মিসির আলি ঢাকায় পৌঁছলেন রবিবার ভোরে। দরজা নীলুর চিঠিভর্তি খাম পেলেন। চিঠিতে একটিমাত্র লাইন–স্যার, আপনার বড় বিপদ কিসের বিপদ–কী সমাচার, কিছুই লেখা নেই।
তৃতীয় পর্ব
মিসির আলি সমগ্র থেকে
নিশীথিনী -হুমায়ূন আহমেদ
( দেবী এর ২য় অংশ )
.
🔴 এগারো 🔴
.
মিসির আলি ঢাকায় পৌঁছলেন রবিবার ভোরে। দরজা নীলুর চিঠিভর্তি খাম পেলেন। চিঠিতে একটিমাত্র লাইন–স্যার, আপনার বড় বিপদ কিসের বিপদ–কী সমাচার, কিছুই লেখা নেই।
মেয়েদের নিয়ে এই সমস্যা। তাদের সব চিঠিতেই অপ্রয়োজনীয় কথার ছড়াছড়ি। শুধু প্ৰয়োজনীয় কথাগুলোর বেলায় তারা শর্টহ্যাণ্ড ভাষা ব্যবহার করে। আজ পর্যন্ত মেয়েদের এমন কোনো চিঠি পান নি, যেখানে জরুরি কথাগুলো গুছিয়ে লেখা।
তবে নীলু একটি কাজ করেছে। নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে। এক্ষুণি চলে যাওয়া যায়। মিসির আলি গেলেন না। হাত-মুখ ধুয়ে প্ল্যান করতে বসলেন, আজ সারাদিনে কী কী করবেন।
(ক) হানিফার খোঁজ নেবেন।
(খ) ইউনিভার্সিটিতে যাবেন।
(গ) ফিরোজের খোঁজ নেবেন।
(ঘ) সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করবেন।
(ঙ) আজমলের সঙ্গে দেখা করবেন।
এই পাঁচটি কাজ শেষ করবার পর নীলুর কাছে যাওয়া যেতে পারে। তাঁর এমন কোনো বিপদ নেই যে, এক্ষুণি ছুটে যেতে হবে। তবে কেন জানি নীলুর কাছে আগে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে ফ্লয়েডীয়ান কোনো ব্যাখ্যা এর নিশ্চয়ই আছে।
ট্রেনে আসতে-আসতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এবং আশ্চৰ্য, নীলুকে স্বপ্নে দেখলেন। স্বপ্নটি এমন ছিল, যে, জেগে উঠে তাঁর নিজেরই লজ্জা করতে লাগল। কেবলই মনে হতে লাগল, তাঁর পাশে বসে থাকা লোকগুলোও তাঁর স্বপ্নের ব্যাপারটা জেনে ফেলেছে। তিনি যে খানিকক্ষণ আগেই একটি রূপবতী মেয়ের হাত ধরে নদীর ধারে হাঁটছিলেন, এটা সবাই জানে।
.
হানিফা সুস্থ।
তবে অনেক রোগী হয়ে গেছে। মুখ শুকিয়ে হয়েছে এতটুকু। হানিফার কাছে তিনি ঠিক সময়েই এসেছেন। আজই তার রিলিজ-অর্ডার হবে। আর এক দিন দেরি হলে হয়ে যেত। মেয়েটি ঘাবড়ে যেত। কারণ এই সাত দিন কেউ তাকে দেখতে আসে নি। অথচ বাড়িওয়ালা করিম সাহেব বারবার বলেছেন, তিনি প্রতিদিন একবার এসে খোঁজ নেবেন। আমাদের দেশের মানুষদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, যেকাজগুলো তারা করতে পারবে না, সেই কাজগুলোর দায়িত্ব তারা সবচেয়ে আগ্ৰহ করে নেবে।
চল হানিফা, বাসায় যাই।
চলেন।
তুই তো দারুণ রোগী হয়েছিস রে বেটি।
আপনেও রোগা হইছেন।
অসুখে পড়ে গিয়েছিলাম রে হানিফা। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল নিউমোনিয়াতে ধরেছে। মরতে—মরতে বেঁচে গেছি। তুই বস এখানে, আমি রিলিজ-অর্ডারের ব্যবস্থা করি।
রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ান বললেন, হানিফা মেয়েটি আপাতত সুস্থ, কিন্তু আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।
কেন?
ওর প্রবলেমটা হার্টের একটা ভাল্বে। তার জন্মই হয়েছিল একটা ডিফেকটিভ ভাল্ব নিয়ে। তার ছোটবেলায় ডাক্তাররা চেষ্টা করেছেন ভাল্বটা রিপেয়ার করতে। ওপেন হার্ট সাজারি হয়েছে তার।
কী করে বুঝলেন? মেয়েটি বলেছে?
না, সে কিছু বলে নি। জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার কিছু মনেটনে নেই। তবে আমাদের বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই। ওর হার্ট আবার ওপেন করতে হবে।
এখানে করা যাবে?
আগে যেখানে করা হয়েছিল, সেখানে করলেই ভালো হয়। আমাদের এখানে এত ছোট বাচ্চাদের ওপেন হার্ট সাজারির সুযোগ নেই।
আপনার ধারণা, ওর অপারেশনটা এ দেশে হয় নি।?
না, এ-দেশে হয় নি। পশ্চিমা কোনো দেশে হয়েছে। কেন, আপনি জানেন না?
জ্বি-না, আমার জানা নেই।
মিসির আলি চিন্তিত মুখে হানিফকে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। সে কতদূর কি করেছে জানা দরকার, বা আদৌ কিছু করেছে কি না। কিছু না করারই কথা। এ-দেশের বেশির ভাগ লোকই কোনো কাজ করতে চায় না। কেন করতে চায় না?–এই নিয়ে কিছু ভালো গবেষণা হওয়া দরকার। কর্মবিমুখতার কারণটি কী? যদি একাধিক কারণ থেকে থাকে, সেগুলোই—বা কী?
সাজ্জাদ হোসেনকে টেলিফোনে পাওয়া গেল না। যতবারই টেলিফোন করা হয়, ততবারই খুব চিকন গলায় এক জন পুরুষ মানুষ বলেন, উনি ব্যস্ত আছেন। মীটিং চলছে।
মিসির আলি বড় বিরক্ত হলেন। পুলিশরা এত মীটিং করে, তাঁর জানা ছিল না। ঘন্টার পর ঘন্টা এয়ার কন্ডিশনড ঘরে বসে মীটিং করার মতো সময় তো তাদের থাকার কথা নয়। এগুলো হচ্ছে করপোরেট অফিসগুলোর কাজ–শুধু কথা বলা, বকবক করা। কিছুক্ষণ পরপর কফি খাওয়া। সুখে সময় কাটানো যার নাম।
.
*****
.
সাজ্জাদ হোসেনের সময়টা অবশ্যি খুব সুখে কাটছিল না। মন্ত্রীর শাশুড়ির কল্যাণে তিনি একটি বিপজ্জনক অবস্থায় আছেন। আই জি মতিয়ুর রহমান পি এস পির কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে।
আই জি মতিয়ুর রহমান ছোটখাটো মানুষ, কিন্তু দারুণ কড়া অফিসার। পুলিশমহলে একটি চালু কথা আছে।–মতিয়ুর রহমানের সামনে দাঁড়ালে হাতিরও বুক কাঁপে। সাজ্জাদ হোসেনের বুক কাঁপিছিল।
মতিয়ুর রহমান বললেন, দু জন সেন্ট্রি চেয়েছিল, দিতেন দু জন, কেন ঝামেলা করলেন?
আমি স্যার দিতাম, পরে অফিসে ফিরে মনে হল খামোকা …।
এক জন মন্ত্রীর শাশুড়ির ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেক বড় ব্যাপার, কেন বুঝতে পারেন না? তা ছাড়া যে এক জন সেন্ট্রি ছিল, সকালবেলা দেখা গেল সে ঘুমাচ্ছে।
সারা রাত ডিউটি দিয়েছে স্যার, কাজেই ভোরবেলা ঘুম এসে গেছে। পুলিশ হলেও তো স্যার এরা মানুষ।
এখন বলেন, আমি কী করি। মিনিষ্টার সাহেব ভোর সাতটায় আমাকে টেলিফোন করে বলেছেন, আপনার বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেবার জন্যে।
সাজ্জাদ হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, কী আর করবেন। স্যার অ্যাকশন নিতে বলেছে, অ্যাকশন নেন।
মতিয়ুর রহমান সাহেব ফাইল থেকে একটি চিঠি বের করে বললেন, আমি মিনিস্টার সাহেবকে এই চিঠিটা পাঠিয়েছি। কী লিখেছি শুনুন—
জনাব,
পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আপনি আমাকে যে-অ্যাকশন নেবার কথা বলেছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে জানাচ্ছি যে, সাজ্জাদ হোসেন পুলিশবাহিনীর এক জন দক্ষ, নিষ্ঠাবান এবং সৎ অফিসার। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্যে তাকে বীর বিক্রম উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছে। এ-জাতীয় এক জন অফিসারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে লিখিত অভিযোগের প্রয়োজন আছে। আপনার অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তদন্ত হবে। তদন্তকারী অফিসার সাজ্জাদ হোসেনকে দোষী সাব্যস্ত করবার পরই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্ন ওঠে।
বিনীত
মতিয়ুর রহমান।
.
মতিয়ুর রহমান চিঠি পড়া শেষ করে বললেন, ঠিক আছে?
থ্যাংক য়ু ভেরি মাচ স্যার।
থ্যাংকস দেবার কিছু নেই। সত্যি কথাই লিখেছি। তবে, আপনার উচিত আরো ট্যাক্টফুল হওয়া!
যাব স্যার?
হ্যাঁ,যান।
স্যার, একটা কথা বলি?
বলুন।
স্যার, আমার ইচ্ছা হচ্ছে কালো একটা প্যান্ট পরে খালিগায়ে হাতে একটা লোহার রড নিয়ে যাই এবং ঐ শাশুড়ির মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে আসি।
কথাটা বলেই সাজ্জাদ হোসেনের মনে হল, একটা বড় ভুল হয়ে গেল। আই জি এমন কোনো ব্যক্তি নন, যিনি রসিকতা সহজভাবে নেবেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড, মতিয়ুর রহমান সাহেব হেসে ফেললেন। মুচকি হাসি নয়। হা হা করে হাসি।
সাজ্জাদ হোসেনের জীবনে এটা একটা স্মরণীয় দিন। তাঁর মনের গ্লানি কেটে যেতে শুরু করেছে। তিনি অফিসে ফিরে দুটি সংবাদ শুনলেন–দশ মিনিট পরপর কে নাকি তাঁকে খোঁজ করছে এবং গত রাতে নগ্নগাত্ৰ ত্ৰাস একটি ছ বছরের ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তার ডেডবডি কিছুক্ষণ আগেই রিকভার করা হয়েছে। চেনার উপায় নেই। লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে থেতলে ফেলা হয়েছে। সাজ্জাদ হোসেন তক্ষুণি জীপ নিয়ে বেরুলেন।
.
******
.
হ্যালো, এটা কি ফিরোজদের বাসা?
হ্যাঁ।
আপনি কে কথা বলছেন?
আপনি কে এবং আপনার কাকে দরকার, সেটা বলুন।
আমার নাম মিসির আলি।
ও আচ্ছা। আমি ফিরোজের মা।
স্লামালিকুম আপা।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
আমি সপ্তাহখানেক বাইরে ছিলাম। আপনাদের খবর দিয়ে যেতে পারি নি।
ও।
গিয়েছিলাম চব্বিশ ঘন্টার জন্যে, ঝামেলায় পড়ে এত দেরি হল। আমি একটা ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম।
ও।
ফিরোজ কেমন আছে?
ভালো।
ওকে টেলিফোনটা দিন।
ওকে টেলিফোন দেয়া যাবে না।
বাসায় নেই।
না।
কোথায় গিয়েছে? বাইরে?
হ্যাঁ।
তাহলে আমি বরং রাতের বেলা এক বার টেলিফোন করবো।
না, রাতের বেলা টেলিফোন করবেন না। ওকে পাওয়া যাবে না।
কেন, ও কি রাতে ফিরবে না?
না ও ঢাকার বাইরে।
ঢাকার বাইরে—কোথায়?
ওর মামার বাড়িতে,–বরিশালে।
কিন্তু আমি তো বলেছিলাম ওকে দীর্ঘদিন চোখে-চোখে রাখতে হবে।
কোনো উত্তর নেই।
হ্যালো।
বলুন।
কী হয়েছে ফিরোজের?
কী আবার হবে? কিছুই হয় নি। ও ভালো আছে।
কিন্তু আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, কিছু-একটা হয়েছে। আপনি কি দয়া করে বলবেন?
ওর কিছু হয় নি। ও ভালো আছে। ও আছে তার মামার বাড়িতে।
বরিশালে?
হ্যাঁ, বরিশালে।
আপনি ঠিক কথা বলছেন না। কারণ ফিরোজের মামার বাড়ি বরিশাল নয়। ফিরোজ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমার জানা। দয়া করে আপনি আমাকে বলুন, কী হয়েছে।
কিছু হয় নি। অনেকবার তো এই কথা বললাম। তবু কেন বিরক্ত করছেন?
ওসমান সাহেবকে দিন। তাঁর সঙ্গে কথা বলব।
উনি বাসায় নেই।
কখন ফিরবেন?
জানি না কখন ফিরবেন।
শুনুন আপা, আমি আসছি এই মুহূর্তে।
মিসির আলি টেলিফোন নামিয়ে রেখে তক্ষুণি ধানমণ্ডি ছুটলেন। কিন্তু ওসমান সাহেবের বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারলেন না। দারোয়ান গোট বন্ধ করে বসে আছে। সে কিছুতেই গেট খুলবে না। ওসমান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী-কেউ নাকি বাড়ি নেই। কখন ফিরবেন তারও ঠিক নেই। মিসির আলি বললেন, ঠিক আছে, আমি বসার ঘরে অপেক্ষা করবল। গেট খোল।
সাহেব আর মেমসাহেব বাড়িতে না থাকলে গেট খোলা নিষেধ আছে।
মিসির আলি প্ৰায় দু ঘন্টা বন্ধ গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো লাভ হল না। নীলুদের বাসা কাছেই কোথাও হবে। ঝিকাতলা ধানমণ্ডি থেকে খুব-একটা দূর নয়। মিসির আলি সেদিকেই রওনা হলেন।
ফিরোজের কথা বারবার মনে আসছে। কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছেন না। কী হল ছেলেটার? আর যদি কিছু হয়েই থাকে, সবাই মিলে এটা তার কাছে গোপন করছে কেন? রহস্যটা কী? রাতে ফেরবার পথে আরেক বার খোঁজ নিতে হবে।
.
🔴 বারো 🔴
.
মিসির আলি নরম স্বরে বললেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অধ্যাপক। আমার এক ছাত্রী কি এ বাড়িতে–।
বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, আসুন, আমি নীলুর বাবা। আমার নাম জাহিদুল ইসলাম।
স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। বসুন আপনি, নীলু এসে পড়বে।
ওকে খবর দিন। আর বেশিক্ষণ থাকবো না, আকাশের অবস্থা ভালো না—ঝড়-বৃষ্টি হবে।
জাহিদ সাহেব তাঁর মেয়েকে খবর দেয়ার জন্যে মোটেই ব্যস্ত হলেন না। খবর দেয়ার কিছু নেই। নীলু খবর পেয়ে গেছে। দশ মিনিট আগেই সে বলেছে, স্যার আমাদের বাসার দিকে রওনা হয়েছেন। এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যে।
নীলুর মুখ উজ্জ্বল এবং হাসি-হাসি। এইসব জাহিদ সাহেবের ভালো লাগছে না। এক জন মাঝবয়সী অধ্যাপকের জন্যে এত আগ্রহ নিয়ে তাঁর মেয়ে অপেক্ষা করবে কেন?
তিনি একটি সুস্থ-স্বাভাবিক মেয়েকে নিজের পাশে চান–যার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। কী হবে না হবে, যা সে আগে থেকে বলতে পারবে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে যে গ্ৰহণ করবে আর দশটি মেয়ের মতো।
মিসির আলি বললেন, আমি আপনার এ-বাড়িতে আগে এক বার এসেছি। আনিস সাহেব বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর স্ত্রীকে কিছুদিন চিকিৎসা করেছিলাম।
আমি জানি।
আনিস সাহেব কি এখনো এ-বাড়িতে থাকেন?
না।
অন্য কোনো ভাড়াটে এসেছে বুঝি?
না, বাড়ি ভাড়া দিই না এখন, যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।
এ কথা বলছেন কেন?
রানু মেয়েটা এ-বাড়িতে না থাকলে, আজ আমার মেয়ের এ-অবস্থা হত না।
এত জোর দিয়ে তা বলা কি ঠিক? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা আমরা কেউ তো জানি না।
জাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। রোগা, কালো এবং কিঞ্চিৎ কুজো হয়ে বসে থাকা এই লোকটিকে তাঁর মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। নীলু এই লোকটির মধ্যে কী দেখেছে? জাহিদ সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে উঠে চলে যেতে কিন্তু বাইরের একটি লোককে একা বসিয়ে রেখে উঠে চলে যাওয়া যায় না। তিনি লক্ষ্য করলেন, ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়েছেন। তাঁর সামনেই অ্যাশট্রে। তবু তিনি চারদিকে ছাই ফেলছেন। কী কুৎসিত স্বভাব। এরা ছাত্রদের কী শেখাবে? নিজেরাই তো কিছু শেখে নি।
মিসির আলি বললেন, আপনার আরেকটি মেয়ে ছিল। ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
কোথায় আছে সে?
বাইরে।
বিলুর প্রসঙ্গ উঠলেই জাহিদ সাহেব অনেক কথা বলেন। কিন্তু আজ এই লোকটির সঙ্গে কোনো কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
মিসির আলি সাহেব।
জ্বি?
আমার মাথা ধরেছে, আমি একটু শুয়ে থাকব। কিছু মনে করবেন না। আমি নীলুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
জ্বি আচ্ছা।
জাহিদ সাহেব নীলুর ঘরে উঁকি দিয়ে অবাক এবং দুঃখিত হলেন। নীলুশাড়ি বদল করেছে। সাধারণ শাড়ি বদলে বেগুনি রঙের চমৎকার একটি শাড়ি পরেছে এবং চুল বাঁধছে। এর মানেটা কী?
নীলু।
জ্বি।
তোর স্যার বসে আছেন নিচে।
যাচ্ছি বাবা।
বেশিক্ষণ ওঁকে আটকে রাখা ঠিক না। আকাশের অবস্থা খারাপ।
বাবা, আমি তো ওকে আজ রাতে এখানে থেকে যেতে বলবো।
সে কী কেন?
আমার কথা শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যাবে। এত রাতে আমি উনাকে ছাড়বো না।
কথাটা তাহলে দিনের বেলা বল। কাল ওকে আসতে বলে দে।
বাবা, ওঁর সঙ্গে আজই আমার কথা বলা দরকার। একটা রাত উনি এখানে থাকলে, তোমার কি কোন আপত্তি আছে?
জাহিদ সাহেব হ্যাঁ, না।–কিছুই বলতে পারলেন না। নীলু বললল, আমাদের গেষ্টরুমটা ঠিকঠাক করে রেখেছি। উনি সেখানেই থাকবেন! তুমি এত গম্ভীর হয়ে আছ কেন বাবা? আপত্তি থাকলে বল—আমার আপত্তি আছে।
আমার আপত্তি আছে।
আপত্তিটা কেন?
ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে তোর এত কিসের খাতির?
খাতির কিছু নেই বাবা। উনি আমার টীচার এবং চমৎকার এক জন টীচার! আমি অনেক কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। তাঁর প্রতি আমার অন্য রকম একটা শ্রদ্ধা আছে।
এই জন্যেই কি এত শাড়ি-গয়না পরে সাজতে শুরু করেছিস?
না বাবা, সে জন্যে সাজছি না এবং তুমি যা ভাবছো তাও ঠিক না। আমি এত সাজগোজ করছি, কারণ স্যার রিকশা করে আসতে আসতে ভাবছিলেন, আমাকে দেখবেন বেগুনি রঙের একটা শাড়িপরা অবস্থায়। কাজেই আমি এইভাবে সেজেছি। রহস্যময় সবকিছুতে স্যারের অবিশ্বাস আছে, আমি সেটা দূর করতে চাই। চলে যেওনা বাবা, আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। এই স্যার রানু আপার ব্যাপারটা খুব ভালো জানেন। রানু আপার রহস্যের সঙ্গে আমার রহস্যের একটা মিল আছে। সেই মিল নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমি কথা বলবো।
নীলু দম নেয়ার জন্যে থামলো। জাহিদ সাহেব কী বলবেন ভেবে পেলেন না।
বাবা।
বল।
স্যার যদি আজ রাতে এ বাড়ির গেষ্টরুমে থাকেন, তোমার কি খুব বেশি আপত্তি হবে?
না।
আমি যখন স্যারের সঙ্গে কথা বলব, তখন তুমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে থাকতে পার।
না, আমি শুয়ে থাকব, আমার মাথা ধরেছে।
না বাবা, তোমার মাথা ধরেনি। তুমি আমার স্যারকে খুবই অপছন্দ করছ বলে এ— রকম করছ। বাবা, তোমাকে শুধু একটা কথা বলি-মানুষ হিসেবে উনি প্রথম শ্ৰেণীর। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না, তাই না?
বিশ্বাস করব না কেন? করছি।
না, তুমি করছ না। তাতে অবশ্যি কিছু যায়-আসে না, তবে তুমি যদি বিশ্বাস করতে, তাহলে আমার ভালো লাগত। ঠিক আছে বাবা, তুমি যাও, শুয়ে থাক। রাত দশটার সময় টেবিলে ভাত দেব, তখন তোমাকে ডাকব।
.
নীলু বসার ঘরে ঢুকল নিঃশব্দে। মিসির আলি চাঁপা ফুলের হালকা একটা সুবাস পেয়ে চমকে পেছনে ফিরলেন। নীলু বলল, কেমন আছেন স্যার?
তিনি কোনো জবাব দিতে পারলেন না। তাঁর দারুণ অস্বস্থি ও লজ্জা লাগতে লাগল।
একটা বিব্রতকর অবস্থা। কারণ তিনি রিকশায় আসতে-আসতে নীলুকে যেভাবে দেখবেন কল্পনা করেছিলেন, সে ঠিক সেভাবেই সেজেছে। কাকতালীয় মিল বলে একে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। দুটি কারণে এ রকম হতে পারে। হয়তো নীলু এ-রকম সেজে বসে ছিল। তিনি তাঁরই এস পি-র মাধ্যমে তা টের পেয়েছেন। এটা সম্ভব নয়, কারণ মিসির আলি খুব ভালো করেই জানেন, তাঁর কোনো ESP. ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয় কারণটি যদি সত্যি হয়, তাহলে বড় অস্বস্তির ব্যাপার হবে। তিনি রিকশায় আসতে—আসতে যা ভাবছিলেন, নীলু তা টের পেয়েছে এবং সেইভাবে সেজেছে। এ রকম হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
মিসির আলি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। তাঁর মনে নীলু সম্পর্কে যেসব কল্পনা আছে, তা তিনি আড়াল করে রাখতে চান। বিশেষ করে ট্রেনে আসতেআসতে যে স্বপ্নটা দেখেছেন। এটি যদি নীলু টের পায়, তাহলে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে। তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন, দেখ নীলু, স্বপ্নের ওপর আমার হাত নেই। স্বপ্ন হচ্ছে স্বপ্ন।
কিন্তু মনোবিজ্ঞানের এক জন শিক্ষক হিসেবে তিনি জানেন, স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়। অবচেতন কামনা-বাসনার ছবি। তিনি তাকালেন নীলুর দিকে। মেয়েটির মুখে হাসি। ছোটদের দুষ্টুমি দেখে বড়রা যে-রকম হাসে, সে-রকম।
নীলু বলল, স্যার চলুন, আমরা বারান্দায় গিয়ে বসি।
আমি বেশিক্ষণ বসব না নীলু। আকাশের অবস্থা ভালো না, ঝড় হবে।
হলে হবে। ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে ঠিক এই আপনাকে ভাবতে হবে না।
বারান্দায় অন্ধকার। সেখানে পাশাপাশি দুটি বেতের চেয়ার দেয়া আছে। গ্রিল থাকা সত্ত্বেও বারান্দায় বসে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়, যে—আকাশে অনবরত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মিসির আলি বললেন, কী বলবে তুমি, বল।
নীলু বলল, আপনি একবার ক্লাসে ESP-র ওপর বলেছিলেন। আপনার মনে আছে?
আছে।
আমার এবং আমার কয়েকজন বন্ধুর ESP আছে কি না তা পরীক্ষা করলেন। মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে। জেনার কার্ড দিয়ে পরীক্ষা।
সেই পরীক্ষায় আমরা কেউ পাস করতে পারি নি। তার মানে, আমাদের কারোরই এক্সটা সেনসরি পারসেপশান ক্ষমতা নেই।
হুঁ, তা ঠিক। যাদের লজিক খুব তীক্ষ্ণ, তাদের এটা থাকে না। নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের, যাদের লজিক খুব দুর্বল–তাদের থাকে।
স্যার, আমি জানি না। আমি এখন একটি নিম্নশ্রেণীর প্রাণী কিনা, কিন্তু আমার ESP ক্ষমতা অনেক বেশি। ঠিক এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন, আমি বলে দিতে পারি।
নীলু বলতে-বলতে হেসে ফেললো এবং হাসি ঢাকার জন্যে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। মিসির আলি খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। কারণ, তিনি একটি আপত্তিকর ভাবনা ভাবছিলেন। তিনি ভাবছিলেন–নীলুর সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে দুজনেই ভিজে জবজব, হুড তোলা এবং পর্দা ফেলা। রিকশাওয়ালা বাতাস কাটিয়ে বহু কষ্টে এগুচ্ছে। তিনি নীলুর হাত ধরে আছেন।
স্যার।
বল।
শুধু শুধু আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? আমরা সবাই তো এ-রকম কত অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা করি এবং এটাই তো স্বাভাবিক।
হু, তা ঠিক। আমার সঙ্গে কী বলতে চাচ্ছিলে বল। আমি বেশিক্ষণ থাকব না। ঝড় আসবে।
বলতে না বলতেই বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বাতাস বইতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেল। নীলু মৃদু স্বরে বলল, রানু আপাকে তো আপনি ভালো মতন চিনতেন, তাই না। স্যার?
হ্যাঁ।
রানু আপার সঙ্গে আমার কী কী মিল আছে?
কোনো মিল নেই। প্রতিটি মানুষই আলাদা। এক জন মানুষের সঙ্গে অন্য এক জন মানুষের মিল থাকে সামান্যই।
আপার অসম্ভব ইএসপি ক্ষমতা ছিল। ছিল না?
তা ছিল।
আমারও আছে। আছে না?
হ্যাঁ, আছে।
রানু আপা কি আপনাকে কখনো বলেছিল, তার ভেতরে এক জন দেবী বাস করেন?
বলেছিল।
আপনি বিশ্বাস করেন নি?
না, করি নি। এইসব ছেলেমানুষ জিনিস বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে।
স্যার, রানু আপা যা বলত, এখন আমি যদি তা-ই বলি–আপনি বিশ্বাস করবেন।
না।
পৃথিবীতে অনেক রহস্যময় ব্যাপার আছে স্যার।
একসময় ঝড়-বৃষ্টিকেও রহস্যময় মনে করা হত, এখন করা হয় না। মানুষের জ্ঞান, মানুষের বুদ্ধি রহস্যময়তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। এই পৃথিবীতে যত অলৌকিক ব্যাপার আছে, তার প্রতিটির পেছনে আছে একটি লৌকিক ব্যাখ্যা।
মিসির আলি সিগারেট ধরলেন এবং বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন– দেখ নীলু, তুমি বলছো, তোমার ভেতর একজন দেবী আছেন। সেই দেবী যদি এই তোমার ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন এবং আমাকে বলেন এই যে মিসির সাহেব। তাহলেও আমি ব্যাপারটা বিশ্বাস করব না। আমি খুঁজবো একটা লৌকিক ব্যাখ্যা।
কী হবে সেই ব্যাখ্যা?
আমি যা দেখব, মনোবিজ্ঞানীর ভাষায় তার নাম হেলুসিনেশন। কিছু-কিছু ড্রাগস আছে, যা খেলে হেলুসিনেশন হয়। যেমন এলএসডি। ইংল্যাণ্ডে আমি এক ছাত্রকে দেখেছিলাম–সে এলএসডি খেত যিশুখ্রিষ্টকে দেখার জন্যে। এলএসডি খেলেই সে যিশুখ্রিষ্টকে দেখতে পেত। তুমি বুঝতেই পারছো, সে যা দেখত, তা হেলুসিনেশন।
নীলু দীর্ঘ সময় চুপ করে বসে রইল। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। এক-একটা বাতাসের ঝাপটা এসে গা ভিজিয়ে দিচ্ছে, তবু দুজনের কেউ নড়ল না। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। শুধু মিসির আলির সিগারেটের আলো ওঠানামা করছে।
নীলু ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার।
বল।
আমি একটি খারাপ লোকের হাতে পড়েছিলাম স্যার। একটা ভয়ঙ্কর খারাপ লোক আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নির্জন একটা ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। সে একটা ক্ষুর নিয়ে এসেছিল আমাকে মারতে। তখন সেই দেবী আমাকে রক্ষা করেন। সমস্ত ব্যাপারটা আমার দেখা। দেবীকেও আমি দেখেছি। একটি অপূর্ব নারীমূর্তি।
তুমি বলতে চাও, তারপর থেকে সেই দেবী তোমার সঙ্গে আছে?
হ্যাঁ।
তুমি যা দেখেছ, তার যে একটা লৌকিক ব্যাখ্যা হতে পারে–তা কি তুমি ভেবেছ?
সবকিছুর ব্যাখ্যা নেই স্যার।
চেষ্টা করে দেখি, এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় কিনা।
ঠিক আছে, চেষ্টা করুন।
রানু মেয়েটির সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল। তার কাছ থেকেই দেবীর ব্যাপারটি তুমি শুনেছ।। একটা নতুন ধরনের কথা। রোমান্টিক ফ্লেভার আছে দেবীর ব্যাপারটায়, কাজেই জিনিসটা তোমার মনে গেঁথে রইল। তুমি নিজে যখন বিপদে পড়লে, ঐ জিনিসটাই উঠে এল তোমার মনের ভেতর থেকে। একটা হেলুসিনেশন হল। তীব্র মানসিক চাপ এবং তীব্ৰ হতাশা থেকে এই হেলুসিনেশনের জন্ম। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে stress induced hallucination.
ঐ খারাপ লোকটি মারা গেল কীভাবে?
তাঁর মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক কারণে। পা পিছলে উল্টে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে বা এইজাতীয় কিছু। এখানে দেবীর কোনো ভূমিকা নেই, লোকটির সুরতহাল রিপোর্ট থেকেই তার মৃত্যুর কারণ বের হয়ে আসা উচিত। কী ছিল পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টে?
মিসির আলি প্রশ্নের জবাবের জন্যে অপেক্ষা করলেন। কোনো জবাব পাওয়া গেল না। নীলু মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। অন্ধকারে পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কেন জানি তাঁর মনে হল, মেয়েটি কাঁদছে। কাঁদবে কেন সে? কাঁদার মতো কোনো কথা কি তিনি বলেছেন?
নিলু?
জ্বি।
আমি এখন উঠি? আমার যাওয়া দরকার। এ-বৃষ্টি কমবে না। যত রাত হবে, তত বাড়বে। তুমি কি আমাকে আরো কিছু বলবে?
নীলু জবাব দিল না। মিসির উঠে দাঁড়ালেন।
তোমার বাবাকে খবর দাও, বিদেয় নিয়ে যাই।
নীলু কঠিন কণ্ঠে বলল, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
তিনি বিঘ্নিগ হয়ে বললেন, বাসায় যাচ্ছি, আর কোথায় যাব?
না। আপনার বাসায় যাওয়া হবে না। আজ রাতে আপনি এখানে থাকবেন।
কী বলছ তুমি!
আপনার জন্যে ঘর রেডি করে রেখেছি। সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম আছে। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এখানে কেন থাকবো?
এখানে থাকবেন, কারণ আজ রাতে লোহার রড নিয়ে একটি ছেলে আপনাকে মারতে যাবে। আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছি না বা বানিয়েও কিছু বলছি না। আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি। ঐ ছেলেটির নাম যদি আপনি জানতে চান, তাও বলতে পারি। কি, জানতে চান?
মিসির আলি ক্ষীণ স্বরে বললেন, ওরা কী নাম?
ওর নাম ফিরোজ। স্যার, আপনি কি আমি যা বলছি, তা বিশ্বাস করছেন?
বুঝতে পারছি না। আমি একটি দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছি।
দ্বিধার মধ্যে পড়েন বা না পড়েন–আমি এখান থেকে আপনাকে যেতে দেব না, কিছুতেই না।
মিসির আলি লক্ষ করলেন, মেয়েটি কঠিন স্বরে কথা বলছে। তার কথা বলার ধরন থেকেই বলে দেয়া যায়, এই মেয়ে তাকে যেতে দেবে না।
নীলু, আমার বাসায় কাজের মেয়েটি আছে একা।
না, ইমা আপনার ঘরে নেই। আপনার ফিরতে দেরি দেখে সে বাড়িওয়ালার ঘরে ঘুমুতে গেছে।
তুমি ওর কী নাম বললে?
যা নাম, তা-ই বললাম–ইমা।
ইমা?
হ্যাঁ, ইমা।
ওর বাবার নাম বলতে পারবো?
ইমা নাম থেকেই আপনি ওর বাবাকে বের করতে পারবেন।
বলতে-বলতে নীলু হেসে উঠলো। হাসিতে একটি ধাতব ঝঙ্কার। অন্য এক ধরনের কাঠিন্য। যেন এ নীলু নয়, অন্য একটি মেয়ে। অচেনা এক জন মেয়ে।
স্যার আসুন, আপনাকে আপনার ঘর দেখিয়ে দিই। ড্রয়ারে মোমবাতি আছে, মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে-বসে বৃষ্টির শোভা দেখুন। আমি যাব রান্না করতে।
তোমাদের টেলিফোন আছে না?
আছে। দিয়ে যাচ্ছি। আপনার ঘরে। যত ইচ্ছা টেলিফোন করুন।
টেলিফোনে অনেক চেষ্টা করেও ফিরোজদের বাড়ির কাউকে ধরা গেল না। হয় টেলিফোন নষ্ট, কিংবা রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না। আশ্চর্য ব্যাপার!
বাড়িওয়ালা করিম সাহেবকে টেলিফোন করলেন। করিম সাহেব জেগে ছিলেন এবং তিনি জানালেন হানিফা তাঁর বাসাতেই আছে। ঘুমুচ্ছে।
মিসির আলি মোমবাতি জ্বালিয়ে গেষ্টরুমে বসে রইলেন একা-একা! এখনো ইলেকট্রসিটি আসে নি। বাজ পড়ে কোনো ট্রান্সফরমার পুড়েটুড়ে গেছে হয়তো। কেউ ঠিক করবার চেষ্টা করছে না। এ দেশে কেউ কোনো কিছু ঠিক করবার জন্যে ব্যস্ত নয়। শহর অন্ধকারে ডুবে আছে তো কী হয়েছে? থাকুক ডুবে দুষ্ট লোকেরা অন্ধকারে বেরিয়ে আসবে? আসুক বেরিয়ে! আমরা কেউ কারো জন্যে কোনো মমতা দেখাব না। মমতা এ-যুগের জিনিস নয়।
কিন্তু সত্যি কি নয়? মমতা কি কেউ-কেউ দেখাচ্ছে না? নীলু। যে তাঁকে আটকে রাখল, তার পেছনে কি মমতা কাজ করছে না?
সে কেন তাঁকে এই মমতোটা দেখাচ্ছে? কেন, কেন? তাঁর ভুরু কুঞ্চিত হল। কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। জ্বর আসছে নাকি?
তিনি আবার সিগারেট ধরালেন। প্যাকেট শূন্য হয়ে আসছে। রাত কাটবে কী করে? এ বাড়িতে এখনও কোনো কাজের লোক তাঁর চোখে পড়ে নি, যাকে সিগারেট আনার জন্যে অনুরোধ করা যায়।
স্যার, আপনার চা।
নীলু এসে দাঁড়িয়েছে। মোমবাতির আলোয় কী সুন্দর লাগছে তাকে! মিসির আলি বিৱত স্বরে বললেন, চা তো চাই নি।
রান্না হতে দেরি হবে। চা খেয়ে খিদেটা চেপে রাখার ব্যবস্থা করুন।
তিনি চায়ের পেয়ালা হাতে নিলেন এবং নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, তুমি আমার নিরাপত্তার জন্যে হঠাৎ এত ব্যস্ত হলে কেন?
নীলু মৃদু হেসে বলল, এই প্রশ্নের জবাব এখন দেব না। একদিন নিজেই বুঝতে পারবেন। চায়ে চিনি হয়েছে কি না তাড়াতাড়ি দেখুন। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।
হয়েছে।
নীলু নিঃশব্দে চলে গেল! মিসির আলির হঠাৎ মনে হল, তিনি চাঁপা ফুলের গন্ধ পাচ্ছেন। হালকা সুবাস, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা গাঢ় হল। তিনি ঘরের ভেতর ফিসফিস কথা শুনলেন। কে কথা বলছে? দমকা বাতাসে মোমবাতি নিভে গেল, এবং তিনি স্পষ্ট শুনলেন, মাল পরে হেঁটে যাওয়ার মতো কে যেন তাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। কে কে বলে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন। এ-সব মনের ভুল। এ জগতে কোনো রহস্য নেই। আশেপাশে নিশ্চয়ই কোনো চাঁপা ফুলের গাছ আছে। গন্ধ আসছে সেখান থেকেই।
কিন্তু তবু তাঁর মনে হচ্ছে, দরজার ওপাশে পর্দার আড়ালে কেউ-একজন দাঁড়িয়ে আছে, এবং তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। কে সে? অন্য ভুবনের কেউ? নাকি অবচেতন মনে তার জন্মঃ পৃথিবীর সমস্ত অশরীরীর জন্মই কি অবচেতন মনে নয়? অবচেতন মন জিনিসটির অবস্থান কোথায়? মস্তিষ্কের নিউরোনে? নিউরোনের বৈদ্যুতিক আবেশই কি আমাদের নানান রকম মায়া দেখাচ্ছে?
তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। পর্দাটি খুব নড়ছে। যেন কেউ পর্দা নাড়িয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছে।
তিনি দেয়াশলাই জ্বললেন। আলো আসুক। আলোর স্পর্শে সব মায়া কেটে যাক। তিনি যেন নিজেকে সাহস দেবার জন্যেই বললেন, এ পৃথিবীতে রহস্যেরর কোনো স্থান নেই।
.
🔴 তেরো 🔴
.
সন্ধ্যাবেলা ওসমান সাহেব নিজে গিয়ে পরীক্ষা করলেন, গেট বন্ধ করা হয়েছে কি না। তালা টেনে- টেনে দেখলেন। দারোয়ানকে বললেন, ভোর হবার আগে গেট খুলবে না। কেউ ঢুকতে চাইলে বলবে, বাড়িতে কেউ নেই।
জ্বি আচ্ছা।
গেটের তালার চাবি কাউকে দেবে না। এমন কি ফিরোজ যদি চায়, তাকেও দেবে না।
জি আচ্ছা।
রাতটা মোটামুটি সজাগ কাটাবে। কোনো শব্দটব্দ হলে বের হয়ে দেখবে কী ব্যাপার।
জ্বি আচ্ছা!
ওসমান সাহেব চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকলেন। ফরিদার সঙ্গে তাঁর দেখা হল, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনো কথা হল না। দু জন এমন ভাব করছেন, যেন কেউ কাউকে চেনেন না। অনিদ্রাজনিত কারণে ফরিদার চোখ লাল। তিনি বসে আছেন মূর্তির মতো। ওসমান সাহেব তাঁর সামনের চেয়ারটাতে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থেকে মৃদু স্বরে বললেন, ফিরোজ কেমন আছে?
ফরিদা জবাব দিলেন না।
ওসমান সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। কানে যায় নি?
ফরিদা কোনো সাড়াশব্দ করলেন না। ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন। ওসমান সাহেব চাপা স্বরে বললেন, কথার জবাব দাও। ফিরোজ কেমন আছে?
ভালো।
ভালো মানেটা কী? গুছিয়ে বল।
গুছিয়ে বলতে পারব না। তুমি দেখে এস। আর শোন, আমার সঙ্গে এ রকম তেজ গলায় কথা বলবে না।
ফরিদা উঠে গেলেন। রওনা হলেন ফিরোজের ঘরের দিকে। ক্রুদ্ধ আওয়াজ আসছে সে-ঘর থেকে চাপা আওয়াজ। কোনো মানুষের কণ্ঠ থেকে এ-ধরনের আওয়াজ হওয়া সম্ভব নয়। যে এমন আওয়াজ করছে, সে মানুষ হতে পারে না। ফরিদাঁর গা কাঁপতে লাগল। কী হচ্ছে এ-সব। তিনি কি এগিয়ে যাবেন, না ফিরে আসবেন? এগিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা করছে না, কিন্তু তিনি গেলেন।
কাছাকাছি যাওয়ামাত্র ক্রুদ্ধ গর্জন থেমে গেল। তিনি দেখলেন, ফিরোজ বেশ ভালোমানুষের মতো চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। হাতে একটি বই। সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি। ফরিদা বললেন, কেমন আছিস তুই?
ভালো। তুমি কেমন আছ মা?
ফরিদার চোখে পানি এসে গেল। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে এই প্রথম ফিরোজ এমন স্বরে কথা বলল।
ফিরোজ, তুই আমাকে চিনতে পারছিস তো?
চিনতে পারব না কেন? কী বলছো তুমি।
গত দু দিন তো চিনতে পারিস নি।
তোমারও তো আমাকে চিনতে পার নি।
আমরা চিনতে পারব না কেন?
না, চিনতে পারো নি। চিনতে পারলে নিজের ছেলেকে তালাবদ্ধ করে রাখতে না। তোমরা বিশাল একটা তালা দিয়েছ। হা হা হা।
ফরিদা কথা ঘোরাবার জন্যে বললেন, কিছু খাবি ফিরোজ?
হ্যাঁ, খাব। কিন্তু মা, টেবিলে খাবার দেবে। তালা খুলে ফেলবে। আমি খাবার ঘরে টেবিল-চেয়ারে বসে খাব।
ফরিদা কোনো উত্তর দিলেন না। শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফিরোজ যা বলছে তা সম্ভব নয়। তালা খুলে তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
কি মা, কথা বলছ না যে? তালা খুলবে না?
ফরিদা জবাব দিলেন না।
কিন্তু মা তালাবন্ধ করে কাউকে আটকে রাখা ঠিক না। খুব অন্যায়। অন্যায় নয়?
হ্যা , অন্যায়।
বেশ, তালা খোল।
ফিরোজ উঠে দাঁড়াল। তার কোলের ওপর রাখা বইটি মেঝেতে পড়ে গেল, ফিরোজ সেদিকে ফিরেও তাকাল না। সে এগিয়ে এসে জানালার শিক ধরে দাঁড়াল। ফরিদা জানালার পাশ থেকে একটু দূরে সরে গেলেন।
দূরে চলে গেলে যে মা? ভয় লাগছে? হা হা হা। খুব ভয় লাগছে, না?
ফিরোজ জানালার শিক ধরে বাঁকাতে লাগলো।
ফরিদা ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, এ-রকম করছিস কেন?
লোহার শিকগুলো কেমন শক্ত, তাই দেখছি।
এ রকম করিস না বাবা।
তালা খুলে দাও, এ রকম করবো না। আমি চিড়িয়াখানার জন্তু নই মা, যে আমাকে খাঁচার মধ্যে বন্দি করে রাখবে। যাও, বাবার কাছে যাও। চাবি নিয়ে এস। বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে আসছে। আমি খোলা মাঠে খানিকক্ষণ হাঁটবো। যাও, যা করতে বলছি কর।
ফরিদা বসার ঘরের দিকে এগুলেন। ফিরোজ জানালার শিক ধরে ঝাঁকাচ্ছে। তার মুখ হাসি-হাসি। যেন শিক ঝাঁকানো খুব-একটা মজার ব্যাপার। আনন্দের একটা খেলা। খুব ছোটবেলায় ফিরোজ এ-রকম করতো। জানালায় উঠে শিক ধরে ঝাঁকাত।।
ওসমান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। কঠিন স্বরে বললেন, কী পাগলের মতো কথা বলছো। তালা খুলবো মানে? কী হয়েছে, তুমি জান না?
ফরিদা চুপ করে রইলেন।
একটা ছেলে মারা গেছে। তার পরেও তুমি বলছো তালা খুলবো।
তালা দিয়েই-বা লাভ কী হচ্ছে? ঐ রাতেও তো তালাবন্ধ ছিল। ছিল না?
ওসমান সাহেব এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। হ্যাঁ, ঐ রাতে তালাবন্ধ ছিল এবং ভোরবেলা ঘর তালাবন্ধই পাওয়া গেছে।
ফরিদা বললেন, ঐ ছেলের মৃত্যুর সঙ্গে ফিরোজের কোনো সম্পর্ক নেই। ফিরোজ ঘরেই ছিল।
ঘরে থাকলেই ভালো।
ফরিদা স্বামীর পাশে বসলেন। তাঁর মুখ শান্ত। তাঁর চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ ওসমান সাহেব বললেন, তুমি কিছু বলবে?
হ্যাঁ।
বলে ফেলো। এভাবে তাকিয়ে থেক না।
ফিরোজ প্রসঙ্গে তুমি যে ডিসিশন নিয়েছ, আমার মনে হয় তা ঠিক নয়। তুমি কতদিন তাকে তালাবন্ধ করে রাখবে? ওর চিকিৎসা করাও। মিসির আলিকেই-বা আসতে দিচ্ছ না কেন?
ঐ ছেলেটির প্রসঙ্গ চাপা না-পড়ার আগে আমি কাউকে এ-বাড়িতে আসতে দেব না। উনি টেলিফোন করলে বলবে।–ফিরোজ মামার বাড়ি গেছে।
এতে ফিরোজের অসুখ বাড়তেই থাকবে।
বাড়ুক। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, তোমার ছেলেকে ওরা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিক। চাও?
না, চাই না।
তাহলে চুপ করে থাক। একটা তালা আছে, আরেকটা তালা লাগাও।
ফিরোজকে তুমি শুধু-শুধু সন্দেহ করছো। তালাবন্ধ ঘর থেকে সে কীভাবে বের হবে?
তা জানি না। কিন্তু সে বের হয়েছে, এটা আমি যেমন জানি–তুমিও তেমন জানো। এই নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তুমি অন্য ঘরে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।
ঝন ঝন শব্দ হচ্ছে ফিরোজের ঘরে। সে প্ৰচণ্ড শব্দে জানালা ঝাঁকাচ্ছে।
ফরিদা নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করলেন। ওসমান সাহেব বের হয়ে এসে কঠিন স্বরে ফিরোজকে বললেন, এ-রকম করছিস কেন? স্টপ ইট।
ফিরোজ হাসিমুখে বলল, রাগ করছো, কেন বাবা?
ওসমান সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
দরজা খুলে দাও বাবা। আমি খাবার ঘরে বসে ভাত খাব খিদে লেগেছে। কি, খুলবে না?
লোহার রডটা আমার কাছে দে, আমি তালা খুলে দিচ্ছি।
না বাবা, ওটা সম্ভব নয়। লোহার রাডটা দেয়া যাবে না।
কেন দেয়া যায় না?
ও রাগ করবে।
কে রাগ করবে?
নাম বললে চিনবে? শুধু-শুধু জিজ্ঞেস করছো কেন? তালা খুলবে কি খুলবে না?
ওসমান সাহেব জবাব না দিয়ে চলে এলেন। ফিরোজ জানালা ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে খুব হাসতে লাগলো।
.
******
.
থার্ড ইয়ার ফাইনালের ডেট দিয়ে দিয়েছে।
মেডিকেলের ছাত্রদের কারোর দম ফেলার সময় নেই। ক্লাস এখন সাসপেণ্ডেড। আজমল ঠিক করে রেখেছে, সে এখন থেকে নাশতা খেয়ে পড়তে বসবে এবং একটানা পড়বে লাঞ্চ টাইম পর্যন্ত। এক ঘন্টার ব্রেক নেবে লাঞ্চে, তারপর আবার পড়া। তা ছাড়া পাস করার উপায় নেই। নানান দিক দিয়ে খুব ক্ষতি হয়েছে এবছর। প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো ঝামেলায় পড়া হচ্ছে না। এ-রকম চললে পরীক্ষা দেয়া হবে না। এবার পরীক্ষায় না বসলে ডাক্তারি পড়া বন্ধ করে দিতে হবে। খরচ চালিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই। গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে দিলে হত, কিন্তু মা বেঁচে থাকতে তা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বিক্রি করেও লাভ হবে না, কিছু ভাঙা রাজপ্রাসাদ কে কিনবে? কার এত গরজ?
আজমল বই নিয়ে বসেই উঠে পড়লো —জানোলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মিসির আলি ঢুকছেন। তার খুব ইচ্ছা হতে লাগলো , বইপত্র নিয়ে অন্য কোনো ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ খুঁজেটুজে তিনি চলে যাবেন। কিন্তু ভদ্রলোকের যা স্বভাব-চরিত্র, তিনি আবার আসবেন! আবার আসবেন! অসহ্য! কেন জানি আজমল তাকে সহ্য করতে পারে না। কেন সহ্য করতে পারে না–এ নিয়েও সে ভেবেছে, কিছু বের করতে পারে নি। লোকটি ভালোমানুষ ধরনের, তবে অসম্ভব বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান কেউ ভালোমানুষ হতে পারে না। ভালোমানুষেরা বোকাসোকা ধরনের হয়।
ভেতরে আসবো?
আজমল বিরক্তি গোপন করে বললো, আসুন।
আমি পরশুদিনও এক বার এসেছিলাম। তোমার রুমমেটকে বলে গিয়েছিলাম, আজ আসবো। সে তোমাকে কিছু বলে নি?
জ্বি-না, বলে নি। ভুলে গেছে বোধহয়। বসুন।
মিসির আলি বসাতে-বসতে বললেন, অনেক দিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা। এর মধ্যে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। জান বোধহয়।
জ্বি, জানি। নাজ চিঠি লিখেছিল।
খুব যন্ত্রণায় ফেলেছিলাম ওদের। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।
আজমল কিছু বললো না।
মিসির আলি বললেন, বেশিক্ষণ তোমাকে বিরক্ত করবো না। একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করতে এসেছি।
জিজ্ঞেস করুন। তোমাদের বাড়িতে একটা ঘর আছে, যেখানে তোমাদের পূর্বপুরুষদের কিছু ছবিটবি আছে। তুমি কি সেই ঘরে ফিরোজকে নিয়ে গিয়েছিলে?
জ্বি হ্যাঁ, নিয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু ঐ ঘর তো তালাবন্ধ। ওর চাবি থাকে নাজনীনের কাছে। সে তো বললো, ও ঘর খোলা হয় নি।
আমার কাছে একটা চাবি আছে, ও জানে না।
খালিগায়ে এক জনের ছবি আছে। ঐ ছবিটা কি ফিরোজকে দেখিয়েছ?
সব ছবিই দেখিয়েছি।
আমি এই বিশেষ ছবিটি প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করছি। শুনেছি একে ক্ষিপ্ত প্ৰজারা লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এটা কি সত্যি?
জ্বি, সত্যি। শাবল দিয়ে পিটিয়ে মারে।
এই গল্পটি কি তুমি ফিরোজের সঙ্গে করেছ?
জ্বি-না, করিনি।
অন্য কেউ কি করেছে বলে তোমার ধারণা?
মনে হয় না। গল্প করে বেড়াবার মতো কোনো ঘটনা এটা না।
মিসির আলি উঠে পড়লেন। আজমল বললো, আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না?
না। উঠি এখন। তুমি পড়াশোনা করছিলে, কর। আর ডিসটার্ব করব না।
আজমল তাঁকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। মিসির আলি বললেন, নাজনীন মেয়েটি বড় ভালো। ওকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। চমৎকার মেয়ে।
আজমল কিছু বললো না।
মিসির আলি বললেন, নাজনীন আমাকে বলেছে শীতের সময় একবার যেতে। আমি কথা দিয়েছি, যাব। এ-শীতেই যাব। যাই আজমল, আর আসতে হবে না।
তিনি মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন। ফিরোজ ছবিটা দেখেছে। জট খুলতে শুরু করছে। এই ছবির ছাপ পড়েছে ফিরোজের চেতনায় এবং মিসির আলির ধারণা, লোকটির মৃত্যুসংক্রান্ত গল্পটিও সে শুনেছে। লোহার রড নিয়ে তার খালিগায়ে বের হবার রহস্যটি হচ্ছে ছবিতে এবং গল্পটিতে।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মিসির আলি গ্রাহ্য করলেন না। বরং বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে এগিয়ে যেতে তাঁর ভালোই লাগছে। ফিরোজের অসুখের পেছনের কারণগুলো দাঁড় করাতে চেষ্টা করতে লাগলেন। অনেকগুলো ঘটনাকে একসঙ্গে মেলাতে হবে। ঘটনাগুলো এ-রকম—
(১) অসম্ভব রূপবতী একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হল যে মেয়েটির পলিও আছে। এই ঘটনাটি তাকে অভিভূত করলো।
(২) মেয়েটি তাকে আহত করলো, সে কড়া গলায় বলল-আমার হাত ছাডুন।
(৩) ফিরোজ খালিগায়ের লোকটির ছবি দেখলো এবং খুব সম্ভব তার মৃত্যুবিষয়ক গল্পটিও শুনলো।
(৪) রাতে তার প্রচণ্ড জ্বর হল। জ্বরের ঘোরে ঐ লোকটির ছবি বারবার মনে হল।
(৫) সে নির্জন নদীর পাড় ধরে এক-একা হাঁটতে গেল, তখুনি একটি হেলুসিনেশন হল।
মিসির আলি বৃষ্টিতে নেমে গেছেন। রাস্তার লোকজন অবাক হয়ে তাঁকে দেখছে। ঢালাও বর্ষণ উপেক্ষা করে কেউ এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটে না।
.
🔴 চৌদ্দ 🔴
.
সাইদুর রহমান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনার কী হয়েছে?
মিসির আলি বললেন, শরীরটা খারাপ স্যার।
শরীর তো আপনার সবসময়ই খারাপ। এর বাইরে কিছু হয়েছে কি না বলেন। আপনাকে হ্যাগার্ডের মতো দেখাচ্ছে!
গত পরশু রাতে কে যেন তালা ভেঙে আমার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করেছে।
আপনি বাসায় ছিলেন না?
আমি তো স্যার প্রথমেই আপনাকে বলেছি তালা ভেঙে ঢুকেছে। কাজেই আমার ঘরে থাকার প্রশ্ন ওঠে না।
সাইদুর রহমান সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন।
মিসির আলি বললেন, আমি ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছি। দিন দশেকের ছুটির আমার খুব দরকার।
রহমান সাহেব মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস-ট্লাস তো এমনিতেও হয় না। এর মধ্যে আপনারা ছুটি নিলে তো অচল অবস্থা। এর চেয়ে আসুন, সবাই মিলে ইউনিভার্সিটি তালাবন্ধ করে চলে যাই, কী বলেন?
মিসির আলি সহজ স্বরে বললেন, আপনি কি স্যার আমার সঙ্গে রসিকতা করতে চেষ্টা করছেন?
রসিকতা করবো কেন?
গত দু বছরে আমি কোনো ছুটি নিই নি। এখন নিতান্ত প্রয়োজনে চাচ্ছি। দিতে না চাইলে দেবেন না। আপনার নিজের কী অবস্থা। এ-বছরে আপনি কি কোনো ছুটি নেন নি?
অন্যের সঙ্গে সবসময় একটা কমপেয়ার করার প্রবণতাটা আপনার মধ্যে খুব বেশি। এটা ঠিক না মিসির আলি সাহেব। আপনি সি. এল-এর ফরমটা রেখে যান, আমি রিকমেন্ড করে দেব।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। সাইদুর রহমান বললেন, উঠবেন না, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। বসুন।
তিনি বসলেন। জরুরি কথাটা কি আঁচ করতে চেষ্টা করলেন। সাইদুর রহমান সাহেবের মুখ হাসি-হাসি। কাজেই কথাটা মিসির আলির জন্যে নিশ্চয়ই সুখকর হবে না।
আপনার পার্ট টাইম অ্যাপিয়েন্টমেন্টের মেয়াদ তো শেষ হতে চললো। এক্সটেনশনের জন্যে কী করছেন?
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমাকে কিছু করতে হবে নাকি। আমার তো ধারণা ছিল, আমার কিছু করার নেই। ইউনিভার্সিটি যা করার করবে।
সাইদুর রহমান সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল। এর মানে কী? তাঁকে কি এক্সটেনশন দেয়া হবে না? সেটা তো সম্ভব নয়। যেখানে ফুল টাইম টীচার অ্যাপিয়েন্টমেন্ট হবার কথা, সেখানে পার্ট টাইম চাকরির এক্সটেনশন হবে না? এটা কেমন কথা!
স্যার, আপনি ঠিক করে বলেন তো ব্যাপারটা কি। আমার মেয়াদ শেষ?
এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এক জনের এডহক অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো হয়েছে। এখন আর আমাদের টীচারের শর্টেজ নেই।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। খাজনার থেকে বাজনা বেশি। ছাত্রের চেয়ে টীচারের সংখ্যা বেশি।
মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করি নি। আপনি কেন আমার পেছনে লেগেছেন?
আরে, এটা কী বলছেন। আমি আপনার পেছনে লাগবো কেনো? কী ধরনের কথা এ-সব?
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। আর এখানে বসে থাকার কোনো মনে হয় না!
সাইদুর রহমান সাহেব বললেন, কি, চললেন?
হ্যাঁ, চললাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়? তাঁরা কি কিছু করতে পারবেন? পারবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এ-জাতীয় কারোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কমসংখ্যক অধ্যাপককেই তিনি চেনেন।
স্যার স্নামালিকুম।
মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন, দুটি ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, তোমরা কিছু বলবে?
জ্বি-না স্যার।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
তিনি হাঁটছেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে চাকরি চলে গেলে তিনি অথৈ পানিতে পড়বেন। সময় ভালো না। দ্বিতীয় কোনো চাকরি চট করে জোগাড় করা মুশকিল। সঞ্চয় তেমন কিছু নেই। ইচ্ছা করলে সঞ্চয় করা যেত। ইচ্ছা করে নি। এ পৃথিবীতে কিছুই জমা করে রাখা যায় না। সব খরচ হয়ে যায়।
মিসির আলি হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বললেন, I cannot and will not believe that man can be evil.
তাঁর প্রিয় একটি লাইন। প্রায়ই নিজের মনে বলেন। কেন বলেন? এই কথাটি কি তিনি বিশ্বাস করেন না? যা আমরা বিশ্বাস করি না, অথচ বিশ্বাস করতে চাই, তা-ই আমরা বারবার বলি।
তিনি ঘড়ি দেখলেন। তিনটা বাজে। শরীর খারাপ লাগছে। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু অনেক কাজ পড়ে আছে। আজমলের সঙ্গে দেখা করা এখনো হয়ে ওঠে নি। ফিরোজের সঙ্গে দেখা করতে পারেন নি। তার সঙ্গে দেখা করার সব কটি প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে। অথচ খুব তাড়াতাড়ি দেখা করা দরকার! সাজ্জাদ হোসেনেরই-বা খবর কি? সে কি হানিফ সম্পর্কে কোনো তথ্য পেয়েছে? না কোনো চেষ্টাই করে নি?
নীলুর সঙ্গেও আর দেখা হয়নি। এর মধ্যে দুবার গিয়েছেন ঝিকাতলায়। দুবারই বাসার সামনে থেকে চলে এসেছেন। কেন যে তাঁর লজ্জা লাগছিল! লজ্জার কী আছে? কিছুই নেই। তিনি যাচ্ছেন তাঁর ছাত্রীর বাসায়। এর মধ্যে লজ্জার কী?
লাইব্রেরি থেকে একটা বই ইস্যু করার কথা–ইলুশন অ্যান্ড হেলুসিনেশন, ডঃ জিম ম্যাকার্থির বই। প্রচুর কেইস হিষ্ট্রি আছে সেখানে। কেইস হিষ্ট্রিগুলো দেখা দরকার। কোনোটার সঙ্গে কি ফিরোজের বা নীলুর ব্যাপারগুলো মেলে? পুরোপুরি না মিললেও অনেক উদাহরণ থাকবে খুব কাছাকাছি। সেগুলো খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
মিসির আলি লাইব্রেরিতে চলে গেলেন। সাধারণত যে-বইটি খোঁজা হয়, সে বইটিই পাওয়া যায় না। ভাগ্যক্রমে এটি ছিল। চমৎকার বই। তিন শর মতো কেইস হিষ্ট্রি আছে। আজ রাতের মধ্যেই শেষ করে ফেলতে হবে। তিনি ষ্টিভিনশনের সমনোমাবলিক প্যাটার্ন বইটিও নিয়ে নিলেন। এটিও একটি চমৎকার বই। তাঁর নিজেরই ছিল। তাঁর কাজের ছেলেটি পুরানো বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছে। মহা বদমাশ ছিল। তাঁকে প্রায় ফতুর করে দিয়ে গেছে। তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মানুষ কত বিচিত্র। এই ছেলেটিকে তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন। স্নেহ অপাত্রে পড়েছিল। মানুষের বেশির ভাগ স্নেহ-মমতাই অপাত্রে পড়ে।
.
*****
.
কেউ আমার খোঁজ করেছিল, হানিফা?
জ্বি-না।
চা বানিয়ে আন।। দুধ-চিনি ছাড়া।
হানিফা চলে গেল। তার শরীর বোধ হয় খানিকটা সেরেছে। মুখের শুকনো ভাবটা কম। ঘরে ওজন নেবার কোনো যন্ত্র নেই। যন্ত্র থাকলে দেখা যেত, ওজন কিছু বেড়েছে কি না।
মিসির আলি ইজি চেয়ারে শুয়ে জিম ম্যাকার্থির বইটির পাতা ওল্টাতে লাগলেন। কত বিচিত্ৰ কেইস হিষ্ট্রিই -না ভদ্রলোক জোগাড় করেছেন!
কেইস হিষ্ট্রি নাম্বার সিক্সটি
মিস কিং সিলভারস্টোন
বয়স পাঁচিশ।
কম্পুটার প্রোগ্রামার
দি এনেক্স ডিজিটাল্স্ লিমিটেড
ডোভার, ক্যালিফোর্নিয়া।
মিস কিং সিলভারষ্টোন থ্যাংকস গিভিংয়ের দু দিন আগে দি এনেক্স ডিজিটাল্স্ লিমিটেডের তিনতলার একটি ঘরে কাজ করছিলেন। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। অফিসের এক জন গার্ড ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। গার্ড একতলায় কফিরুমে। সে বলে গেছে মিস সিলভারস্টোন যেন কাজ শেষ করে যাবার সময় তাকে বলে যান।
কাজেই মিস সিলভারাষ্টোন রাত আটটার সময় কাজ শেষ করে কফিরুমে গেলেন। অবাক কাণ্ড, কফিরুম অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। তিনি ভয় পেয়ে ডাকলেন——মুলার। কেউ সাড়া দিল না।
তিনি ভাবলেন, মুলার হয়তো-বা সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজেই তিনি ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন–মুলার নেই, তবে সোফায় এক জন অস্বাভাবিক লম্বা মানুষ বসে আছে। মানুষটি নগ্ন। তিনি চেঁচিয়ে ওঠার আগেই লোকটি বলল, ভয় পেও না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
তুমি কে? আমি এসেছি। সিরাস আমি পৃথিবীর আমি এই গ্রহের মানুষ নই। আমি এ রাস নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে। একটি রমণীর গর্ভে সন্তানের সৃষ্টি করতে চাই।
মিস সিলভারষ্টোন পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তাঁর পা যেন মেঝের সঙ্গে আটকে গেছে। তিনি চিৎকার করতে চেষ্টা করলেন–গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, একে-একে তাঁর গায়ের কাপড় আপনা-আপনি খুলে যাচ্ছে। দেখতে-দেখতে তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গেলেন। এই লোকটি তখন উঠে দাঁড়ালো। তিনি লক্ষ্য করলেন, লোকটির গায়ের চামড়া ঈষৎ সবুজ এবং তার গা থেকে চাপা এক ধরনের আলো বেরুচ্ছে।
লোকটি এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরলো। আপনা-আপনি বাতি নিভে গেল।
এই হচ্ছে মিস কিং সিলভারষ্টোনের গল্প। তিনি পরবর্তী সময়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং ডাক্তারের কাছে জানতে চান, তাঁর বাচ্চাটির গায়ের রঙ সবুজ হবার সম্ভাবনা কতটুকু?
ম্যাকার্থির একুশ পৃষ্ঠার বিশ্লেষণ আছে কেইস হিস্ট্রির সঙ্গে। তিনি অভ্রান্ত যুক্তিতে প্রমাণ করেছেন, এটি ইলিউশনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। মিস সিলভারষ্টোন সেখানে দেখেছেন মুলারকে। সিরাস নক্ষত্রপুঞ্জের কোনো আগন্তুককে নয়।
মিসির আলি একটির পর একটি কেইস হিস্ট্রি গভীর আগ্রহে পড়তে শুরু করলেন। তাঁর নিজেরও এ-রকম একটি বই লেখার ইচ্ছা হতে লাগল। সেখানে রানু, নীলু, ফিরোজের কেইস হিস্ট্রি এবং অ্যানালিসিস থাকবে। কিন্তু তা করতে হলে এদের সমস্ত রহস্য ভেদ করতে হবে। তা কি সম্ভব হবে? কেন হবে না? অসম্ভব আবার কী? নোপোলিয়নের কী-একটি উক্তি আছে না। এ প্রসঙ্গে–Impossible is the word…? উক্তিটি কিছুতেই মনে পড়ল না।
হানিফা চা বানিয়ে এনেছে। সুন্দর লাগছে তো মেয়েটিকে। মেয়েটির ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। তিনি কি অলস হয়ে যাচ্ছেন? বোধহয়। বয়স হচ্ছে। আগের কর্মদক্ষতা এখন আর নেই। মিসির আলি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আপনের চা।
হানিফা চায়ের কাপ সাবধানে নামিয়ে রাখলো। তিনি লক্ষ্য করলেন, মেয়েটি নখে নেলপালিশ লাগিয়েছে। নেলপালিশ তিনি তাকে কিনে দেন নি। সে নিজেই তার জমানো টাকা থেকে কিনেছে। তাঁর নিজেরই কিনে দেয়া উচিত ছিল।
হানিফা বস। তোর সঙ্গে গল্পগুজব করি কিছুক্ষণ।
হানিফা বসল। মিসির আলি বললেন, আমি তোর বাবা-মাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছি, বুঝলি?
হানিফা কিছু বললো না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তিনি কি পারবেন। এর কোনো খোঁজ বের করতে? না-পারার কী আছে? এটি এমন জটিল কাজ নিশ্চয়ই নয়। সাজ্জাদ হোসেন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে তিনি বলেছেন, মেয়েটির নাম ইমা হবার সম্ভাবনা। এই নামের কোনো নিখোঁজ মেয়ের তথ্য আছে কি না দেখতে।
সে চোখ-মুখ কুঁচকে বলেছে, বুঝলি কি করে, ওর নাম ইমা? তিনি সে-প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন নি। দিতে পারেন নি বলাটা ঠিক হল না, বলা উচিত–দিতে পারতেন, কিন্তু দেন নি। সব প্রশ্নের উত্তর সবাইকে দেয়া যায় না। ইমা নামটি কোথেকে পাওয়া, সেটা কাউকে না বলাই ভালো, বিশেষ করে পুলিশকে। পুলিশরা এজাতীয় আধিভৌতিক ব্যাপার সাধারণত বিশ্বাস করে না।
পুলিশের ওপর পুরোপুরি নির্ভরও তিনি করেন নি। তাঁর এক ছাত্রকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। তার কাজ হচ্ছে প্রতিদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরনো পত্রিকা ঘাঁটা। দেখবে, ইমা নামের নিখোঁজ মেয়ের কোনো খবর ছাপা হয়েছে কি না। এই কাজের জন্য সে ঘন্টায় পঞ্চাশ টাকা করে পাবে দশ ঘন্টার জন্যে পাঁচ শ টাকা তিনি তাকে আগেই দিয়ে দিয়েছেন। কাজে যাতে উৎসাহ আসে, তার জন্যে এক হাজার টাকার একটি পুরস্কারের কথাও বলেছেন। যদি সে ইমা নামের কোনো নিখোঁজ বালিকার খবর বের করতে পারে, তাহলে এককালীন টাকাটা পাবে।
এই ব্যাপারে মিসির আলির মন খুঁতখুঁত করছে। ইমা নামটির ওপর এতটা গুরুত্ব দেয়া ঠিক হয় নি। যে-কোনো নিখোঁজ বালিকার সংবাদ সংগ্ৰহ করতে বলাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। এক জনের অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতার ওপর এতটা আস্থা রাখা ঠিক নয়। তিনি নিজে এক জন যুক্তিবাদী মানুষ। তাঁর জন্যে এটা অবমাননাকর।
COMMENTS