দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব মিসির আলি সমগ্র যখন নামিবে আঁধার - হুমায়ূন আহমেদ ২১২ বি ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দার মতো আছে। সেখানে কবীর সাহেব চাপাচাপ
দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব
মিসির আলি সমগ্র
যখন নামিবে আঁধার - হুমায়ূন আহমেদ
২১২ বি ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দার মতো আছে। সেখানে কবীর সাহেব চাপাচাপি করে দুটা লাল লঙের প্লাস্টিকের চেয়ার এবং টেবিল ঢুকিয়েছেন।
নিয়ে দেখছেন। মিসির আলির ধারণা কাক-দম্পতিও বিষয়টা টের পেয়েছে। মনুষ্য সম্প্রদায়ের কেউ-একজন তাদের প্রতি লক্ষ রাখছে, এটা তারা জানে। বিষয়টাতে কাক-দম্পতি মনে হয় খানিকটা চিন্তিত।
দুপুর বারোটার মতো বাজে। জসু কিছুক্ষণ আগে প্লেটে করে সিঙারা দিয়ে গেছে। গরম সিঙারা, ভাপ উঠছে, কিন্তু কেন জানি মিসির আলির খেতে ইচ্ছা করছে না। এটাও বয়স হওয়ার লক্ষণ। ক্ষিধে হবে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করবে না।
মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন, বিদেশিনী এক তরুণী হোটেলের বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটির পরনে ঘাগড়া জাতীয় পোশাক। মাথায় স্কাফ। চোখে রোদ চশমা। মেয়েটি এগিয়ে আসছে মিসির আলির দিকে। মিসির আলি বাইনোকুলার নামিয়ে তরুণীর দিকে তাকালেন। তরুণী বলল, চাচাজি, কেমন আছেন? আমার নাম পারুল। চম্পার বড় বোন পারুল। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এসেছি। আমি কি আপনার সামনের চেয়ারটায় বসতে পারি?
চম্পা-পারুলদের কেউ হোটেল খুঁজে বের করে চলে আসবে, এটা মিসির আলি ভাবেন নি। পারুল মেয়েটা যে এত রূপবতী তাও ভাবেন নি। বিস্ময় চাপা দিয়ে মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, বসতে পারো। বোরকা নেই, ব্যাপার কী?
আমি তো কখনো বোরকা পরি না। আমার ছোটবোন পরে।
তোমার ছোটবোন কি তোমার মতোই রূপবতী?
জি। আমরা যমজ বোন। তবে আমার চোখ নীল, ওর চোখ কালো।
পারুল বসতে বসতে বলল, চাচাজি, আমি দূর থেকে দেখেছি আপনি বাইনোকুলার চোখে দিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী দেখছিলেন?
কাক দেখছিলাম।
কাক?
হ্যাঁ কাক। কেন কাক দেখছিলাম, এইসব জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করবে না। আমার কাছে কী জন্যে এসেছে সেটা বলে।
আপনাকে আপনার আগের বাসায় নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনার পা ধরে বসে থাকব।
মিসির আলি কিছু বোঝার আগেই পারুল চেয়ার থেকে মেঝেতে নেমে এসে দুহাতে পা চেপে ধরল।
মিসির আলি বললেন, পা ধরা অতি গ্ৰাম্য ব্যাপার। পা ছাড়ো।
পারুল বলল, গ্রাম্য ব্যাপার হোক বা আধুনিক ব্যাপার হোক, আমি আপনার পা ছাড়ব না।
আমাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছি কেন?
আমরা দুই বোন মহাবিপদে পড়েছি। আপনি আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। কী রকম বিপদ শুনলে আপনি চমকে উঠবেন।
কী রকম বিপদ বলো?
আমাদের মৃত শ্বশুর ফিরে এসেছেন। বাসায় ঘোরাফিরা করছেন। খাওয়াদাওয়া করছেন। আপনার কথাও জিজ্ঞেস করলেন। আপনি কোথায় গেছেন জানতে চাইলেন।
মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, আমি এই মুহুর্তে যদি তোমার সঙ্গে যাই তাকে দেখতে পাব?
হ্যাঁ দেখতে পাবেন।
একজন মৃত মানুষ জীবিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
জি।
মিসির আলি হাতের বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, চলে যাই।
দুর্বল মানুষের সমস্যা হচ্ছে, তারা নানান ধরনের ডিলিউশনে ভুগে। এই রোগ আবার সংক্রামক। একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে যায়। মাস হিস্টিরিয়াও আছে। মানবগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের ডিলিউশনের শিকার হওয়ার ঘটনাও আছে। ইউরোপের ডাইনি অনুসন্ধান ছিল বড় ধরনের ডিলিউশন।
মিসির আলি নিশ্চিত, মল্লিক সাহেবের পরিবার দুই পুত্রবধূ ডিলিউশনে ভুগছে। তারা মৃত মল্লিককে ঘুরে ফিরে বেড়াতে দেখছে। মৃত মানুষকে জীবিত দেখা সাধারণ পর্যায়ের ডিলিউশন। অনেক পিতা-মাতাই তাদের মৃত সন্তানদের জীবিত দেখেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। এই বিষয়ে প্রচুর কাজ করেছেন Christopher Bird। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম The Secret Life of Dead People। উপন্যাসের চেয়েও সুখপাঠ্য বই।
পারুল মিসির আলিকে তাদের মূল বাড়িতে নিয়ে এল। দোতলার একটা ঘরে ঢুকিয়ে বলল, চাচাজি, আপনি এই ঘরে অপেক্ষা করুন। আমি এখান থেকে আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব। অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখোব। আপনি কি চা-কফি কিছু খাবেন?
না।
আপনি খবরের কাগজ পড়ুন। আমি আসছি।
চারদিনের বাসি খবরের কাগজ টেবিলে পড়ে আছে। খাবার বাসি হলে যেমন দুৰ্গন্ধ ছড়ায়, বাসি খবরের কাগজও একই রকম দুৰ্গন্ধ ছড়ায়।
পারুল পাঁচ দশ মিনিটের কথা বলে গিয়েছিল। চল্লিশ মিনিট পার হওয়ার পর মিসির আলির হঠাৎ করেই সন্দেহ হলো—পারুল নামের মেয়েটা তাকে এই ঘরে আটকে ফেলেছে। ঘরের দরজা তালা দেওয়া। তিনি চেষ্টা করলেও সেই তালা খুলতে পারবেন না।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছে গেলেন, দরজা খুলতে পারলেন না। দরজা সত্যি সত্যি তালা দেওয়া। মিসির আলি দরজা ধাক্কাধাব্ধি কিংবা “পারুল পারুল’ বলে ডাকাডাকির ভেতর দিয়ে গেলেন না। ঘরের ভেতরটা ভালোমতো দেখতে শুরু করলেন।
গেস্ট রুম বা অতিথি কক্ষের মতো ঘর। সিঙ্গেল খাট পাতা আছে। খাটে বালিশ এবং চাদর পরিষ্কার। এই ঘরে কেউ ঘুমায় না।
আসবাবপত্রের মধ্যে একটা আলনা আছে, জানালার কাছে লেখালেখির জন্যে চেয়ার-টেবিল আছে। টেবিলে পুরনো রিডার্স ডাইজেস্টের দু’টা কপি এবং নেয়ামুল কোরান গ্ৰন্থ আছে। যে জানালার পাশে টেবিল-চেয়ার আছে, সেই জানালা বাইরে থেকে বন্ধ।
ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচিড বাথরুম আছে। বাথরুম অনেকদিন ব্যবহার হয় না। বাথরুমের র্যাকে সাবান-শ্যাম্পু আছে। ধোয়া টাওয়েল আছে। কমোডের ওপর ফ্লাশ-বেসিনে তিন মাস আগের একটা টাইম পত্রিকা দেখে মিসির আলি অবাক হলেন। মল্লিক সাহেবের বাড়ির কারোরই টাইম পত্রিকা পড়ার কথা না।
ঘরে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। বেশিরভাগ গেষ্টরুমের দেয়াল ঘড়ি ব্যাটারি শেষ হওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে থাকে। অতিথি এলেই নতুন ব্যাটারি লাগানো হয়। এই ঘড়ির কাটা সচল আছে। এখন বাজছে একটা পঁচিশ। মিসির আলির ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। টেনশনে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়।
দেয়াল ঘড়ি ছাড়াও গাঢ় লাল রঙের একটা টেলিফোন সেট আছে। মিসির আলি রিসিভার কানে দিলেন। পাতালের নৈঃশব্দ্য। লাইন কাটা। এটা যুক্তিযুক্ত। বন্দিশালায় টেলিফোন থাকবে না।
মিসির আলি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। আবহাওয়া আরামদায়ক শীতল। ক্ষুধার্তা মানুষেরা সহজে ঘুমুতে পারে না, কিন্তু মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর ঘুম ভাঙল তিনটা দশে। প্রায় দুঘণ্টার আরামদায়ক ঘুম।
মিসির আলি মূল দরজা এবং টেবিলের সামনের জানালা পরীক্ষা করলেন। দুটা এখনো বন্ধ। তিনি যথেষ্টই ক্ষুধার্তা বোধ করছেন। তাঁকে খাবার দেওয়া হবে। কি না বুঝতে পারছেন না। তাকে আটকে রাখার উদ্দেশ্যও পরিষ্কার হচ্ছে না। পারুল মেয়েটা তার কাছে কী চাচ্ছে? মানুষের ধর্ম হলো, যাকে সে ভয় পাবে তাকে আটকে ফেলার চেষ্টা করবে। পারুল মেয়েটা কি তাকে ভয় পাচ্ছে? কিসের ভয়? তার কোনো গোপন কথা জেনে ফেলার ভয়।
গোপন কথা দূরে থাকুক, পারুল ও তার বোন চম্পা সম্পর্কে তিনি প্রকাশ্য কোনো কথাও জানেন না। তিনি শুধু জানেন, এই বাড়ির ওপর এক ধরনের অসুস্থতা ভর করে আছে।
রাত এগারটা বাজে। মিসির আলিকে এখন পর্যন্ত কোনো খাবার দেওয়া হয় নি। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগের চেষ্টাও কেউ করে নি।
তিনি কয়েকবার দরজা ধাক্কাধাব্ধি করেছেন। ‘পারুল পারুল’ বলে ডেকেছেন। কেউ সাড়া দেয় নি।
মিসির আলির কাছে মনে হচ্ছে, তালাবন্ধ অবস্থায় তিনি ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ি নিঃশব্দ, নিচুপ।
মিসির আলি টাইম পত্রিকা, রিডার্স ডাইজেস্ট এবং নেয়ামুল কোরান গ্রন্থের সবটা পড়ে শেষ করেছেন। নেয়ামুল কোরান পড়তে গিয়ে মিসির আলি বুঝতে পারলেন এই ঘরে আরও একজনকে আটকে রাখা হয়েছিল। সে নেয়ামুল কোরান গ্রন্থের অনেক জায়গায় যেসব কথা লিখেছে তা হলো—
১. আমাকে কত দিন তালাবন্ধ করে রাখবি?
২. ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি, খাওয়া দে।
৩. আমি তোরে ছাড়ব না। তোরে এইভাবে আটকায়ে রাখব।
৪. হে আল্লাহপাক। হে গাফুরুর রহিম। আমাকে উদ্ধার করো।
যাকে আটকে রাখা হয়েছিল তার নাম পারুল। এই তথ্য বের করতে মিসির আলির তেমন বেগ পেতে হয় নি। বালিশে পারফিউমের গন্ধ পেয়েছেন। এই গন্ধ তার চেনা।
প্রাইভেট জেলখানা থেকে মুক্তির একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে। এই বুদ্ধি কতটা কার্যকর হবে তা মিসির আলি এখনো বুঝতে পারছেন না।
মূল দরজাটি কাঠের। এই দরজা কি আগুন দিয়ে জ্বলিয়ে দেওয়া যাবে? পুরনো দরজা, শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আছে। কোনোরকমে দরজার এক কোনায় আগুন লাগালে দরজা পুড়ে যাবে।
আগুন লাগানোর জন্যে ম্যাচ বাক্স তার কাছে আছে। ম্যাচ বাক্সে এগারটা কাঠি। এগারবার জ্বালানো যাবে। কাগজ আছে। ধৈর্য ধরে দরজার একটা কোনায় আগুন ধরাতে হবে। কাজটা করতে হবে ভোেররাতে। যখন সবাই থাকবে ঘুমে। দরজার আগুন বা ধোয়ার বিষয়টা কারও চোখে পড়বে না। বাথরুমে তিনি শ্যাম্পূর একটি বোতল দেখেছেন। কিছু কিছু শ্যাম্পু যথেষ্ট দাহ্য। শ্যাম্পূর বোতলটা নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে।
খাটের নিচে তিনি একটা ফিডার পেয়েছেন। প্লাষ্টিকের ফিডারে আগুন ধরলে ধিকি ধিক করে অনেকক্ষণ জুলবে। কাঠের দরজার এক কোনায় আগুন ধরে যাওয়ার কথা। দরজায় চাকু দিয়ে দাগ দিতে পারলে হতো। এতে দরজার সারফেস এরিয়া বাড়বে।
রাত তিনটায় মিসির আলি দরজা পোড়ানোর সময় নির্ধারণ করলেন। রাত তিনটা ভালো সময়। তিন প্রাইম নম্বর। পিথাগোরাসের মতে, অতি রহস্যময় সংখ্যা।
দরজা পুড়িয়ে বের হওয়ার বুদ্ধি কাজ করল না। দরজার এক কোনায় আগুন ঠিকই জ্বলল, তবে সে আগুন স্থায়ী হলো না। দরজার খানিকটা পুড়িয়ে নিভে গেল। লাভের মধ্যে লাভ এই হলো যে, দরজা পোড়ানোর উত্তেজনায় মিসির আলির রাত কাটল নির্ঘুম। শরীরে ধস নেমে গেল।
বেঁচে থাকার জন্যে শরীরকে মোটামুটি ঠিক রাখতে হবে। প্রচুর পানি খেতে হবে। তা তিনি খাচ্ছেন। বাথরুমের বেসিন থেকে নিয়ে মগভর্তি পানি। কিছুক্ষণ পরপর পানি। তার মন বলছে বাথরুমের বেসিনের পানি থাকবে না। যে তাকে আটকেছে সে পানি বন্ধ করে দেবে। তখন প্রবল তৃষ্ণায় কমোডের পানি ছাড়া গতি থাকবে না।
ক্ষুধার যন্ত্রণা কমে আসছে। কাজটি করছে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক যখন দেখে খাবার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন ক্ষিধে কমিয়ে দেয়। শরীরে জমে থাকা চর্বি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। একজন সবল মানুষ কোনো খাদ্য গ্ৰহণ না করে চল্লিশ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
মিসির আলি কোনো সবল মানুষ না। নানান অসুখে পর্যাদস্ত একজন মানুষ। তিনি ধরে নিয়েছেন, এইভাবে তিনি বেঁচে থাকতে পারবেন। দশ দিন। এর বেশি না। তবে শেষ দিনগুলো খুব কষ্টকর হবে না। তার হেলুসিনেশন শুরু হবে। বাস্তবতার দেয়াল ভেঙে যাবে। তিনি ঢুকে পড়বেন অবাস্তব এক জগতে। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে অনেকবার সেই জগতে তার ঢোকার ইচ্ছে হয়েছে। ইচ্ছে এখন পূর্ণ হতে চলছে, কিন্তু তার ভালো লাগছে না।
বন্দি অবস্থায় মিসির আলি আটান্ন ঘণ্টা পার করলেন। ক্ষুধাবোধ এখন পুরোপুরি চলে গেছে। তৃষ্ণা আছে, তবে তা কম। বেসিনের কলের পানি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি শেষ পানি কখন খেয়েছেন তা মনে করতে পারছেন না। প্ৰবল ক্লান্তি তাকে ভর করেছে। সময় কাটাচ্ছেন বিছানায় শুয়ে। হেলুসিনেশন শুরু হয়েছে। শুরুটা হলো ঘড়ি দিয়ে। মিসির আলি হঠাৎ দেখলেন ঘড়ির কাটা উল্টোদিকে ঘুরছে।
মিসির আলি মনে মনে বললেন, ইন্টারেস্টিং। হাতে কাগজ-কলম থাকলে হেলুসিনেশনের ধাপগুলো লিখে ফেলতে পারতেন। হাতে কাগজ-কলম নেই।
ঠিক তিনটা বাজার সময় ঘড়ি উল্টোদিকে চলা শুরু করেছিল। এখন বাজছে দুটা। ঘড়ির কাটা কি দ্রুত ঘুরছে? তিনি বুঝতে পারলেন না।
মিসির আলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙলে দেখেন, তিনি বাইনোকুলার হাতে হোটেলের বারান্দায় বসে আছেন। কাক-দম্পতি দেখছেন। তিনি কি সত্যি হোটেলের বারান্দায়? নাকি এটিও হেলুসিনেশন? যখন কাক মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করল তখন বুঝলেন এটা হেলুসিনেশন।
কাক বলল, মানুষের যেমন প্রাইভেসি আছে, আমাদেরও আছে। আপনি সারাক্ষণ বাইনোকুলার ফিট করে রাখছেন, এটা কি ঠিক? আপনার ওপর কেউ বাইনোকুলার ফিট করে রাখলে আপনার ভালো লাগত?
মিসির আলি বললেন, না।
কাক বলল, সবারই অনেক প্রাইভেট ব্যাপার আছে। হাগা-মুতা আছে। ঠিক কি না। স্যার আপনি বলেন?
মিসির আলি বললেন, অবশ্যই ঠিক। আমি দুঃখিত। আর বাইনোকুলার ধরব না।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। কতক্ষণ ঘুমালেন তিনি জানেন না। হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভাঙল অথবা দীর্ঘ সময় ঘুমালেন। ঘুম ভাঙলে প্রথমেই ঘড়ি দেখলেন। ঘড়ি উল্টাদিকে যাচ্ছে না। স্থির হয়ে আছে। ঘড়ির হিসাবে সময় এখন বারোটা। দিন বা রাত বোঝা যাচ্ছে না।
বাথরুম থেকে শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে কেউ থালাবাসন ধুচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, কে?
কিশোরীদের মিষ্টি গলায় কেউ একজন বলল, চাচাজি! আমি চম্পা।
মিসির আলি হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, আবার হেলুসিনেশন শুরু হয়েছে।
মিসির আলি বললেন, বাথরুমে কেন? সামনে আসো।
চাচাজি! আমি বাথরুম পরিষ্কার করছি। আমার হাতে হাতমোজা নেই বলে আপনার সামনে আসতে পারব না। আপনার সামনে এলে আপনি আমার হাত দেখে ফেলবেন। আমার বিরাট পাপ হবে। শেষ বিচারের দিন জবাব দিতে পারব না।
মিসির আলি বললেন, ও আচ্ছা।
চম্পা বলল, শরীরের উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে তো চাচাজি। কাউকেই এখন শরীর দেখাই না। হাত পায়ের আঙুল, চোখ, সব লুকিয়ে রাখি। চাচাজি! এই ঘরটা কি চিনতে পারছেন?
না।
আপনার এত বুদ্ধি, আর সাধারণ ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না। ঘরে একটা মাত্র জানালা। সেই জানোলা কঠিনভাবে বন্ধ।
মিসির আলি বললেন, এই ঘরেই কি তুমি তোমার শ্বশুর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসো?
চম্পা বলল, আপনি খুব সুন্দর করে বললেন, দেখা করতে আসি। আমি দেখা করতে আসি না। বাধ্য হয়ে ভয়ংকর কিছু কর্মকাণ্ডের জন্যে আসি।
মিসির আলি বললেন, তুমি আমাকে আটকে রেখেছ কেন?
চম্পা বলল, আমি আপনাকে আটকে রাখি নি। বড়পা রেখেছে।
কেন?
বড়পা এই ঘরে অনেক দিন আটক ছিল। এই দুঃখে সে সবাইকেই এভাবে আটকে রাখতে চায়।
কত দিন আটকে রাখবে?
জানি না। মনে হয় ছাড়বে না।
ছাড়বে না?
না। চাবি কুয়ায় ফেলে দিয়েছে তো। দরজা খুলবে কীভাবে?
সেটাও একটা কথা।
চাচাজি! আমি এখন যাই। পরে আসব। হাতমোজা পরে আসব, তখন আপনার সামনে আসা যাবে। গল্প করা যাবে।
আচ্ছা।
আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসব। আপনি আরাম করে সিগারেট খাবেন।
শেষ হয়ে গেছে।
চম্পা বলল, অবশ্যই দিয়াশলাই আনব। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন তো চাচাজি। আপনার ঘুম দরকার। ঘুমপাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াব?
মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, গান লাগবে না। এমনিতেই ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
মিসির আলি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
একসময় ঘুম ভাঙল। তিনি অবাক হয়ে দেখেন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে ঘরের ভেতর। কাক-দম্পতির বাসও ঘরের ভেতর। বৃষ্টিতে ভিজে দুটা কাক শীতে থারথার করে কাঁপছে। পুরুষ কাকটা মিসির আলিকে বলল, স্যার, একটা ছাতা দিতে পারবেন? প্লিজ!
মিসির আলি বললেন, ছাতা পাব কোথায়? তাকিয়ে দেখো, আমিও ভিজছি।
কাক বলল, একটা কিছু ব্যবস্থা কি করা যায় স্যার? বৃষ্টির পানি ভয়ংকর ঠান্ডা। ডিমগুলো পুরোপুরি ভিজে গেলে আর বাচ্চা ফুটবে না।
মিসির আলি বললেন, তোমার বাসাটা কি আমার খাটের নিচে আনতে পারো? তাহলে বৃষ্টির পানির হাত থেকে বাঁচতে পারো।
থ্যাংক য়্যু স্যার। ভালো সাজেশন।
কাকা-দম্পতি অনেক কষ্টে বাসাটা খাটের দিকে আনছে। বাসা মিসির আলির হাতের নাগালে চলে এসেছে। তিনি ইচ্ছা করলেই হাত বাড়িয়ে বাসাটা ধরে খাটের নিচে চালান করে দিতে পারেন, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর সমস্ত শরীর অবশ। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মিসির আলির কেন জানি মনে হচ্ছে এবার ঘুমিয়ে পড়লে আর ঘুম ভাঙবে না। তিনি প্ৰাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করছেন।
স্যার স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আপনার ছাত্রী। আমার নাম রেবেকা।
ও আচ্ছা আচ্ছা।
চিনতে পারেন নি?
শরীরটা ভালো না তো। এইজন্যে সমস্যা হচ্ছে।
স্যার, আমি আপনাকে চামড়ায় বাধানো একটা খাতা দিয়েছিলাম।
এখন মনে পড়েছে। তুমি কেমন আছ?
আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনার একী অবস্থা!
একটু বেকায়দা অবস্থাতেই আছি। এরা আমাকে আটকে ফেলেছে।
কেন?
কেন তা তো জানি না।
স্যার, আপনি জানবেন না তো কে জানবে? আপনি হচ্ছেন মিসির আলি। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে বের করুন কেন তারা আপনাকে আটকেছে। এরা কি আপনার শত্রুপক্ষ?
না।
তাদের ক্ষতি হয় এমন কিছু কি আপনি করেছেন?
না।
আপনাকে আটকে রাখলে তাদের কি কোনো স্বার্থসিদ্ধি হয়?
না!
আপনার চিন্তা করার ক্ষমতা ঠিক আছে কি না, সেই পরীক্ষা কি করবেন?
কী পরীক্ষা?
ক্লিৎস টেস্ট। স্যার, মনে পড়েছে?
হ্যাঁ, পড়েছে। ১০০ থেকে নিচের দিকে নামতে হবে।
প্রথমবার একটি সংখ্যা বাদ দিয়ে নিচে নামা।। ১০০ থেকে হবে ৯৮, তারপর দুটা সংখ্যা বাদ ৯৫, তারপর তিন সংখ্যা বাদ ৯১।
স্যার, পরীক্ষা দিতে থাকুন। এই ফাঁকে আমি পানি এনে দিচ্ছি। পানি খান।
পানি কোথায় পাবে? পানি তো বন্ধ।
আমি কমোড থেকে পানি আনব। আপনি কল্পনা করবেন ঝরনার পবিত্ৰ পানি খাচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্যে আপনার পানি খাওয়াটা জরুরি। ঠিক না। স্যার?
হ্যাঁ ঠিক।
মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি কতক্ষণ ঘুমালেন তা জানেন না। পানির পিপাসায় তাঁর বুক শুকিয়ে গেছে। বিছানা থেকে নামার শারীরিক শক্তি তাঁর নেই।
মাথার কাছে দুঃখিত চোখমুখ করে পারুল দাঁড়িয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, পারুল। আমাকে একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?
আমি পারুল না। আমি এক ভূতনি। আমার নাম-হুড়বুড়ি।
ও আচ্ছা, তুমি হুড়বুড়ি?
জি হুড়বুড়ি। একটা ছড়া শুনবেন স্যার।
হুড়বুড়ি, থুরথুরি
বুড়বুড়ি, কুরকুরি
ফুরফুরি, ফুরফুরি
মিসির আলি বললেন, চুপ করো প্লিজ।
হুড়বুড়ি চুপ করল। তখন বেজে উঠল। লাল টেলিফোন। এই টেলিফোনের তার ছেড়া, তারপরেও বাজছে কেন? টেলিফোন নিশ্চয়ই বাজছে না। তিনি ভুল শুনছেন। তার বিভ্ৰান্তির কাল শুরু হয়েছে।
রিং হতে হতে টেলিফোন থেমে গেল। এখন ভাঙচুরের শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি বললেন, কী হচ্ছে?
হুড়বুড়ি বলল, স্যার! পুলিশ এসেছে। দরজা ভাঙছে। শব্দ শুনছেন?
মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, ও আচ্ছা পুলিশ।
পুলিশের সঙ্গে জসু আছে। মনে হয় সে-ই আপনাকে উদ্ধারের জন্যে পুলিশ এনেছে।
স্যার! দরজা ভেঙে ফেলেছে। তাকিয়ে দেখুন, পুলিশ ঢুকছে।
মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। তিনি পুলিশ দেখতে পাচ্ছেন। জসুকে দেখতে পাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে মল্লিক সাহেবও আছেন। একজন মৃত মানুষ। যার ডেডবডি কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। মৃত মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এটা নিশ্চয়ই হেলুসিনেশন।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন।
স্যার, চোখ মেলুন।
মিসির আলি চোখ মেললেন। তার কাছে মনে হলো তিনি হাসপাতালে আছেন। তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। একজন অল্পবয়সী ডাক্তার তার সামনে দাঁড়িয়ে। এই ডাক্তার লাল সোয়েটারের ওপর সাদা অ্যাপ্রন পরেছে। তাকে সুন্দর লাগছে।
স্যার, আপনি একটা প্রাইভেট হাসপাতালে আছেন এবং ভালো আছেন। আপনার শরীর খাদ্য গ্রহণের জন্যে এখনো তৈরি না বলে আপনাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। স্যার, আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?
পারছি।
পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে চান। কথা বলবেন?
হুঁ।
পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব এসে সামনে দাঁড়ালেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মিসির আলির এখন মনে হলো, তার হেলুসিনেশন হচ্ছে না। তিনি বাস্তবে বাস করছেন। হেলুসিনেশনের দৃশ্যগুলো চড়া রঙে আঁকা হয়। এখন তা না।
মিসির আলি বললেন, আমি কত দিন বন্দি ছিলাম?
রকিব বললেন, ছয় দিন।
আমি বন্দি-এই খবর আপনাদের কে দিল?
একজন মহিলা টেলিফোনে জানিয়েছেন। তার নাম পারুল।
কবে জানিয়েছে?
যেদিন আপনাকে আটকানো হয় তার পরদিন ভোরবেলা। আমরা তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে নেই নি। কারণ এই মহিলা উদ্ভট সব কথা বলছিলেন। তাঁর মৃত শ্বশুর জীবিত হয়ে ফিরে এসেছেন, এইসব হাবিজাবি।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। কথা বলতে বা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমুতে ইচ্ছে করছে।
পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন, স্যার, আপনি রেস্ট নিন। পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আপনার কিছু সাহায্যও আমাদের দরকার। মৃত মানুষকে জীবিত দেখার ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। একজন দাবি করছেন, তিনি মল্লিক সাহেব। তাঁর কর্মচারীরাও তা-ই বলছে।
মিসির আলি চোখ না মেলেই বললেন, একজন মৃত মানুষ কখনোই জীবিত হয়ে ফিরবে না। এটা মাথায় রাখুন। আমার ধারণা আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারব। তবে সুস্থ হওয়ার জন্যে আমাকে কিছুটা সময় দিন।
রকিব বললেন, অবশ্যই স্যার। অবশ্যই।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। চোখ মেললেন তের ঘণ্টা পর। শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
মুন হাউস হোটেলে ২১২ নম্বর ঘর। সময় সন্ধ্যা ৭টা।
মল্লিক সাহেব বসে আছেন। মল্লিক সাহেবের মুখ হাসি হাসি। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি আনন্দময় সময় কাটাচ্ছেন।
কিছুক্ষণ আগে ছোট্ট একটা নাটক হয়েছে। নাটক দেখেও তিনি তৃপ্তির হাসি হোসেছেন।
নাটকটার প্রধান চরিত্র জামু। সে মিসির আলির জন্যে চা নিয়ে এসেছিল। ঘরে ঢুকে মল্লিক সাহেবকে বসে থাকতে দেখে আর্ত চিৎকার দিল-ও আল্লাগো! হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। সে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মল্লিক সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, ভয় খাইছে। প্যান্টে পিশাব না করে দেয়।
মিসির আলি বললেন, ভয় পাওয়ারই কথা। সবার কাছে আপনি একজন মৃত মানুষ। আপনার শবদেহ কুয়া থেকে তোলা হয়েছে। তারপর আপনাকে জীবিত দেখা যাচ্ছে। আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সিগারেট খাচ্ছেন।
মল্লিক দাঁত বের করে তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, পুরা ঘেংড়া অবস্থা!
মিসির আলি বললেন, ঘেংড়া অবস্থা মানে কী?
অতিরিক্ত বেড়াছেড়াকে বলে ঘেংড়া অবস্থা। পাবলিক তো ভয় খাবেই। পাবলিকের ভয় খাওয়ারই কথা। পুলিশও ভয় খাচ্ছে। ঘটনা শোনেন, মজা পাবেন। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব সাহেবের সঙ্গে হাত মিলাবার জন্যে হাত বাড়ালাম, উনি লাফ দিয়ে দুই ফুট সরে গেলেন। একমাত্র আপনাকে দেখলাম ভয় খান নাই। আপনাকে দেখে কিছুটা আচানক হয়েছি। আপনি কেন ভয় খান নাই?
মিসির আলি বললেন, আমি জানি মৃত মানুষ কখনো জীবিত হয়ে ফেরে না। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। এইজন্যে ভয় পাই নি।
মল্লিক সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, অন্য ব্যাপারটা কী? আমারে একটু বুঝায়ে বলেন।
মিসির আলি বললেন, আপনার যমজ ভাই আছে, যে দেখতে অবিকল আপনার মতো। সে মারা গেছে অথবা খুন হয়েছে। তার ডেডবডি কুয়ায় ফেলা হয়েছে। আপনার না।
কেউ জানল না-এটা কেমন কথা!
মিসির আলি বললেন, কেউ জানে না তা ঠিক না। আপনার দুই ছেলে তো প্রায়ই বলত, এরা দু’জন মল্লিককে দেখে। একজন ভালো। একজন মন্দ।
পাগলের কথা। আপনি ধরবেন? দুটাই পাগল। নির্বোধ পাগল। প্রায়ই দেখবেন। এরা কানে ধরে উঠবোস করছে। কেউ তাদের কানে ধরে উঠবোস করতে বলে নাই। তারপরেও করছে। বলুন তো কেন?
মিসির আলি বললেন, জানি না কেন?
অনুমান করতে পারেন?
না। অনুমানও করতে পারছি না।
মল্লিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই দুই ছাগলকে আমি প্রায়ই এক শ বার পঞ্চাশ বার কানে ধরে উঠবোস করতে বলি। এরা অ্যাডভান্স করে রাখে। খাতায় লেখা থাকে। সেখান থেকে বাদ দেয়। এদের কোনো কথার উপর বিশ্বাস রাখা যায়? আপনি বলেন? পাগলের সাক্ষী কি কোর্ট গ্রাহ্য করবে? চুপ করে থাকবেন না। কথা বলেন।
মিসির আলি বললেন, পাগলের সাক্ষ্য কোর্ট গ্রাহ্য করে না।
এই তো এখন পথে আসছেন। বড় পুত্ৰ ছক্কার ছেলে মারা গেল। কিসমত নাম। তার মধ্যে কোনো বিকার নাই। এক ফোঁটা চোখের পানি নাই। আরেকজনের বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে।
মিসির আলি বললেন, কিসমত কার ছেলে এই নিয়ে মনে হয় বিতর্ক আছে।
মল্লিক বললেন, কোনো বিতর্ক নাই রে ভাই। বিতর্ক দুই বদ পুলার দুই বদ স্ত্রী তৈরি করেছে। কুৎসিত নোংরা কথা চালু করেছে। এইজন্যে এদের একজনরে আমি ডাকি বড়কুত্তি, আরেকজনরে ডাকি ছোটকুত্তি। আরে কুত্তি, তোদের শ্বশুর নাকি তোদের তার সাথে সেক্স করতে বলে। এ রকম ঘটনা ঘটলে তোরা কেন সোনামুখ করে তার কাছে যাবি? কেন পাবলিকরে বলবি না? পুলিশের কাছে যাবি না? মিসির আলি সাহেব, বলেন, আমার কথায় কি যুক্তি আছে?
মিসির আলি বললেন, যুক্তি আছে।
মল্লিক বললেন, বড়কুত্তিটা আবার বলে তার কোনো সন্তানাদি নাই। আরে কুত্তি, সিজারিয়ান করে তোর পেটের সন্তান বের করা হয়েছে। পেটে সিজারিয়ানের দাগ আছে।
মিসির আলি বললেন, সে তাহলে মিথ্যাটা কেন বলছে?
মল্লিক সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি জানি না। আমি যেমন জানি না, যারা এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে তারাও জানে না। আমি ঘটনা জানার অনেক চেষ্টা নিয়েছি ভাইসাহেব। বড়কুত্তিটাকে তিন দিন খাওয়া পানি ছাড়া আটকায়ে রেখেছিলাম। ঘটনা কী বল। বললে ছাড়া পাবি।
ঘটনা বলেছে?
না, বলে নাই। তবে এই বিষয়ে আমার অনুমান একটা আছে! অনুমান সত্য কি না জানি না।
কী অনুমান শুনি?
দুই মেয়ে এই ধরনের কথা বলেছে যাতে আমার দুই পুত্র আমার উপর রাগ করে। আমাকে খুন করে। সমস্যা কি জানেন? আমার দুই পুত্রের রাগ করার ক্ষমতা নাই। একবার কী হলো ঘটনা শুনেন। বাড়ির একটা বিড়াল মটরগাড়ির চাকার নিচে পড়ে মারা গেল। আমার দুই পুত্ৰ দানাপানি বন্ধ করে দিল। দুইজনে দুইজনের গলা জড়ায়ে ধরে কাদে। আমি বললাম, বিড়াল তোদের বাপ না মা? বিড়াল মরে গেছে, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস? কানে ধরে পঞ্চাশবার উঠবোস কর, তারপর খেতে বস। তারা দু’জনেই বলল, জি আচ্ছা। পঞ্চাশবার কানে ধরে উঠবোস করল, তারপর মল্লিক বিরানি হাউস থেকে দুই প্লেট বিরানি খেয়ে ঘুমাতে গেল, যেন কিছুই হয় নাই। আমি যে কথাগুলি বললাম, সেগুলি কি বিশ্বাস হচ্ছে?
হচ্ছে।
এখন আপনাকে আসল কথা বলি। এতক্ষণ যা বললাম। সবই ফালতু কথা। আসল কথা হচ্ছে, আমি বাবা-মা’র এক সন্তান। আমার কোনো যমজ ভাই নাই। আপনি এবং পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও কোনো যমজ ভাইয়ের সন্ধান পাবেন না।
মিসির আলি বললেন, কুয়াতে যে ডেডবডি পাওয়া গেল সেটা তাহলে কার?
মল্লিক সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, খুঁজে বের করেন কার। সিআইডি মিআইডি কী কী যেন আছে, সবে মিলে খুঁজুক। বার করুক ডেডবডি কার। ইন্সপেক্টর রকিব সাহেব যদি প্রমাণ করতে পারেন ডেডবডি আমার যমজ ভাইয়ের, তাহলে আমি উনার পিশাব গ্রাসে ভর্তি করে চুমুক দিয়ে খাব। এক হাজার বার কানে ধরে উঠবোস করব। এখন ভাই আমি বিদায় নিব। আপনাকে একটা শেষ কথা বলি। আমার উপর কোনো রাগ রাখবেন না। আমি আপনাকে আটকাই নাই। বড়কুত্তি আটকায়েছে। সে ভালো সাজার জন্যে পরদিনই পুলিশকে টেলিফোন করেছে। এমনভাবে করেছে যে, পুলিশ তার কথা পাগলের প্রলাপ ভেবেছে। আমি যখন টের পেলাম ঘরে কেউ আটক আছে তখন থানা থেকে পুলিশ নিয়ে এলাম। রকিব সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেই আমার কথার সত্যতা পাবেন। ভাইসাহেব, ইজাজত দেন। বিদায় নেই। আসসালামু আলায়কুম।
ব্যক্তিগত কথামালায় মিসির আলির সর্বশেষ লেখা
বিষয় : মল্লিক সাহেব
পুলিশ ব্যাপক অনুসন্ধান করেও মল্লিক সাহেবের কোনো যমজ ভাই আছে তা প্ৰমাণ করতে পারে নি। আমি অনেক চেষ্টা করেও পুলিশকে DNA পরীক্ষায় রাজি করাতে পারি নি। মৃত মানুষ এবং মল্লিক সাহেবের DNA পরীক্ষার ফলাফল তদন্তে সাহায্য করত।
আমার কাছে মনে হচ্ছে, পুলিশ তদন্তের বিষয়েও আগ্রহী না। ছক্কা-বক্কাকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। তারা আগের মতোই আছে। দুই ভাই বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে। একসঙ্গে স্নান করছে। সময় পেলেই কানে ধরে উঠবোস করে খাতায় হিসাব জমা করছে। মন্ত্রিক সাহেব নিয়ম করে হোমিও ক্লিনিকে বসছেন। রোগী দেখছেন। সব আগের মতো চলছে।
মল্লিক পরিবারের রহস্য সমাধানের চেষ্টা আমি করেছি। সমাধান করতে পারি নি। মন্ত্রিক সাহেব সহায়তা করলে হয়তো কিছু হতো। তিনি সহযোগিতার ধারে কাছেও নাই। তিনি আমার কাছে যে একেবারেই আসেন না, তা না। মাঝে মধ্যেই আসেন, নানান বিষয়ে কথা বলেন, একটি বিষয় ছাড়া। অবিকল তাঁর মতো দেখতে যে মানুষটির মৃতদেহ কুয়া থেকে তোলা হলো সে কে? তার সঙ্গে মল্লিক, সাহেবের সম্পর্ক কী?
মাল্টিপল পার্সোনালিটি মনোবিজ্ঞানের স্বীকৃত বিষয়। একজন ভালো মানুষ এবং একজন মন্দ মানুষ একজনের মধ্যে বিকশিত হতে পারে। ভালো মানুষ মল্লিক এবং মন্দ মানুষ মল্লিক-একই ব্যক্তি। এটি মনোবিজ্ঞানে গ্রাহ্য। কিন্তু দু’জন আলাদা দুই মানুষ, যাদের একজনকে খুন করা যায়, তা কী করে হয়?
আমি চেষ্টা করেছি চম্পা ও পারুলের সঙ্গে কথা বলতে। তারা রাজি হয় নি।
এই দুই মেয়ে মল্লিককে খুন করেছে বলে যে দাবি করছে তা মিথ্যা। অ্যান্টাসি নামে কোনো ইঁদুর মারা বিষ নেই। অ্যান্টাসি নামটাও হঠাৎ করে তাদের মাথায় এসেছে। অ্যান্টাসিড থেকে ‘ড’ বাদ দিয়ে অ্যান্টাসি। মন্ত্রিক সাহেবের বাড়িতে গোটাচারেক বিড়াল আছে। যে বাড়িতে বিড়াল থাকে সে বাড়িতে ইঁদুর থাকে না।
আমি একপর্যায়ে জীবিত এবং মৃত মল্লিকের DNA পরীক্ষা নিজ খরচে করতে চেয়েছিলাম, তাও সম্ভব হলো না। পরীক্ষাটা হয় সিঙ্গাপুরে। যে পরিমাণ অর্থ পরীক্ষার জন্যে প্রয়োজন, তা আমার ছিল না।
আমি নিজেও মনে হয় মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। প্রায়ই যে ঘরে বন্দি ছিলাম সেই ঘর স্বপ্নে দেখি। স্বপ্নে লাল টেলিফোন বাজতেই থাকে। আমি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় একজন বলে–DNA টেস্ট করা হয়েছে। রিপোর্ট লিখে নিন। জীবিত এবং মৃত দু’জনের একই DNA, অর্থাৎ দু’জন একই ব্যক্তি।
স্বপ্ন আর কিছুই না, আমার নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন। আমি কি তাহলে ভাবছি, মৃত এবং জীবিত একই মানুষ? এর মানেই বা কী?
আমি মুন হাউস হোটেলের ২১২ নম্বর ঘরে এখনো আছি। কাক-দম্পতির ওপর লক্ষ রাখছি। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়েছে। কাক-দম্পতির সে-কী আনন্দ! তাদের আনন্দ দেখে মল্লিক পরিবারের জটিলতা ভোলার চেষ্টা করছি। যখন মনে হয় পুরোপুরি ভুলে গেছি, তখনই স্বপ্নে লাল টেলিফোন বেজে ওঠে। কেউ-একজন বলে, জীবিত এবং মৃত মল্লিক একই ব্যক্তি। প্লিজ, টেক নোট।
মিসির আলি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি কিছু খেতে পারেন না। রাতে ঘুমুতেও পারেন না। যখন চোখে ঘুম নেমে আসে, তখনই লাল টেলিফোন বাজতে থাকে। তিনি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসেন।
মিসির আলি তাঁর অসুখের কারণ ধরতে পেরেছেন। মল্লিক পরিবারের রহস্য সমাধানে তার ব্যর্থতা। নিজেকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন-ব্যর্থতা সফলতারই অংশ। দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকেও কখনো কখনো হার মানতে হয়। যেখানে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদেরই এই অবস্থা, সেখানে তার অবস্থান কোথায়! সাইকোলজির খেলায় তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন না। অনেক রহস্য তিনি ভেদ করেছেন, আবার অনেক রহস্যেরই কিনারা করতে পারেন নি। তার একটি খাতা আছে যার শিরোনাম ‘অমীমাংসিত রহস্য’। যেসব রহস্যের তিনি কিনারা করতে পারেন নি, তার প্রতিটি সেই খাতায় লেখা আছে। তবে সুযোগ পেলেই তিনি পুরনো রহস্যের মীমাংসা করতে চেষ্টা করেন।
মিসির আলি নিশ্চিত, তিনি মল্লিক সাহেবের রহস্য নিয়ে অনেক দিন ভাববেন। নির্ঘুম রজনী কাটাবেন।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তৃতীয় দিনে মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে এল বক্কা। দুই ভাই সবসময় একসঙ্গে চলাফেলা করে। আজ বক্কা একা।
বক্কা বলল, জসুর কাছে শুনেছি আপনি অসুস্থ। আপনাকে দেখতে এসেছি। আপনার জন্যে চারটা কচি ডাব এনেছি। ডাব বলকারক।
মিসির আলি বললেন, তোমার ভাই কোথায়?
বক্কা বলল, সে কুয়ার মুখ বন্ধ করছে। কুয়ার মুখ বন্ধ থাকা ভালো, তাহলে অ্যাকসিডেন্ট হয় না। আমার মা কুয়াতে ড়ুবে মারা গিয়েছিলেন, এটা কি আপনি জানেন?
জানি।
আমার মা’র নাম সুরমা। এটা জানেন?
জানি।
মা’র মনে অনেক কষ্ট ছিল তো, এইজন্যে তিনি কুয়ায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অনেক কষ্ট থাকলে কুয়ায় ঝাঁপ দিতে হয়। ঠিক না চাচাজি?
হ্যাঁ ঠিক। আমি আর ভাইজান কী ঠিক করেছি জানেন? আমাদের মনে যদি অনেক কষ্ট হয় তাহলে কুয়ায় ঝাঁপ দিব। মনের কষ্ট দূর করার জন্যে বাবাকে মারা ঠিক না। বাবা হলো জন্মদাতা পিতা। চাচাজি, ডাব কেটে দিব? খাবেন?
এখন খাব না। পরে খাব।
বক্কা বলল, চাচাজি, এখন কাটি? আপনি ডাবের পানি খাবেন। আমি খাব শাঁস।
মিসির আলি বললেন, ঠিক আছে কাটো। ডাব কাটবে কীভাবে? দা লাগবে তো।
বক্কা বলল, দা নিয়ে এসেছি চাচাজি। দা খারাপ জিনিস। এইজন্যে রুমের বাইরে রেখেছি। ভালো করেছি না। চাচাজি?
হ্যাঁ, ভালো করেছ।
বক্কার ডাব কাটা দেখতে দেখতে মিসির আলি মল্লিক রহস্যের আংশিক সমাধান বের করলেন। এই সমাধানে ডাবের কোনো ভূমিকা নেই। কিছু মীমাংসা হঠাৎ করেই মাথায় আসে। বেশিরভাগ সময় স্বপ্নে আসে। কেকুলে বেনজিনের স্ট্রাকচার স্বপ্নে পেয়েছিলেন। মেন্ডেলিফ পিরিয়ডিক টেবিল স্বপ্নে পান। মিসির আলিও স্বপ্ন দেখছেন–জীবিত মল্লিক এবং মৃত মল্লিক একই। তাদের DNA তা-ই বলছে।
স্বপ্ন অনেককেই ইশারা দিয়েছে। তাকেও দিচ্ছে। কনশাস মস্তিষ্ক হিসাবনিকাশ করে আনকনশাস। মস্তিষ্ককে খবর দিচ্ছে। সেই খবর নিজেকে প্ৰকাশ করছে স্বপ্নে।
স্বপ্নে তিনি লাল টেলিফোন দেখছেন। এই টেলিফোন অবশ্যই তাঁকে ক্লু দিয়ে সাহায্য করবে।
বক্কা আগ্রহ নিয়ে ডাবের শাঁস খাচ্ছে। তৃপ্তিতে তার চোখ প্রায় বন্ধ। মিসির আলি বললেন, তোমাদের বাসার গেষ্টরুমে একটা লাল টেলিফোন আছে না?
বক্কা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
এই টেলিফোনের নম্বর জানো?
বক্কা বলল, এই টেলিফোনের নম্বর শুধু বাবা জানে। আর কেউ জানে না। তোমার বাবা কি ওই ঘরেই থাকেন?
বক্কা বলল, না। মাঝে মাঝে থাকেন। বাকি সময় ওই ঘর তালাবন্ধ থাকে।
তালাবন্ধ থাকে কেন?
ওই ঘরে ভূত থাকে, এইজন্যে তালাবন্ধ থাকে।
কী রকম ভূত?
বক্কা বলল, চাচাজি, কী রকম ভূত আমি জানি না। আমি কখনো দেখি নাই।
কেউ কি দেখেছে? আমার স্ত্রী চম্পা দেখেছে। বড় ভাইজানের স্ত্রীও দেখেছে। চাচাজি, আরও চাইরটা ডাব কিনে নিয়ে আসি?
আর ডাব দিয়ে কী হবে?
বক্কা লজ্জিত গলায় বলল, দুটা মাত্র ডাবে শাঁস হয়েছে। তৃপ্তি করে খেতে পারি নাই।
মিসির আলি বললেন, এখানে ডাব না। এনে তুমি বরং ডাব কিনে বাড়িতে চলে যাও। পুরুষ্ট দেখে কেনো, যাতে ভেতরে শাস থাকে। তারপর দুই ভাই মিলে খাও।
বক্কার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন দিশেহারা নাবিক দিশা ফিরে পেয়েছে।
চাচাজি, দা-টা কি নিয়ে যাব, না রেখে যাব?
দা নিয়ে যাওয়াই ভালো।
বক্কা বিদায় হতেই মিসির আলি কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। একটা লিষ্ট করবেন। যাদের সঙ্গে তার দেখা হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
১. ‘এ মল্লিক কাচ্চি হাউস’-এর ম্যানেজার মবিনুদ্দিন। ইনি শুধু কাচ্চি হাউসের ম্যানেজারই না, মল্লিক সাহেবের ডানহাত। যারা নিজেদের ডানহাত প্ৰমাণ করে, তাদের কাছে অনেক গোপন তথ্য থাকে। সমস্যা একটাই, এরা মুনিবের প্রতি বিশ্বস্ততার কারণে কোনো তথ্যই প্ৰকাশ করে না।
২. মল্লিক সাহেবের মূল বাড়ির দারোয়ান আক্কাস মিয়া। এই লোক দীর্ঘ দিন ধরে দারোয়ানের কাজ করছে। সে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানে।
৩. পুলিশ ইন্সপেক্টর রকিব। তার সাহায্যে ছক্কা-বক্কা গ্রেফতার হওয়ার পর যে জবানবন্দি দিয়েছিল তার কপি আনতে হবে।
৪. চম্পা-পারুলের মা-বাবার একটা ইন্টারভ্যু দরকার। মল্লিক সাহেবের বাড়ির ভেতরের খবর নিশ্চয়ই দুই মেয়ে তার বাবা-মা’কে বলেছে।
৫. লাল টেলিফোনের নম্বর জানতে হবে। তারপর বের করতে হবে-এই টেলিফোন থেকে কাকে কাকে টেলিফোন করা হয় সেই তথ্য। মোবাইল ফোনে এই তথ্য সংরক্ষিত থাকে। ল্যান্ড টেলিফোনে থাকে কি না, তিনি জানেন না। চেষ্টা করতে দোষ নেই। মুন হোটেলের মালিক কবীর সাহেবের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এই লোকের কানেকশান ভালো।
মিসির আলির শারীরিক অসুস্থতা মনে হয় সেরে গেছে। তিনি যথেষ্টই বল পাচ্ছেন।
মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন। তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ অর্ডার নিয়ে হোটেলে চলে যেতে হবে। হোটেল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে উঠতে হবে মল্লিক সাহেবের ভাড়া বাসায়। তাঁকে হোটেলে থাকলে হবে না। থাকতে হবে মূল ঘটনার কাছাকাছি।
এ মল্লিক কাচ্চি হাউসের ম্যানেজার মবিনুদ্দিন এবং
মিসির আলির কথোপকথন
মিসির আলি কেমন আছেন?
মবিনুদ্দিন : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনার দোয়া।
মিসির আলি : আপনি ভালো থাকুন। এমন দোয়া তো করি নাই।
মবিনুদ্দিন : আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, এতে আমার প্রতি আপনার মুহব্বত প্রকাশিত। যে মানুষ আমাকে মুহব্বত করে, সে তার নিজের অজান্তেই আমার জন্যে দোয়া করে।
মিসির আলি আমি আপনার কাছে দু’একটি জিনিস জানতে চাচ্ছি। মল্লিক সাহেব বিষয়ে কিছু তথ্য আপনি কি বলবেন?
মবিনুদ্দিন : মুনিবের ক্ষতি হয় এমন কিছু আমি বলব না। আমি উনার নুন খাই। যার নুন খাই তার গুণ গাই—এটা আমার ধর্ম।
মিসির আলি : আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মল্লিক সাহেবের ক্ষতি হয়, এমন তথ্য আপনার কাছে আছে?
মবিনুদ্দিন : আমি আপনার সঙ্গে বাহাসে যাব না। আসসালামু আলায়কুম।
মিসির আলি : চলে যাচ্ছেন?
মবিনুদ্দিন : জি। আল্লাহ হাফেজ।
মল্লিক সাহেবের বাড়ির দারোয়ান আক্কাস মিয়া
এবং মিসির আলির কথোপকথন
আক্কাস মিয়া : স্যার, আমি কিছুই জানি না। আমি কিছুই দেখি নাই। আমার রাতকানা রোগ আছে। রাইতে খালি অন্ধাইরা দেখি। আর কিছু দেখি না।
মিসির আলি : দিনে তো দেখেন।
আক্কাস মিয়া : আমি দিনেও দেখি না।
মিসির আলি : দারোয়ানের চাকরি করেন, রাতেও দেখেন না, দিনেও দেখেন না?
আক্কাস মিয়া : জি-না।
মিসির আলি : রাতেও দেখেন না, দিনেও দেখেন না-এই তথ্য কি মল্লিক সাহেব জানেন?
আক্কাস মিয়া : উনাকে জানাই নাই। জানালে চাকরি চলে যাবে, এইজন্যে। স্যার, আমি এখন যাই। আসসালামু আলায়কুম।
মিসির আলি এবং সুরমা হোমিও হাসপাতালের নার্স
জাহানারা বেগমের সাক্ষাৎকার
মিসির আলি : আপনি কি জানেন যে, আমাকে মল্লিক সাহেবের বাড়ির একটা ঘরে ছয় দিন আটকে রাখা হয়েছিল?
জাহানারা বেগম : জি-না, জানি না। আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। স্যারের বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আমার নাই। স্যারের কুলখানিতে আমাকে উনার বড় ছেলে দাওয়াত দিয়েছিল, সেখানেও যাই নাই।
মিসির আলি : মল্লিক সাহেবের দুই ছেলে ছক্কা-বক্কা দাবি করে যে তারা দুইজন মল্লিক দেখে। এই বিষয়ে কিছু জানেন?
জাহানারা বেগম : কিছু জানি না। তারা দুইজন বাবা দেখে না তিনজন দেখে, এটা তাদের বিষয়। আমার বিষয় না।
মিসির আলি : গত ছয় দিন ধরে মল্লিক সাহেবের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। উনি কোথায় জানেন?
জাহানারা : জানি না, উনি কাজকমের মানুষ। উনি কাজকর্ম নিয়া থাকেন।
মিসির আলি : আমি শুনেছি আপনি মাঝে মাঝে রাতে বাসায় যান না। দুই বেডের হাসপাতালে থেকে যান। এটা কি সত্যি?
জাহানারা বেগম : কাজকমের চাপ যখন বেশি থাকে, তখন বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। রোগী ভর্তি হলে রাত জেগে তার সেবা-যত্ন করতে হয়, তখন থাকা লাগে।
মিসির আলি : মল্লিক সাহেবের এই হাসপাতালে কখনো কি রোগী ভর্তি হয়েছে?
জাহানারা আপনি উল্টা পাল্টা প্রশ্ন কেন করছেন? আপনি তো পুলিশের লোক না। পুলিশের লোক হলেও আমি ভয় পাই না। আপনাকে সত্যি কথা বলি-স্বামীর সঙ্গে আমার বনিবনা নাই। প্রায়ই ঝগড়া হয়। তখন এখানে থাকি। যাদের মনে পাপ, তারা এর মধ্যে পাপ দেখতে পারে, আমার মধ্যে কোনো পাপ নাই। আমি বুঝতে পেরেছি, কেউ আপনার কাছে কিছু লাগায়েছে। আপনাকে বলেছে যে, আমি যখন রাতে থেকে যাই, তখন মল্লিক স্যার আমার ঘরে থাকেন। ইহা সত্য না। মানুষের কথায় দয়া করে নাচবেন না। ক্লিয়ার?
মিসির আলি : জি ক্লিয়ার।
ইন্সপেক্টর রকিব এবং মিসির আলির কথোপকথন
মিসির আলি : আপনারা কি মল্লিক সাহেবের কেইসটা কোজ করে দিয়েছেন?
রকিব : জি-না। কেইস চালু আছে। গোপনে গোপনে তদন্ত চলছে। মাঝে মাঝে আমরা এ রকম করি। ভাব দেখাই যে মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। তখন সাসপেক্টরা গা ছেড়ে দেয়। এতে আমাদের সুবিধা হয়।
মিসির আলি : আপনি বলছেন তদন্ত চলছে–তাহলে মল্লিক সাহেব এখন কোথায় বলতে পারবেন?
রকিব : বলতে পারব। তিনি আগামসি লেনের এক বাড়িতে আছেন। মাঝে মাঝে এই বাড়িতে থাকেন।
মিসির আলি : আমি যে ঘরে বন্দি ছিলাম, ওই ঘরে একটা লাল টেলিফোন আছে। টেলিফোনের নম্বরটা কি আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবেন?
রকিব : স্যার, আপনার সঙ্গে যদি কাগজ-কলম থাকে তাহলে নম্বরটা লিখুন।
মিসির আলি : এই নম্বর তাহলে আপনারা জানেন?
রকিব : কেন জানিব না? বিস্ময়কর একটা ঘটনা ঘটেছে। একই মানুষএকজন জীবিত আরেকজন মৃত। আর আমরা ঠিকমতো তদন্ত করব না, তা কি হয়? আপনি দু’জনের DNA টেস্টের কথা বিশেষভাবে বলেছিলেন। আপনি শুনে খুশি হবেন যে, DNA টেস্ট হয়েছে। রেজাল্ট আমাদের কাছে আছে।
মিসির আলি : আমাকে কি DNA টেষ্টের রিপোর্টটা দেখানো যায় না?
রকিব (হাসতে হাসতে) আপনি বিখ্যাত মিসির আলি। আপনাকে কেন দেখাব না! ফটোকপি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মিসির আলি : আরেকটা ছোট্ট সাহায্য চাচ্ছি। আমি মল্লিক সাহেবের যে ঘরে বন্দি ছিলাম, সেখানে আরেক রাত থাকতে চাই।
রকিব : কেন?
মিসির আলি : আছে একটা বিষয়। তবে আমি ভয় পাচ্ছি, ওরা না আবার আমাকে আটকে ফেলে।
রকিব : আপনি কবে থাকতে চান বলবেন। সব ব্যবস্থা হবে। বাড়ির চারদিকে পুলিশ থাকবে। স্যার, এখন লাল টেলিফোনের নম্বরটা লিখুন।
মিসির আলি : নম্বর নিয়েই টেলিফোন করলেন। চারবার রিং হওয়ার পর তরুণীর গলা শোনা গেল, হ্যালো কে বলছেন?
মিসির আলি বললেন, চম্পা, আমি তোমার চাচাজি। মিসির আলি। তুমি ভালো আছ?
তরুণী জবাব দিল না। তবে সে টেলিফোন নামিয়েও রাখল না।
মিসির আলি বললেন, আগামী কাল রাতে আমি তোমাদের ওই ঘরে থাকব। ব্যবস্থা করতে পারবে?
তরুণী জবাব দিল না।
মিসির আলি বললেন, চম্পা, তুমি যে টেলিফোন কানে ধরে আছ তা আমি জানি। আগামীকাল রাত আটটার দিকে আমি চলে আসব। রাতে কি খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে?
তরুণী এইবার কথা বলল। প্রায় ফিসফিস করে বলল, কেন আসতে চাচ্ছেন?
মিসির আলি বললেন, স্মৃতি রোমন্থনের জন্যে। মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতি হাতড়াতে হয়। এটা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো।
রাত আটটা। সারা দিন ঝলমলে রোদ ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মিসির আলি ছাতা মাথায় মল্লিক সাহেবের বাড়িতে এসে উঠেছেন। দেখে মনে হচ্ছে মল্লিক সাহেবের বাড়ি শশানপুরী। কেউ বাস করে না। বিড়ালের মিউ মিউ শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। মিসির আলি দোতলায় ওঠার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বললেন, বাড়িতে কেউ আছেন?
কেউ জবাব দিল না। দারোয়ান আক্কাস মিয়াকে এক ঝলক দেখা গেল। সে দ্রুত ঘরে ঢুকে গেল। মিসির আলি দোতলায় উঠে গেলেন। যে ঘরে বন্দি ছিলেন, সেই ঘর খুঁজে বের করতে তার বেগ পেতে হলো না। মূল দরজা পুলিশ ভেঙেছে। দরজা ঠিক করা হয় নি। মিসির আলি ঘরে ঢুকে দেখেন ঘরের ভেতর কাঠের চেয়ারে মল্লিক সাহেব বসে আছেন। তার হাতে সিগারেটের প্যাকেট। মিসির আলি অবাক হলেন না। মল্লিক সাহেব এখানে থাকবেন, মিসির আলি তা ধরেই নিয়েছিলেন।
মল্লিক মিসির আলির দিকে না তাকিয়ে বললেন, ছোটকুত্তির কাছে শুনলাম রাতে আপনি খানা খেতে চেয়েছেন। সে আপনার জন্যে খানা পাকিয়েছে। মোরগপোলাও আর খাসির বটি কাবাব। তবে আমার উপদেশ, ছোটকুত্তির রান্না খাবার খাবেন না। খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে।
মিসির আলিকে দেখে মনে হচ্ছে না। তিনি মল্লিক সাহেবের কথা শুনছেন। তিন খাটে বসলেন। পরিচিত খাট। পরিচিত বিছানা। বালিশ-চাদর কিছুই বদলানো হয় নি। তিনি বালিশ নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকলেন।
মল্লিক বললেন, আপনার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হয় কিছু বলতে চান। বলতে চাইলে বলেন। বালিশ শুকাগুকির প্রয়োজন নাই। বালিশের মধ্যে হিসটরি’ লেখা নাই।
মিসির আলি বললেন, আপনার দুই ছেলে যে দু’জন বাবা দেখত সেই রহস্য ভেদ করেছি। তারা আসলেই ছোটবেলা থেকে দু’জন বাবা দেখত।
মল্লিক সাহেব বললেন, আপনাকে অনেকবার বলেছি-আমার কোনো যমজ ভাই নাই।
মিসির আলি বললেন, যমজ ভাই না, সে আপনার সৎ ভাই। আপনার বাবা তারও বাবা। DNA টেস্টে তা-ই পাওয়া গেছে। আপনার এই সৎভাইয়ের কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। মনে হয় তার জন্ম কাজের মেয়ের গর্ভে। তবে আপনার বাবা তাকে পুরোপুরি বঞ্চিত করেন নি। আগামসি লেনে তাকে একটা বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। আপনার এই ভাই সত্যিকার অর্থেই ভালো মানুষ ছিল। সে আপনার দুই ছেলেকে অসম্ভব পছন্দ করত। এই ছেলে দু’টির টানেই সে মাঝে মাঝে গোপনে আপনার বাড়িতে আসত। সে লুকিয়ে থাকত এই ঘরে। আপনি তাকে খুন করেছেন।
মল্লিক বললেন, এত কিছু বলেছেন, কীভাবে খুন করেছি সেটাও বলেন। গলা টিপে মেরেছি?
মিসির আলি বললেন, ডাব কাটা হয় এমন দা-এর পেছন দিয়ে তার মাথায় বাড়ি দিয়েছেন।
মল্লিক অবাক হয়ে বললেন, এটা কীভাবে বললেন?
মিসির আলি বললেন, আপনার ছেলে বক্কা এই দা নিয়ে আমাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল। সে বলেছে—দা খারাপ জিনিস। তার কথা থেকে বুঝেছি।
মল্লিক বললেন, হারামজাদাটা আমাকে ধরায়ে দিয়েছে। দুই হারামজাদা ভাব ধরে থাকে যে এরা কিছুই বুঝে না। তলে তলে বিরাট বুদ্ধি।
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। তৃপ্তির সঙ্গে দুটা টান দিয়ে বললেন, আপনার সম্পর্কে আপনার দুই পুত্ৰবধু যা বলে তা ঠিক না। আপনি এই কাজ কখনো করেন নি। করলে এদের কুত্তি ডাকতেন না। আপনার রুচি নিম্নমুখী কাজের মেয়ে বা আপনার হাসপাতালের নার্সে সীমাবদ্ধ।
মল্লিক সাহেব বললেন, নার্স হারামজাদিও মুখ খুলেছে। আফসোস। বিরাট আফসোস। আপনি এত কিছু বের করে ফেলেছেন। এখন বলেন, আমার স্ত্রী সুরমাকে কে মেরেছে? আমি?
মিসির আলি বললেন, আপনি না। আপনার স্ত্রী নিজেই কুয়াতে ঝাপ দিয়েছেন। আমার ধারণা, আপনার পুত্রবধূরা আপনার বিষয়ে তাঁর কানে কথা তুলেছে। তিনি এই দুঃখ নিতে পারেন নি।
মল্লিক আনন্দিত গলায় বললেন, আপনার বিরাট বুদ্ধি। কিন্তু আপনিও শেষ পর্যন্ত ধরা খেয়েছেন। আমার স্ত্রীকে আমিই মেরেছি। সে স্বেচ্ছায় কুয়াতে ঝাপ দেয় নাই। কেন মেরেছি, সেটা একটা ইতিহাস। আপনাকে বলার প্রয়োজন নাই। খানা কি দিতে বলব? খানা খাবেন?
মিসির আলি হাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। মল্লিক সাহেব বললেন, আপনাকে দেখে কখনো বুঝি নাই। একজন চিকন-চাকান মানুষের পেটে এত বুদ্ধি। জানলে কোনোদিন বাড়ি ভাড়া দিতাম না। লাত্থি দিয়ে বের করতাম।
মল্লিক কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শান্ত গলায় বললেন, ছোটকুত্তি, আমাদের খানা দাও। পুলিশ আজ রাতেই আমাকে থানায় নিয়ে যাবে। বাড়ির চারদিকে পুলিশ। খালি পেটে থানায় যাওয়া ঠিক না।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। চম্পা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। আজ তার সারা শরীর বোরকায় ঢাকা না। অতি রূপবতী এই মেয়েকে দেখে মিসির আলি মুগ্ধ হলেন। তার কাছে মনে হলো, হেলেন অব ট্রয়, ক্লিওপেট্রা কিংবা কুইন অব সেবা কখনোই দুইবোন চম্পা-পারুলের চেয়ে রূপবতী না। বাঙালি প্রাচীন কবির মতো মিসির আলি মনে মনে আওড়ালেন–
‘কে বলে শারদ শশি সে মুখের তুলা
পদনখে পড়ে আছে তার কতগুলা।”
COMMENTS