনটুনি নাপিতের কাছে গিয়ে বললে, নাপিতদাদা, নাপিতদাদা, আমার ফোঁড়াটা কেটে দাও না!’

নাপিত তার কথা শুনে ঘাড় বেঁকিয়ে নাক সিটকিয়ে বললে, “ঈস্! আমি রাজাকে কামাই, দেখি তোর ফোঁড়া কাটতে গেলুম আর কি!’

টুনটুনি বললে, ‘আচ্ছা দেখতে পাবে এখন, ফোঁড়া কাটতে যাও কি না।’

বলে সে রাজার কাছে নালিশ করলে, ‘রাজামশাই, আপনার নাপিত কেন আমার ফোঁড়া কেটে দিচ্ছে না? ওকে সাজা দিতে হবে!’

শুনে রাজামশাই হো হো করে হাসলেন, বিছানায় গড়াগড়ি দিলেন, নাপিতকে কিছু বললেন না। তাতে টুনটুনির ভারি রাগ হল। ইঁদুরের কাছে গিয়ে বললে, ‘ইঁদুরভাই, ইঁদুরভাই, বাড়ি আছ?’

ইঁদুর বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি এক কাজ করে।’ ইঁদুর বললে, ‘কি কাজ?’

টুনটুনি বললে, ‘রাজামশাই যখন ঘুমিয়ে থাকবেন, তখন গিয়ে তাঁর ভুঁড়িটা কেটে ফুটো করে দিতে হবে।’

তা শুনে ইঁদুর জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বললে, ‘ওরে বাপরে! আমি তা পারব না।’ তাতে টুনটুনি রাগ করে বিড়ালের কাছে গিয়ে বললে, ‘বিড়ালভাই, বাড়ি আছ?’

বিড়াল বললে, ‘কে ভাই? টুনি ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি ইুঁদর মার।’

বিড়াল বললে, ‘এখন আমি ইঁদুর-টিদুর মারতে যেতে পারব না, আমার বড্ড ঘুম পেয়েছে।’ শুনে টুনটুনি রাগের ভরে লাঠির কাছে গিয়ে বললে, ‘লাঠি ভাই, লাঠি ভাই, বাড়ি আছ?’

লাঠি বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বসস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’ টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি বিড়ালকে ঠেঙাও।’

লাঠি বললে, ‘বিড়াল আমার কি করেছে যে আমি তাকে ঠেঙাতে যাব? আমি তা পারব না।’ তখন টুনটুনি আগনের কাছে গিয়ে বললে, ‘আগুনভাই, আগুনভাই, বাড়ি আছ?’

আগুন বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাই খাই, যদি তুমি লাঠি পোড়াও।’

আগুন বললে, ‘আজ ঢের জিনিস পুড়িয়েছি, আজ আর কিছু পোড়াতে পারব না।’ তাতে টুনটুনি তাকে খুব করে বকে, সাগরের কাছে গিয়ে বললে, ‘সাগরভাই, সাগরভাই, বাড়ি আছ?’

সাগর বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাই খাই, যদি তুমি আগুন নিবাও।’

সাগর বললে, ‘আমি তা পারব না।’ তখন টুনটুনি হাতির কাছে গিয়ে বললে, ‘হাতিভাই, হাতিভাই, বাড়ি আছ?

হাতি বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি সাগরের জল সব খেয়ে ফেল।’

হাতি বললে, ‘অত জল খেতে পারব না, আমার পেট ফেটে যাবে।’

কেউ তার কথা শুনল না দেখে টুনটুনি শেষে মশার কাছে গেল। মশা দূর থেকে তাকে দেখেই বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি হাতিকে কামড়াও।’

মশা বললে, ‘সে আবার একটা কথা! এখুনি যাচ্ছি! দেখব হাতি বেটার কত শক্ত চামড়া!’ বলে, সে সকল দেশের সকল মশাকে ডেকে বললে, ‘তোরা আয় তো রে ভাই, দেখি হাতি বেটার কত শক্ত চামড়া! অমনি পীন্-পীন্-পীন্-পীন্ করে যত রাজ্যের মশা, বাপ বেটা ভাই বন্ধু মিলে হাতিকে কামড়াতে চলল। মশায় আকাশ ছেয়ে গেল, সূর্য ঢেকে গেল। তাদের পাখার হাওয়ায় ঝড় বইতে লাগল। পীন্-পীন্-পীন্-পীন্ ভয়ানক শব্দ শুনে সকলের প্রাণ কেঁপে উঠল। তখন-

হাতি বলে, আগুন শুষি।

সাগর বলে, আগুন নেবাই!

আগুন বলে, লাঠি পোড়াই!

লাঠি বলে, বিড়াল ঠেঙাই!

বিড়াল বলে, ইঁদুর মারি।

ইঁদুর বলে, রাজার ভুঁড়ি কাটি!

রাজা বলে, নাপতে বেটার মাথা কাটি!

নাপিত হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘রক্ষে কর, টুনিদাদা! এস তোমার ফোঁড়া কাটি।

তারপর টুনটুনির ফোঁড়া সেরে গেল, আর সে ভারি খুশি হয়ে আবার গিয়ে নাচতে আর গাইতে লাগল-টুনটুনা টুন্ টুন্ টুন্! ধেই ধেই!


 টুনটুনি আর বিড়ালের কথা 


গৃহস্থের ঘরের পিছনে বেগুন গাছ আছে। সেই বেগুণ গাছের পাতা ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে টুনটুনি পাখিটি তার বাসা বেঁধেছে।

বাসার ভিতর তিনটি ছোট্ট-ছোট্ট ছানা হয়েছে। খুব ছোট্ট ছানা, তারা উড়তে পারে না, চোখও মেলতে পারে না। খালি হাঁ করে আর চীঁ-চীঁ করে।

গৃহস্থের বিড়ালটা ভারি দুষ্টু। সে খালি ভাবে ‘টুনটুনির ছানা খাব।’ একদিন সে বেগুন গাছের তলায় এসে বললে, ‘কি করছিস লা টুনটুনি?’

টুনটুনি তার মাথা হেঁট করে বেগুণ গাছের ডালে ঠেকিয়ে বললে, ‘প্রণাম হই, মহারানী!’ তাতে বিড়ালনী ভারি খুশি হয়ে চলে গেল।

এমনি সে রোজ আসে, রোজ টুনটুনি তাকে প্রণাম করে আর মহারানী বলে, আর সে খুশি হয়ে চলে যায়।

এখন টুনটুনির ছানাগুলি বড় হয়েছে, তাদের সুন্দর পাখা হয়েছে। তারা আর চোখ বুজে থাকে না। তা দেখে টুনটুনি তাদের বললে, ‘বাছা, তোরা উড়তে পারবি?’

ছানারা বললে, ‘হ্যাঁ মা, পারব।’ টুনটুনি বললে, ‘তবে দেখ তো দেখি, ঐ তাল গাছটার ডালে গিয়ে বসতে পারিস কি না।’

ছানারা তখনই উড়ে গিয়ে তাল গাছের ডালে বসল। তা দেখে টুনটুনি হেসে বললে, ‘এখন দুষ্টু বিড়াল আসুক দেখি!’

খানি বাদেই বিড়াল এসে বললে, ‘কি করছিস লা টুনটুনি?’

তখন টুনটুনি পা উঁচিয়ে তাকে লাথি দেখিয়ে বললে, ‘দূর হ, লক্ষ্মীছাড়ী বিড়ালনী!’ বলেই সে ফুডুক করে উড়ে পালাল।

দুষ্টু বিড়াল দাঁত খিঁচিয়ে লাফিয়ে গাছে উঠে, টুনটুনিকেও ধরতে পারলে না, ছানাও খেতে পেল না। খালি বেগুন কাঁটার খোঁচা খেয়ে নাকাল হয়ে ঘরে ফিরল।

COMMENTS

Name

Andrew-Kishore,1,অগ্নিপুরুষ,10,অনীশ,2,অন্য-ভুবন,3,আজ-হিমুর-বিয়ে,3,আবু-ইসহাক,1,আমি-এবং-আমরা,3,আমিই-মিসির-আলি,3,উপন্যাস,15,উপেন্দ্রকিশোর-রায়চৌধুরী,2,একজন-হিমু-কয়েকটি-ঝিঁঝিঁ-পোকা,5,এবং-হিমু,5,কবিতা,2,কহেন-কবি-কালিদাস,2,কাজী-আনোয়ার-হোসেন,18,কাজী-নজরুল-ইসলাম,2,গজল,1,গল্প,3,গানের-লিরিক,9,চলে-যায়-বসন্তের-দিন,3,চোখ,1,ছোট-গল্প,35,ছোটদের-গল্প,17,জলের-গান,1,জেমস,2,তন্দ্রাবিলাস,3,তোমাদের-এই-নগরে,4,দক্ষিণারঞ্জন-মিত্র-মজুমদার,1,দরজার-ওপাশে,4,দেবী,7,দেশাত্ববোধক-কবিতা,1,দেশাত্ববোধক-গান,2,নিশীথিনী,4,নিষাদ,3,পঞ্চতন্ত্র,1,পাগলা-দাশু,4,পারাপার,4,পুফি,3,বইয়ের-তালিকা,1,বাঘবন্দি,3,বিখ্যাত-গান,3,বিপদ,2,বৃহন্নলা,2,ভয়,5,মজার-গল্প,23,ময়ূরাক্ষী,4,ময়ূরাক্ষীর-তীরে-প্রথম-হিমু,1,মাসুদ-রানা,18,মিসির-আলি-UNSOLVED,4,মিসির-আলি-আপনি-কোথায়,3,মিসির-আলি-সমগ্র,55,মিসির-আলির-অমিমাংসিত-রহস্য,3,মিসির-আলির-চশমা,3,মুহম্মদ-জাফর-ইকবাল,1,মোশতাক-আহমেদ,1,মোহাম্মাদ-জসীম-উদ্দীন-মোল্লা,2,যখন-নামিবে-আঁধার,2,রবীন্দ্রনাথ-ঠাকুর,3,রম্যগল্প,4,রাধারানী-দেবী,1,রুপকথার-গল্প,4,শরৎচন্দ্র-চট্টোপাধ্যায়,2,শেখ-আবদুল-হাকীম,8,শ্রী-ক্ষিতীশচন্দ্র-কুশারী,1,সায়েন্স-ফিকশন,1,সুকুমার-রায়,7,সে-আসে-ধীরে,4,সেবা-প্রকাশনী,4,সৈয়দ-মুজতবা-আলী,1,স্বর্ণদ্বীপ,7,হরতন-ইশকাপন,2,হলুদ-হিমু-কালো-RAB,6,হাসির-গল্প,23,হিমু-এবং-একটি-রাশিয়ান-পরী,3,হিমু-এবং-হার্ভার্ড-PhD-বল্টু-ভাই,7,হিমু-মামা,6,হিমু-রিমান্ডে,9,হিমু-সমগ্র,80,হিমুর-দ্বিতীয়-প্রহর,3,হিমুর-বাবার-কথামালা,8,হুমায়ূন-আহমেদ,135,
ltr
item
গল্প এর বই: টুনটুনির বই - উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
টুনটুনির বই - উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
চলুন কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আসি ছোটবেলার সেই দিনগুলো থেকে গল্পগুলো পড়ে খুব মিস করছি ছোটবেলার সেই দিনগুলি ।। শিয়াল পন্ডিত কুঁজো বুড়ি চড়াই ও কাকের কথা
গল্প এর বই
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/06/tuntunir-golper-boi.html
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/
https://golpoerboi.blogspot.com/2021/06/tuntunir-golper-boi.html
true
2280349116972597382
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content